গ্রামের শেষ ধারে, যেখানে ঢিল ছড়িয়ে পড়ে রোজকার রোদে, সেখানে থাকত মীরা। ছোট্ট মোড়ের ওই ঘরে জমে ছিল দাদুর সব জিনিস—পুরনো কড়া, এক ঝুড়ি কাগজ আর এক ছেঁড়া চিঠি। মীরা ছোট থেকেই কাগজ-কিরিয়ে থাকে; দাদু বলে করত, “কাগজ কথা রাখে, লোকেরা ভুলে যায়।”
একদিন ঝরে পড়া পলাশের পাতার সাথে মিষ্ঠি চা নিয়ে মীরা আলমারির খামে গলাধপ করে বসে। সে ছেঁড়া খামটা খুলল—ভিতরে ছিল কাগজের এক তলা, ঢেউ খেলানো হরফে লেখা। চিঠিটা পুরনো, স্যাঁতসেঁতে দাগ, কালি অর্ধেক মুছে গেছে। মীরার চোখ থেমে গেল—চিঠিতে লেখা,
> “মীরা, যদি তুমি এই চিঠি পড়ে থাকো, বুঝবে—আমি তখনও ফিরতে চাইনি। নামটা মনে রাখবে না বললেও, আমি জানি তুমি সেই ছোট্ট মেয়ে—তুই হাসলে ঘর জেগে ওঠে। কিন্তু আমি রাত্রির ভেতর একটা ভুল করেছি; ও ভুল মেটাতে আমি আজও পালাই। — জোয়েল।”
মীরা থমকে গেল। “জোয়েল?” সে মুখে আওয়াজ আনলো না। গ্রামের সবার নাম সে জানে—কিন্তু এই নামটা কানে নতুন। দাদু বাসায় নেই—সে দেখাতেন না যে কোনো প্রেমের ব্যথা। মীরা ঠিক করল, নামটা খুঁজে বের করবে।
প্রথমে গেল গ্রামপাড়ার কুচকাওয়াজের কাছে। কেউ জানে না। তারপরে মোড়ে চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করল—কেউ বলল, “শহরে গেছে অনেক দিন আগে, হয়তো ওই ‘জো’।” মীরা ধরে নিল—এই নামটা শহরের হতে পারে। সন্ধ্যায় সে চেয়ারে বসে ভাবল—কেন দাদু এসব লুকিয়ে রেখেছিলেন?
পরের দিন কলকাতা পথে মীরা। হাতে এক লিস্ট—চায়ের দোকান থেকে পাওয়া কিছু অর্ধসুচী, কিছু ফোন নাম্বার। শহরের প্রথম গলিতে সে নামটা খোঁজ করতে করতে এক পুরনো কফিশপে গিয়ে বসে। কফির ধোঁয়ায় লেখকরা গল্প বিক্রি করে—কিন্তু এখানে কফির টেবিলে বসে থাকা এক বুড়ো মানুষ মীরার কাগজটায় চেয়ে বলল, “এই নামটা—জোয়েল? ও তো আবার ফিরে এসেই এসেছে, বসে আছে পাশের রোডে। কদিন ধরেই ও শহরের লাইব্রেরায় যায়।”
মীরার বুক ধক করে উঠল। লাইব্রেরি? সে ছুটে গেল। লাইব্রেরির দরজায় দাঁড়িয়ে এক যুবক বইয়ের পালঙ্কে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল। যখন সে টার্ন নিতে গিয়েছিল, যুবক চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মিরা চমকে উঠল—তার চেহারায় দাদুর বর্ণের মিল! কিন্তু ক্ষণিকেই সে বুঝল—এই কেউ দাদুর ছেলে নয়। সে নিজেই অচেনা ছিল, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত চেনা সুর।
“তুমি—কী চাইছ?” যুবক হয়ে উঠল। মীরা থরথর করে বলল, “তুমি—জোয়েল নাকি?” যুবকের চোখে অচেনা হাসি—“না, আমি জো। কিন্তু তুমি কে?” মীরা বুঝল—তিনি নামটা কেমন করে ধরেছেন, কিন্তু সে এখান থেকে নামটা ছাড়া যেতে পারবে না। সে চিঠিটি খুলে দেখাল। জো চিঠিটি দেখে চমকে উঠল—“ওটা—আমি লিখেছিলাম।”
জো কফি খেতে খেতে বলল, “অনেক বছর আগে—একজন মেয়ে ছিল, যে বইয়ের গন্ধে সুখ পেত। আমি তাকে বই দিয়ে সুইচ করেছি। আমরা শহরে এসে আলাপ ছিল; কিন্তু তার পরিবারের ইচ্ছা ভিন্ন ছিল। আমি চিঠি লিখে তাকে বলতে চাইতাম—আমি ফিরবো। কিন্তু ভয়ে চিঠি পৌঁছায়নি; আমার এক বান্ধবী চুরি করে পাঠিয়েছিল।” জো কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমি চলে গেলাম।”
মীরার মনে উঠল—কী কঠিন ভুল! সে জিজ্ঞেস করল, “তবে তোমার নাম কেমনে তখন দাদু-এর খামে?” জো দুঃখমিশ্র হাসি দিল—“তুমি জানো না—দাদু ছিল আমার এক অভিশপ্ত বন্ধু। তিনি ক্লাসের দিনগুলোতে আমার সঙ্গে ছিল—আমি তাকে ভুল করেছিলাম; সে আজও আমাকে অনুভব করেছিল। সম্ভবত তিনি ওই চিঠি রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন—একদিন কোনো ডাবল-ভগা ভর্তুকি পাঠাবে।”
এক নিয়ে সূরুয গড়াল—জো বলল সত্যি গল্পটা—কীভাবে সে শহর ছেড়ে গিয়েছিল, কিভাবে তাকে ভুল বোঝা হয়েছিল; কীভাবে চিঠি হারিয়ে গিয়েছিল। মীরা শুনল, চোখ ভিজে গেল—চিঠির অক্ষরে যেন দাদুর কণ্ঠ লুকানো। সে বলল, “তুমি কী করতে চাও?” জো হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি সব ভুল মেটাতে চাই। দাদুর মনে পড়ে কি না—আমি জানি না। কিন্তু যদি তুমি চাও, আমরা একসাথে যাবো। আমি ওই মেয়েটার খোঁজ নেব—চিঠির ঠিক প্রতিশোধ নয়, বরং তাকে বলব—আমি ভুল করেছি। কিন্তু আগে আমাকে একটি কথা বলো—তুমি দাদুকে কত ভালোবাসো?”
