Storey of Mahabharat Part 9 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 9

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 9

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯

দেবযানী, শর্মিষ্ঠা ও রাজা যযাতির কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

দেবযানী, শর্মিষ্ঠা ও রাজা যযাতির কাহিনি

রাজা জনমেজয়ের অনুরোধে বৈশম্পায়ন কুরু বংশের পূর্বপুরুষ যযাতির কাহিনি বললেন। শুক্রাচার্য্যের কাছ থেকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে কচ স্বর্গে ফিরে এলে তাঁর কাছ থেকে দেবতারা আনন্দিত হয়ে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখলেন। তার পর দেরাজ ইন্দ্র অসুরগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেন।

একদিন এক সুন্দর জলাশয়ে অনেকগুলি কন্যা জলকেলি করছে দেখে ইন্দ্র বায়ুর রূপ ধরে তাদের বস্ত্রগুলি মিশিয়ে দিলেন। সেই কন্যাদের মধ্যে অসুরপতি বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা ছিলেন। জলাশয় থেকে উঠে, শর্মিষ্ঠা ভুল কোরে দেবযানীর বস্ত্র পরলেন। তা দেখে দেবযানী বললেন, অসুরী, আমার শিষ্যা হয়ে তুই আমার কাপড় পরেছিস কেন? তুই সদাচারহীনা, তোর ভাল হবে না। শর্মিষ্ঠা রেগে গিয়ে দেবযানীকে বললেন, তোর পিতা বিনীত হয়ে আমার পিতার সামনে নীচে বসে থাকে। তুই যতই বিবাদ কর বা রাগ দেখা, তোর অস্ত্র নেই আমার অস্ত্র আছে। তুই ভিখারিনী তাই ক্ষোভ করছিস। আমি তোকে গ্রাহ্য করি না, ঝগড়া করতে চাইলে তুই নিজের সমকক্ষ কারো সঙ্গে কর। তখন দেবযানী নিজের বস্ত্র নেবার জন্য টানতে লাগলে শর্মিষ্ঠা ক্রোধে অধীর হয়ে তাকে এক কূপের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিলেন এবং মরে গেছে মনে করে নিজের ভবনে চ’লে গেলেন।

সেই সময়ে মৃগয়ায় শ্রান্ত ও পিপাসিত হয়ে রাজা যযাতি অশ্বারোহণে সেই কূপের কাছে এলেন। তিনি দেখলেন, কূপের মধ্যে অগ্নিশিখার ন্যায় রূপবতী এক কন্যা রয়েছে। রাজা তাকে আশ্বস্ত করলে দেবযানী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাকে সদ্কুলোদ্ভব শান্ত বীর্যবান পুরুষ বলে মনে হচ্ছে। আপনি আমার ডান হাত ধরে আপনি আমাকে কূপ থেকে উপরে তুলুন। দেবযানীর অনুরোধে যযাতি দেবযানীকে উদ্ধার করে রাজধানীতে চলে গেলেন।

দেবযানীর দাসীর মুখে সংবাদ পেয়ে শুক্র তখনই কূপের কাছে এলেন। তিনি কন্যাকে আলিঙ্গন করে বললেন, বোধ হয় তোমার কোনও পাপ ছিল তারই এই প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। দেবযানী বললেন, প্রায়শ্চিত্ত হোক বা না হোক, শর্মিষ্ঠা আমাকে কি বলেছে শুনুন। শর্মিষ্ঠা আমাকে বলেছে - তুই স্তুতিকারী যাচকের কন্যা, আর তোর পিতা যাঁর স্তুতি করেন আমি সেই দাতার কন্যা। পিতা, শর্মিষ্ঠার কথা যদি সত্য হয় তবে তার কাছে নতি স্বীকার করব এই কথা তার সখীকে আমি বলেছি। শুক্র বললেন, তুমি স্তাবক আর যাচকের কন্যা নও, তুমি যাঁর কন্যা তাকেই সকলে স্তব করে আর এই কথা বৃষপর্বা, ইন্দ্র আর রাজা যযাতি জানেন। যিনি সজ্জন তার পক্ষে নিজের গুণবর্ণনা উচিত নয়, সেইজন্য আমি কিছু বলতে চাই না। কন্যা, ওঠ তাকে ক্ষমা করে নিজের গৃহে যাই, সাধুজনের ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ গুণ। ক্ষমার দ্বারা ক্রোধকে যে নিরস্ত করতে পারে সে সারা জগৎ জয় করে। দেবযানী বললেন, পিতা, আমি ও সব কথা জানি, কিন্তু পণ্ডিতরা বলেন নীচ লোকের কাছে অপমানিত হওয়ার চেয়ে মরণ ভাল। অস্ত্রাঘাতে যে ক্ষত হয় তা সারে কিন্তু বাক্যের ক্ষত সারে না।

