১. নতুন সকাল
শহরের দক্ষিণ দিকের পুরোনো একটি পাড়ায়, তিনতলার এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে এখন মিশা আর ইশানির নতুন সকাল শুরু হয়।
চায়ের কাপের ধোঁয়ার ভেতর তারা এখনও একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে, যেন প্রতিদিনের সূর্যোদয়ও একটু নতুন।
ইশানি রান্নাঘর থেকে চা এনে রাখে টেবিলে।
মিশা কম্পিউটারে বসে NGO-র রিপোর্ট তৈরি করছে।
— “তুই অফিসের মতো সিরিয়াস মুখ করে বসে আছিস আবার!”
— “কাজটা শেষ না করলে রুবিনা আন্টি আবার খোঁচা দেবে।”
দু’জনেই হেসে ওঠে।
হাসির ভেতর একটা শান্তি আছে, যা হয়তো ঝড় পেরিয়ে আসা মানুষই বোঝে।
ফ্ল্যাটটা ছোট, কিন্তু ভেতরটা উষ্ণ—
দেয়ালে টাঙানো দু’জনের ছবিগুলো, কোণের গাছ, আর টেবিলের ওপর খোলা ডায়েরি—
সব মিলিয়ে যেন একখণ্ড ঘর নয়, একখণ্ড জীবন।
---
২. নিজেদের মতো বাঁচা
ওরা এখন “অরুণোদয়”-এর সঙ্গে জড়িত পূর্ণকালীনভাবে।
LGBTQ সম্প্রদায়ের জন্য প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, ও মানসিক সহায়তা—এই নিয়েই প্রতিদিন কাজ করে।
মিশা লেখালেখি শেখায় ছোটদের।
ইশানি সামলায় সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেশন।
একদিন মিটিংয়ে রুবিনা আন্টি বললেন,
— “তোমরা জানো, তোমাদের মতো একটা জুটি এখন অনেকের অনুপ্রেরণা। মেয়েরা তোমাদের নাম নেয় সাহসের প্রতীক হিসেবে।”
ইশানি নিচু গলায় বলল,
— “আমরা তো শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম…”
রুবিনা আন্টি হাসলেন,
— “যখন কেউ নিজের মতো করে বাঁচে, তখনই সে অন্যদের পথ দেখায়।”
ওদের চোখে তখন একরাশ আলো।
সেই মুহূর্তে দু’জন বুঝল—
ভালোবাসা শুধু অনুভূতির নয়, এটা পরিবর্তনেরও গল্প।
---
৩. বাইরের পৃথিবী
তবুও পৃথিবী পুরোটা বদলায়নি।
রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটলে এখনও কেউ কেউ তাকিয়ে দেখে,
কখনও ফিসফাস, কখনও হাসি।
কিন্তু এখন ওরা থেমে যায় না।
ওরা জানে, যে সমাজ একদিন বিদ্রুপ করেছিল,
আজ সেই সমাজেরই একটা অংশ চুপচাপ তাদের কাজকে সম্মান করছে।
একদিন কলেজের পুরোনো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো।
ও বলল,
— “তোরা অনেক সাহসী রে। আগে ভাবতাম নাটক করছিস, এখন বুঝি জীবনটাই তোর মঞ্চ।”
মিশা মৃদু হেসে বলল,
— “জীবনটা নাটক নয়, বরং শেখার স্কুল।”
---
৪. ছোট সুখ
একদিন সন্ধ্যায় ছাদে বসে দু’জন চুপ করে আকাশ দেখছিল।
বৃষ্টি নামার আগের হাওয়া, দূরে আলো জ্বলা জানালা, আর এক পেয়ালা কফি।
ইশানি বলল,
— “জানিস, আগে ভাবতাম ভালোবাসা মানেই শুধু একে অপরকে পাওয়া। এখন মনে হয়, একসাথে বাঁচার জায়গা তৈরি করাটাই ভালোবাসা।”
মিশা চুপ করে বলল,
— “আমরা সেটা করেছি, নিজের হাতে। ছোট হোক, এই আমাদের পৃথিবী।”
দু’জনের হাত একসাথে মিশে গেল।
কোনও নাটকীয়তা নেই, শুধু বাস্তবের উষ্ণতা।
---
৫. কঠিন দিন
একদিন NGO-র ফান্ড কমে গেল।
চাকরি চলে যাওয়ার ভয়, ভাড়ার টান, আর দায়িত্বের চাপ—সব একসাথে নেমে এল।
ইশানি বলল,
— “সবকিছু কি হারিয়ে যাবে আবার?”