মীরা চোখে জল ধরে—“অনেক। তিনি আমার দুনিয়া।” জো গম্ভীর হয়ে বলল, “তাহলে চল, শুরু করি।” তারা শহরের এক পুরাতন পল্লির কাছে গেল। মীরার হাতে ছিল দাদুর খাম আর চিঠির কপি; জো লাইব্রেরির পুরনো ডাকাবুকির কাছে ফোন লাগালো—শেষবার যখন সে ওই মেয়েটার নাম শুনেছে, তখন মনে পরে। ফোন কেটে কয়েক মুহূর্তে জীবন বদলে গেল—একটি নাম মায়ের কণ্ঠে ফিরে এল।
মীরা আর জো দু’জনে ঐ মেয়েটার ঠিকানায় গেল—কানায় গঙ্গার ওপার, এক ছোট বাড়ি। দরজায় দাঁড়ালে ভিতর থেকে ফিসফিস কণ্ঠ—“হ্যাঁ?” মীরা কাঁপা গলায় বলল, “আমি মীরা; এটা আপনার জন্য একটা চিঠি আছে—” দরজার ভেতর থেকে আভা বেরিয়ে এল—চোখ নরম, বয়স একটু কেটে গেছে। তার মুখে ছিল অদ্ভুত চেনা ভাব। তিনি চিঠিটা ধরে রেখে পড়তে লাগলেন—চোখে জল চলে এলো। সামনের দিকে থেকে সে কাঁধে হাত রাখল, “ওই দিনের ভুল সম্পর্কে কথা ছিল—তুমি মনে করো?”
সে কথা বলল—কতগুলো বছর ছড়িয়ে ছিল ভুলফহমি; কেমন করে এক চিঠি সমস্ত জীবন চালাতে পারে। মীরা আর জো চুপ করে শুনল। শেষে মেয়েটি ধীরে ধীরে বলল, “জো—তুই সেই—তুই আসলে কখনও চলে যেওনি। তুমি যে ফিরে এসেছ, তাতেই আমার কাছে সব ঠিক হয়ে গেছে।” জো কাঁদল; মীরার চোখে অনবদ্য এক উষ্ণতা নেমে এলো—দাদুর জমা কথাগুলো সবকিছু খুলে দিল।
কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ হল না। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মীরার দিকে তাকাল—“তুমি কে? দাদু আমাকে বলতেন—তার মেয়ে যেমনই হোক, সে কাগজ পড়ে রাখে। তুমি তাঁকে ভালো রাখো।” মীরা হেসে বলল, “আমি তাঁর নাতনি; আমি চিঠি পেয়ে সবকিছু জানতে চেয়েছি।” মেয়েটি হেসে বলল, “তাহলে আজও একটি কথা রেখো—জীবন সবসময় ভুল-ভাঙনের উপরে টিকে থাকে; কিন্তু ক্ষমা আর সত্য সেই ভাঙন ঢেকে দেয়।”
রাস্তায় ফিরতে ফিরতে মীরা মাথায় হাত বুলিয়ে ভাবল—একটি ছেঁড়া চিঠি কতখানি পরিবর্তন আনতে পারে! জো হাতে চিরাচরিত চশমা টেনে বলল, “তুমি জানো—আমি কখনোই প্রতিশোধ চাইনি। শুধু বলব—যদি তুমি কখনো প্রশ্ন করো—কেন মানুষ চিঠি রাখে—তাহলে বলো—কারণ আমরা তখনই বড় হতে শিখি।”
মীরা বাড়ি ফিরল—দাদুর আলমারায় চিঠিটা আবার রেখে দিল। আকাশে পলাশ গাছ নীরবে হেসে উঠল। মীরা জানল—এখানে কেবল প্রেমটা ফিরে পাননি; শিখেছি ভালোবাসার এক টুকরো—ক্ষমার শক্তি। সে জানল, লাইব্রেরির জোও এখন আর অচেনা না—সে ছিল ওই চিঠির শব্দে বাঁধা একটি মানুষ—তার নীরব ত্রুটি মেনে নেয়া হয়েছে।
সেই রাতে মীরা এক কাগজে লিখল—“জো, তুমি যখন চিঠি লিখেছিলে, তখনেই তুমি ফিরেছ। ফিরতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু স্মৃতি ফিরে আসে।” কাগজটা আলমারির কাছে রেখে সে জানাল—জীবন ঠিকই চলবে; কেবল কাগজে লেখা কথা মানুষকে ফেরিয়ে আনতে পারে—বিরতি নয়, আবার শুরু।