মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১১৫
যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে ভীমের জয়ের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে ভীমের জয়ের কাহিনি
যুদ্ধের ষষ্ঠ দিন নিজ নিজ সৈন্যদেরকে ধৃষ্টদ্যুম্ন মকর ব্যূহ এবং ভীষ্ম ক্রৌঞ্চ ব্যূহ নির্মাণ কোরে সাজালেন। ভীষ্ম ও দ্রোণের সঙ্গে ভীম ও অর্জুনের ঘোর যুদ্ধ হতে লাগল, তাঁদের বাণ বর্ষণে আহত হয়ে দুই পক্ষের অসংখ্য সেনা পালিয়ে গেল।
যুদ্ধের বিবরণ শুনতে শুনতে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, সঞ্জয়, আমার সৈন্যগণ বহুগুণসম্পন্ন, তারা বৃদ্ধ বা বালক নয়, রোগা বা মোটা নয়, তারা ক্ষিপ্র দীর্ঘকায় সবল ও নীরোগ। তারা সর্বপ্রকার অস্ত্রপ্রয়োগে শিক্ষিত এবং হাতি ঘোড়া ও রথ চালনায় নিপুণ। সবাইকে পরীক্ষা করে উপযুক্ত বেতন দিয়ে তাদের নিযুক্ত করা হয়েছে, কারও অনুরোধে তাদেরকে নেওয়া হয়নি। সেনাপতি হিসাবে অভিজ্ঞ বিখ্যাত মহারথগণ তাদের নেতা, তথাপি যুদ্ধের বিপরীত ফল দেখা যাচ্ছে। হয়তো দেবতারাই পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধে নেমে আমার সৈন্য সংহার করছেন। বিদুর সর্বদাই হিতবাক্য বলেছেন, কিন্তু আমার মূর্খ পুত্র তা শোনেনি। বিধাতা যা নির্দিষ্ট করেছেন তার অন্যথা হবে না।
সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আপনার দোষেই পাশা খেলা হয়েছিল, তার ফল এই যুদ্ধ। আপনি এখন নিজ কর্মের ফল ভোগ করছেন। তার পর সঞ্জয় পুনর্বার যুদ্ধের বিবরণ বলতে লাগলেন।
ভীম রথ থেকে নেমে তাঁর সারথিকে অপেক্ষা করতে বললেন এবং কৌরবসেনার মধ্যে প্রবেশ কোরে গদার আঘাতে হাতি, ঘোড়া, রথী ও পদাতিক সৈন্য বিনষ্ট করতে লাগলেন। ভীমের শূন্য রথ দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন উদবিগ্ন হয়ে ভীমের কাছে গেলেন এবং তার দেহে বিদ্ধ সমস্ত বাণ তুলে ফেলে তাঁকে আলিঙ্গন করে নিজের রথে উঠিয়ে নিলেন। দুর্যোধন ও তাঁর ভাইয়েরা ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করলে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রমোহন অস্ত্র প্রয়োগ করলেন, তাতে দুর্যোধনাদি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। এই অবকাশে ভীম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ও জলপান করে সুস্থ হলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে সঙ্গে নিয়ে আবার যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনাদির অবস্থা দেখে দ্রোণাচার্য সত্বর এসে প্রজ্ঞাস্ত্র দিয়ে প্রমোহন অস্ত্রের প্রভাব নষ্ট করলেন।
যুধিষ্ঠিরের আদেশে অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও ধৃষ্টকেতু সসৈন্যে ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে সাহায্য করতে এলেন এবং সূচীমুখ ব্যূহ রচনা করে কুরুসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করলেন। তখন দ্রোণ ও দুর্যোধনাদির সঙ্গে ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রবল যুদ্ধ হতে লাগল।
ক্রমশ বিকাল হোলো, সূর্যের বর্ণ লাল হোলো। ভীম দুর্যোধনকে বললেন, বহু বছর যে কামনা করেছি সেই সময় এখন এসেছে, যদি যুদ্ধ থেকে নিরস্ত না হও তো আজ তোমাকে বধ করবো, মা কুন্তী ও দ্রৌপদীর সকল কষ্ট এবং বনবাসের কষ্টের প্রতিশোধ নেব। আজ তোমাকে সবান্ধবে বধ কোরে তোমার সমস্ত পাপের শাস্তি দেবো। ভীমের বাণের আঘাতে দুর্যোধনের ধনু ছিন্ন হোলো, সারথি আহত হোলো এবং রথের চার ঘোড়া নিহত হোলো। দুর্যোধন বাণবিদ্ধ হয়ে মূৰ্ছিত হলে কৃপাচার্য তাকে নিজের রথে উঠিয়ে নিলেন।
অভিমন্যু এবং দ্ৰৌপদীর চার পুত্র শ্রুতকর্মা, সুতসোম, শ্রুতসেন ও শতানীকের বাণের আঘাতে দুর্যোধনের চার ভাই বিকর্ণ, দুর্মুখ, জয়ৎসেন ও দুষ্কর্ণ ভূপতিত হোলো। সূর্যাস্তের পরেও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধ বিরতি ঘোষিত হলে কৌরব ও পাণ্ডবগণ নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গেলেন।
______________
(ক্রমশ)