তখন শুক্র ক্রুদ্ধ হয়ে দানবরাজ বৃষপর্বার কাছে গিয়ে বললেন, রাজা, পাপের ফল সদ্য দেখা যায় না, কিন্তু যে বার বার পাপ করে সে সমূলে বিনষ্ট হয়। আমার নিস্পাপ ধর্মজ্ঞ শিষ্য কচকে তুমি বধ করিয়েছিলে, তোমার কন্যা আমার কন্যাকে বহু কটু কথা বলে কূপে ফেলে দিয়েছ। তোমার রাজ্যে আমরা আর বাস করব না। বৃষপর্বা বললেন, যদি আমার প্ররোচনায় কচ নিহত হয়ে থাকে। বা দেবযানীকে শর্মিষ্ঠা কটু কথা বলে থাকে, তবে আমার যেন অসদ্গতি হয়। আপনি প্রসন্ন হন। আপনি যদি চ’লে যান তবে আমরা সমুদ্রে প্রবেশ করব। শুক্র বললেন, দেবযানী আমার অত্যন্ত প্রিয়, তার দুঃখ আমি সইতে পারি না। তোমরা তাকে প্রসন্ন কর।

বৃষপর্বা সবান্ধবে দেবযানীর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে পড়ে বললেন, দেবযানী প্রসন্ন হও, তুমি যা চাইবে তাই দেব। দেবযানী বললেন, সহস্র কন্যার সহিত শর্মিষ্ঠা আমার দাসী হোক, পিতা আমার বিবাহ দিলে তারা আমার সঙ্গে যাবে। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের রোষ নিবারণের জন্য শর্মিষ্ঠা দাসীত্ব স্বীকার করলেন।

দীর্ঘকাল পরে একদিন দেবযানী শর্মিষ্ঠা ও সহস্র দাসীর সঙ্গে বনে বিচরণ করছিলেন এমন সময় রাজা যযাতি হরিণের খোঁজে পিপাসিত ও শ্রান্ত হোয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন, রত্নভূষিত দিব্য আসনে সুহাসিনী দেবযানী বসে আছেন, রূপে অতুলনীয়া স্বর্ণালংকারে ভূষিতা আর একটি কন্যা নিচের আসনে বসে দেবযানীর পদসেবা করছেন। যযাতির প্রশ্নের উত্তরে দেবযানী নিজেদের পরিচয় দিলেন। যযাতি বললেন, অসুর রাজকন্যা কি করে আপনার দাসী হলেন জানতে আমার কৌতুহল হচ্ছে, এমন সর্বাঙ্গসুন্দরী আমি পূর্বে কখনও দেখি নি। আপনার রূপ এঁর রূপের তুল্য নয়। দেবযানী উত্তর দিলেন, সবই দৈবের বিধানে ঘটে, এঁর দাসীত্বও সেই কারণে হয়েছে। আকার বেশ ও কথাবার্তায় আপনাকে রাজা বোধ হচ্ছে, আপনি কে? যযাতি বললেন, আমি রাজা যযাতি, শিকারে এসেছিলাম, এখন অনুমতি দিন ফিরে যাব।

দেবযানী বললেন, শর্মিষ্ঠা আর এই সমস্ত দাসীর সঙ্গে আমি আপনার অধীন হচ্ছি, আপনি আমার পতি হন। যযাতি বললেন, সুন্দরী, আমি আপনার যোগ্য নই, আপনার পিতা ক্ষত্রিয় রাজাকে কন্যাদান করবেন না। দেবযানী বললেন, ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় পরস্পরের সংসৃষ্ট, আপনি পূর্বেই আমার পাণিগ্রহণ করেছেন, আমিও আপনাকে বরণ করেছি। দেবযানী তখন তার পিতাকে ডেকে এনে বললেন, পিতা, এই রাজা যযাতি আমার পাণি গ্রহণ করে কুপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আপনাকে প্রণাম করছি, এঁর হাতে আমাকে সম্প্রদান করুন, আমি অন্য পতি বরণ করব না।

