প্রকৃতির বর্বরতা
– রেজওয়ানুল হক
একদিন হঠাৎ দেখি, আকাশ কালো
সন্ধ্যার আগেই লুটিয়ে পড়ে ভয়,
ঝড়ের শিসে কেঁপে ওঠে দিগন্ত,
পাখির ডানায় ভর করে কান্নার অসীম সুর।
বৃক্ষেরা জড়োসড়ো,
মাটির বুক চিরে ওঠে ক্ষোভের কাঁপন,
প্রকৃতি তখন আর কোমল নয়—
সে এক অভিশপ্ত জ্বালামুখ,
যেখানে গলে যায় সভ্যতার মুখোশ।
এক এক করে ভেঙে পড়ে কুঁড়েঘর,
ভেসে যায় শিশুর পালঙ্ক,
কৃষকের মুঠো মুঠো স্বপ্ন—
মাটির মতোই বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে।
নদীটা, যে একদিন ছিলো মায়ের মতো,
সে-ই এখন মাতাল সাপ,
ডুবে যায় জনপদ, ডুবে যায় ইতিহাস,
ডুবে যায় আমাদের অহংকার।
প্রতিটি বজ্রপাত যেন এক একটি চিৎকার,
একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আকাশের দিকে—
"তোমরা কি ভেবেছিলে আমি চিরকাল নীরব থাকবো?"
"তোমরা কি বুঝোনি, আমি রক্ত নয়—
প্রকৃতি, যার ধৈর্য সীমাহীন,
তবে প্রতিশোধ হলে তা ভয়ংকর!"
শুষ্ক মৌসুমে সূর্য পোড়ায়
যেন আগুনে বাঁশের কঞ্চি,
কৃষকের চোখে জল শুকিয়ে যায়
তৃষ্ণার চেয়ে গভীর এক দহন নিয়ে।
অরণ্যের কোল ছিঁড়ে ফেলে দালানের কঙ্কাল,
নির্বিচারে কাটা গাছের কান্না,
জলে মিশে যায়, বায়ুতে ভাসে—
তবু কে শুনে? কে বোঝে?
আমরা বানিয়েছি রাস্তা,
মাটি চাপা দিয়েছি নদীর হৃদয়,
দিয়েছি কংক্রিটের অলংকার,
কিন্তু সে অলংকার যখন বিষ হয়ে ফিরে আসে
তখন প্রকৃতি বলে না কিছু—
শুধু প্রতিক্রিয়া দেয়।
প্রতিটি দুর্যোগ এক একটি প্রতিবাদপত্র—
ভূমিকম্পের আঘাতে ফাটে ইট,
কিন্তু ফাটে আমাদের বিবেক না!
সাইক্লোনে ভেসে যায় শহর,
কিন্তু আমরা শুধু সংখ্যা গুনে—
“মৃত ৩২, আহত ৭১…”
এবং তারপর, আবারও ব্যস্ত হই বিলবোর্ডে,
নতুন মলের উদ্বোধনে,
পুরনো বন কাটতে কাটতে
নতুন উন্নয়নের গান গাই।
প্রকৃতি কি বর্বর?
নাকি আমরাই সেই বর্বর,
যারা পাখির বাসা চুরি করে বাড়ি বানাই,
যারা সাগরের বুকে তেলের কল বসাই,
জীবন বাঁচাতে নয়—
লোভ বাঁচাতে।
তবু সেই প্রকৃতিই একদিন ফেরত দেয়—
একটি কুঁড়ি, একটি শিশিরবিন্দু,
একটি বসন্তের কোকিল ডাক,
যেখানে টিকে আছে আশা,
যেখানে সুযোগ আছে ক্ষমার।
প্রকৃতির এই বর্বরতা নয় প্রতিহিংসা,
এ যেন মা’র কঠিন শাসন—
যার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে স্নেহের গভীর রঙ।
তাই আজ দাঁড়িয়ে আছি আমরা,
পায়ের নিচে কাঁপা মাটি, মাথার উপর বিপন্ন নীল,
আর বুকের ভেতর একটাই প্রার্থনা—
“প্রকৃতি, ক্ষমা করো,
আমরা শিখবো—
এবার সত্যি শিখবো।”