Story of Mahabharat Part 51 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 51

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 51

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৫১

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত উদ্দালক, শ্বেতকেতু, কহোড়, অষ্টাবক্র ও বন্দীর কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত উদ্দালক, শ্বেতকেতু, কহোড়, অষ্টাবক্র ও বন্দীর কাহিনি

রাজা উশীনরের যজ্ঞস্থল দর্শন করাবার পর আরও বহু পথ অতিক্রম কোরে এক জায়গায় এসে মহর্ষি লোমশ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই দেখ উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতুর আশ্রম। ত্রেতাযুগে অষ্টাবক্র ও তাঁর মামা শ্বেতকেতু শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা জনক রাজার যজ্ঞে গিয়ে বরুণপুত্র বন্দীকে বিতর্কে পরাস্ত করেছিলেন।

উদ্দালক ঋষি তাঁর শিষ্য কহোড়ের সঙ্গে নিজের কন্যা সুজাতার বিবাহ দেন। সুজাতা গর্ভবতী হলে গর্ভস্থ শিশু বেদপাঠরত কহোড়কে বললেন, পিতা, আপনার নিয়মিত শাস্ত্রপাঠের জন্য আমি মাতৃগর্ভে থেকেই সর্ব শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, আপনার বেদপাঠ ভুল হচ্ছে। মহর্ষি কহোড় ক্রুদ্ধ হয়ে গর্ভস্থ শিশুকে শাপ দিলেন - তোর দেহের আট স্থান বক্র হবে। কহোড়ের শাপের ফলে এই পুত্রের দেহের আট স্থান বক্র হওয়ায় তিনি অষ্টাবক্র নামে খ্যাত হন। অষ্টাবক্র আর তার মামা শ্বেতকেতু সমবয়স্ক ছিলেন।

অষ্টাবক্র যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন এক দিন সুজাতা তার পতিকে বললেন, আমি নিঃস্ব, আমাকে অর্থসাহায্য করে এমন কেউ নেই, কি করে সন্তানকে পালন করবো? স্ত্রীর কথা শুনে কহোড় ধনের জন্য জনক রাজার কাছে গেলেন, সেখানে তর্ককুশল বন্দী তাকে তর্কে পরাস্ত করে জলে ডুবিয়ে দিলেন। এই সংবাদ পেয়ে উদ্দালক তার কন্যা সুজাতাকে বললেন, এই ঘটনা গর্ভস্থ শিশু যেন জানতে না পারে। জন্মগ্রহণ করে অষ্টাবক্র তাঁর পিতার বিষয় কিছুই জানলেন না, তিনি উদ্দালককে পিতা এবং শ্বেতকেতুকে ভাই মনে করতে লাগলেন। বারো বছর বয়সে একদিন অষ্টাবক্র তার মাতামহের কোলে বসে আছেন এমন সময় শ্বেতকেতু তার হাত ধরে টেনে বললেন, এ তোমার পিতা নয়। অষ্টাবক্র দুঃখিত হয়ে তাঁর মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পিতা কোথায়? তখন সুজাতা তাকে পূর্ব ঘটনা বললেন।

অষ্টাবক্র তাঁর মামা শ্বেতকেতুকে বললেন, চলো, আমরা জনক রাজার যজ্ঞে যাই, সেখানে ব্রাহ্মণদের বিতর্ক শুনব, উত্তম অন্নও ভোজন করব। মামা ও ভাগ্নে যজ্ঞসভার নিকটে এলে দ্বারপাল বাধা দিয়ে বললো, আমরা বন্দীর আজ্ঞাধীন, এই সভায় বালকরা আসতে পারে না, কেবল বিদ্বান বৃদ্ধ ব্রাহ্মণরাই আসতে পারেন। অষ্টাবক্র বললেন, আমরা ব্রতচারী, বেদজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানশাস্ত্রে পারদর্শী, অতএব আমরা বৃদ্ধের সমতুল্য। দ্বারপাল পরীক্ষা করবার জন্য কতকগুলি প্রশ্ন করায় অষ্টাবক্র তার যথাযথ উত্তর দিয়ে জনক রাজাকে সম্বোধন করে বললেন, মহারাজ, শুনেছি বন্দীর সঙ্গে বিতর্কে যাঁরা হেরে যান আপনার আদেশে তাদের জলে ডোবানো হয়। কোথায় সেই বন্দী? আমি তাকে পরাস্ত করব। জনক বললেন, বৎস, তুমি না জেনেই বন্দীকে জয় করতে চাচ্ছ, জ্ঞানগর্বিত অনেক পণ্ডিত তার সঙ্গে বিচার করতে এসে পরাস্ত হয়েছেন। অষ্টাবক্র বললেন, বন্দী আমার তুল্য প্রতিপক্ষ পাননি তাই বিচারসভায় সিংহের মতো আস্ফালন করেন। আমার সঙ্গে বিতর্কে তিনি পরাস্ত হয়ে যাবেন।

তখন রাজা জনক অষ্টাবক্রকে বিবিধ কঠিন প্রশ্ন করলেন এবং তার সদুত্তর পেয়ে বললেন, দেবতুল্য বালক, বাকপটুতায় তোমার সমান কেউ নেই, তুমি বালক নও, তুমি বৃদ্ধ। তোমাকে আমি দ্বার ছেড়ে দিচ্ছি। অষ্টাবক্র সভায় প্রবেশ করে বন্দীর সঙ্গে শাস্ত্র বিচার শুরু করলেন। অনেক প্রশ্ন উত্তর ও প্রত্যুত্তরের পর বন্দী মুখ নীচু কোরে নীরব হলেন। সভায় মহা কোলাহল উঠল, ব্রাহ্মণগণ হাতজোড় কোরে সসম্মানে অষ্টাবক্রের কাছে এলেন। অষ্টাবক্র বললেন, এই বন্দী ব্রাহ্মণদের জয় করে জলে ডুবিয়েছিলেন, এখন এঁকেই আপনারা জলে ডুবিয়ে দিন। বন্দী বললেন, আমি বরুণের পুত্র, জনক রাজার এই যজ্ঞের সময়ে বরুণও এক যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন, আমি ব্রাহ্মণদের জলে ডুবিয়ে করে সেই যজ্ঞ দেখতে পাঠিয়েছি, তারা এখন ফিরে আসছেন। আমি অষ্টাবক্রকে সম্মান করছি, তার জন্যই আমি জলে ডুবে পিতার সঙ্গে মিলিত হব। অষ্টাবক্রও তাঁর পিতা কহোড়কে এখনই দেখতে পাবেন।

তারপর কহোড় ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ বরুণের নিকট থেকে জনকের সভায় ফিরে এলেন। কহোড় বললেন, মহারাজ, এই জন্যই লোকে পুত্রকামনা করে, আমি যা করতে পারি নি আমার পুত্র তা করেছে। তার পর বন্দী সমুদ্রে প্রবেশ করলেন, পিতা ও মামার সঙ্গে অষ্টাবক্রও উদ্দালকের আশ্রমে ফিরে এলেন। কহোড় তার পুত্রকে বললেন, তুমি শীঘ্র এই নদীতে প্রবেশ করো। পিতার আদেশ পালন করে অষ্টাবক্র নদী থেকে সুন্দর অবক্ৰ অঙ্গ প্রাপ্ত হয়ে উঠে এলেন। সেই কারণে এই নদী সমঙ্গা নামে খ্যাত।

______________

(ক্রমশ)