মিশা বলল,
— “না, আমরা তো একবার হারিয়েও উঠে দাঁড়িয়েছি। আবার পারব।”
ওরা রাতে দেরি পর্যন্ত প্ল্যান করল—
অনলাইন ফান্ডরেইজার, আর্ট ওয়ার্কশপ, আর তাদের গল্প নিয়ে একটি awareness short film।
কিছু সপ্তাহ পর ফান্ড এলো, কাজ শুরু হলো আবার।
জীবন যেন শেখাচ্ছিল—
কষ্ট মানে শেষ নয়, কেবল অন্য পথে এগোনো।
---
৬. সমাজের বদল
একদিন স্থানীয় স্কুলে ওদের আমন্ত্রণ জানানো হলো “Gender Awareness” প্রোগ্রামে কথা বলতে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইশানি বলল—
> “ভালোবাসা মানে শুধু সম্পর্ক নয়,
এটা এমন এক জায়গা, যেখানে মানুষ নিজের মতো হতে পারে।
আমরা চাই, কেউ যেন নিজের ভয়কে লুকিয়ে না রাখে।”
ছাত্রছাত্রীদের চোখে বিস্ময়, পরে করতালি।
এক শিক্ষক এসে বললেন,
— “আমার মেয়ে তোমাদের ভিডিও দেখে সাহস পেয়েছে নিজের কথা বলতে।”
সেই রাতে মিশা বলল,
— “আমরা হয়তো অনেক ছোট কিছু করছি, কিন্তু মনে হয় এই পৃথিবীটা একটু একটু বদলাচ্ছে।”
ইশানি হেসে বলল,
— “হয়তো এটাই ‘অচেনা আলো’। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে।”
---
৭. স্বপ্নের ঘর
এক বছর পর তারা নিজেদের ছোট্ট NGO খুলল—
নাম রাখল “আলোর ঠিকানা”।
এখানে তারা শুধু LGBTQ না, প্রত্যেক সেই মানুষকেও জায়গা দেয়
যে ভয় পায় নিজের সত্যিটা প্রকাশ করতে।
রুবিনা আন্টি এসে বললেন,
— “তোমরা এখন অন্যদের জন্য আলোর দরজা খুলে দিলে।”
মিশা বলল,
— “তুমি তো আমাদের শিখিয়েছিলে, আলো শুধু নিজের জন্য না।”
প্রতিদিন সকালে অফিস খোলার আগে ওরা দু’জন এক মিনিট চুপ করে দাঁড়ায়—
না কোনও প্রার্থনা, না কোনও কথা, শুধু নীরব কৃতজ্ঞতা।
---
৮. আত্মবিশ্বাসের আলো
এক সন্ধ্যায় তারা পুরোনো নদীর ঘাটে গেল।
যে জায়গা থেকে একদিন তাদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল,
যে ছবি নিয়ে এত ঝড় উঠেছিল।
আজ সেখানে বসে ওরা দু’জন চুপচাপ জল দেখছে।
সূর্যাস্তের আলো পড়ে আছে নদীর ওপর, যেন অতীত আর বর্তমান মিলেমিশে গেছে।
মিশা বলল,
— “দেখো, এই জায়গাটা একসময় ভয় দিত।”
ইশানি বলল,
— “এখন মনে হয়, এখান থেকেই আমাদের জন্ম হয়েছিল।”
তারা ছবি তুলল আবার—
কিন্তু এবার পোস্টের ক্যাপশন লিখল,
> “ভালোবাসার পরও জীবন আছে—আর সেই জীবনটাই আমাদের পৃথিবী।”
---
৯. শেষ সংলাপ
রাতে বাড়ি ফিরে ইশানি মিশার কাঁধে মাথা রাখল।
মিশা বলল,
— “আমরা কি ঠিক করছি সবকিছু?”
ইশানি হেসে বলল,
— “জীবন ঠিক না ভুল নয়, শুধু চলা।
আমরা নিজের মতো করে চলছি, সেটাই যথেষ্ট।”
বাইরে তখন বৃষ্টি নামছে,
জানলার কাঁচে আলো পড়ে একটা মৃদু ছায়া তৈরি করছে—
দু’জনের মুখে সেই আলো পড়ে যেন অচেনা কোনও শান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
---
> ভালোবাসা একদিন হয়তো ক্ষণিকের আগুন ছিল,
কিন্তু আজ তা রূপ নিয়েছে আলোয়—
এমন এক আলো,
যেটা শুধু ওদের নয়,
পুরো পৃথিবীর জন্য।