শুক্র বললেন, প্রণয় ধর্মের অপেক্ষা রাখে না তাই তুমি যযাতিকে বরণ করেছ। কচের শাপে তোমার স্ববর্ণে বিবাহও হোতে পারে না। যযাতি, তোমাকে এই কন্যা দান করলাম, এঁকে তোমার পত্নীরূপে গ্রহণ কর। আমার বরে তোমার বর্ণসংকরজনিত পাপ হবে না। বৃষপর্বার কন্যা এই কুমারী শর্মিষ্ঠাকে তুমি সসম্মানে রেখো, কিন্তু এঁকে শয্যায় ডেকো না।

দেবযানী শর্মিষ্ঠা আর দাসীদের নিয়ে যযাতি তার রাজধানীতে গেলেন। দেবযানীর অনুমতি নিয়ে তিনি অশোক বনের নিকট শর্মিষ্ঠার জন্য পৃথক গৃহ নির্মাণ কোরে দিলেন এবং তার অন্নবস্ত্রাদির উপযুক্ত ব্যবস্থা করলেন। সহস্র দাসীও শর্মিষ্ঠার কাছে রইল।

কিছুকাল পরে দেবযানীর একটি পুত্র হোলো। শর্মিষ্ঠা ভাবলেন আমার পতি নেই, বৃথা যৌবনবতী হয়েছি; আমিও দেবযানীর ন্যায় নিজেই পতি বরণ করব। একদা যযাতি বেড়াতে বেড়াতে অশোক বনে এসে পড়লেন। শর্মিষ্ঠা তাকে সংবর্ধনা করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আমার রূপ কুল শীল আপনি জানেন, আমি প্রার্থনা করছি আমাকে বিবাহ করুন। যযাতি বললেন, তুমি সর্ব বিষয়ে অনিন্দিতা তা আমি জানি, কিন্তু তোমাকে শয্যায় আহ্বান করতে শুক্রাচার্যের নিষেধ আছে। শর্মিষ্ঠা বললেন, মহারাজ, পরিহাস, স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জন, বিবাহকাল, প্রাণসংশয় এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনা, এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না।

যযাতি বললেন, আমি রাজা হয়ে যদি মিথ্যাচরণ করি তবে প্রজারাও আমার অনুসরণ করে মিথ্যাকথনের পাপে বিনষ্ট হবে। শর্মিষ্ঠা বললেন, যিনি সখীর পতি তিনি নিজের পতির তুল্য, দেবযানীকে বিবাহ করে আপনি আমারও পতি হয়েছেন। পুত্রহীনার পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আপনার দ্বারা পুত্রবতী হয়ে আমি ধর্মাচরণ করতে চাই।

যযাতি শুক্রাচার্যের সেই নিষেধ না মেনে গোপনে শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে করেন। দেবযানীর গর্ভে যযাতির দুই পুত্র – যদু ও তুর্বসু এবং শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পুত্র – দ্রুহ্যু অনু ও পুরু জন্মগ্রহণ করে। শর্মিষ্ঠার গোপন বিবাহের কথা দেবযানী জানতে পারার পর শুক্রাচার্যের অভিশাপে যযাতি অকালে জরাগ্রস্থ হন। পরে যযাতি শাপ প্রত্যাহারের জন্য শুক্রকে অনেক অনুনয় করায় শুক্র বললেন যে, যযাতি ইচ্ছে করলে নিজের জরা অন্যকে দিতে পারবেন।

যযাতি স্থির করলেন তাঁর যে পুত্র যযাতির জরা নিযে যযাতিকে তাঁর যৌবন দান করবেন, তাকেই তিনি রাজ্য দেবেন। চার পুত্রের মধ্যে শুধু কনিষ্ঠ পুত্র পুরু যযাতির জরা নিতে রাজি হলেন। পুরুকে জরা দিয়ে যযাতি বহু বছর ধরে বিষয় ভোগ, প্রজাপালন, ধর্ম-কর্ম করলেন, তারপর পুরুকে রাজত্ব দিয়ে বনবাসে গেলেন। সেখান থেকে কিছুকাল পরে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে থাকাকালীন আত্মপ্রসংসা করার জন্য ইন্দ্রের আজ্ঞায় তিনি স্বর্গচ্যূত হন। তবে, যযাতি ভূতলে না পরে কিছুকাল অন্তরীক্ষে অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমান ও শিবি – এই চারজন রাজর্ষির সঙ্গে বিবিধ ধর্মালাপ করেন। এঁরা সকলেই ছিলেন যযাতির কন্যা মাধবীর পুত্র। ধর্মালোচনা কালে মাধবী ও গালব মুনি এসে ওঁর সঙ্গে যোগ দেন। ওঁরা সকলে নিজেদের তপস্যার কিছু অংশ যযাতিকে দান করায় তিনি আবার স্বর্গে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।

______________

(ক্রমশ)