মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১১৪
যুদ্ধের চতুর্থ দিনে ঘটোৎকচের জয় ও পঞ্চম দিনে সাত্যকিপুত্রদের মৃত্যুর কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
যুদ্ধের চতুর্থ দিনে ঘটোৎকচের জয় ও পঞ্চম দিনে সাত্যকিপুত্রদের মৃত্যুর কাহিনি
চতুর্থ দিনের যুদ্ধের সকালে ভীষ্ম সসৈন্যে মহাবেগে অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, শল্য, শল্যপুত্র ও চিত্রসেনের সঙ্গে অভিমন্যুর যুদ্ধ হতে লাগল। ধৃষ্টদ্যুম্ন গদাঘাতে শল্যপুত্রের মস্তক চূর্ণ করলেন। শল্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ধুষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করলেন, দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ প্রভৃতি শল্যের রথ রক্ষা করতে লাগলেন। ভীমকে আসতে দেখে তাকে বাধা দেবার জন্য দুর্যোধন দশ হাজার গজাতিক সৈন্য পাঠালেন। ভীম সেই হাতির দল গদাঘাতে বিনষ্ট কোরে রণস্থলে মহাদেবের মতো নাচতে থাকলেন।
সেনাপতি, জলসন্ধ, সুষেণ, বীরবাহু, ভীম, ভীমরথ, সুলোচন প্রভৃতি দুর্যোধনের চোদ্দ জন ভাই ভীমকে আক্রমণ করলে, ক্ষিপ্ত ভীম সেনাপতির শিরচ্ছেদ করলেন, জলসন্ধের বুক চিরে ফেললেন এবং সুষেণ, বীরবাহু, ভীম, ভীমরথ ও সুলোচনকে যমালয়ে পাঠালেন। দুর্যোধনের অন্য ভাইয়েরা ভয়ে পালিয়ে গেলেন। তখন ভীষ্মের আদেশে ভগদত্ত এক বৃহৎ হাতিতে চড়ে ভীমকে দমন করতে এলেন। ভগদত্তের বাণের আঘাতে ভীম মূৰ্ছিত হয়ে রথের পতাকার দণ্ড ধরে রইলেন। পিতা ভীমের এই অবস্থা দেখে ঘটোৎকচ তখনই অদৃশ্য হলেন এবং মায়াবলে ভয়ানক মূর্তি ধারণ করে ঐরাবতে চড়ে দেখা দিলেন। তাঁর অনুচর রাক্ষসগণ অঞ্জন যামন ও মহাপুণ্ডরীক নামক বিশাল হাতিতে চড়ে উপস্থিত হোলো। এইসকল হাতিরা চারদিক থেকে ভগদত্তের হাতিকে আক্রমণ করলে ভগদত্তের হাতি আর্তনাদ করে পালাতে লাগল।
ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন প্রভৃতি ভগদত্তকে রক্ষা করবার জন্য দ্রুতবেগে এলেন, যুধিষ্ঠিরাদিও ঘটোৎকচের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। সেই সময়ে ঘটোৎকচ বজ্রের আওয়াজের মতো গর্জন করলেন। ভীষ্ম বললেন, দূরাত্মা হিড়িম্বাপুত্রের সঙ্গে এখন আমি যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না, ও এখন বলবীর্য ও সহায় সম্পন্ন। আমাদের বাহন এখন ক্লান্ত হয়েছে, আমরাও ক্ষতবিক্ষত হয়েছি, সূর্যও অস্তে যাচ্ছেন, অতএব এখন যুদ্ধের বিরাম হোক।
রাত্রে দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, আপনি এবং দ্ৰোণ, শল্য, কৃপ, অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা, ভগদত্ত প্রভৃতি সকলেই মহারথ, আপনারা এই যুদ্ধে দেহত্যাগে প্রস্তুত এবং ত্রিলোকজয়েও সমর্থ। তথাপি পাণ্ডবরা আমাদের জয় করছে কেন?
ভীষ্ম বললেন, রাজা, এ বিষয়ে তোমাকে আমি বহুবার বলেছি, কিন্তু তুমি আমার কথা শোননি। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করো, তাতে তোমার ও জগতের মঙ্গল হবে। তুমি পাণ্ডবদের অবজ্ঞা করতে, তার ফল এখন পাচ্ছ। কৃষ্ণ যাঁদের রক্ষা করেন সেই পাণ্ডবদের জয় করতে পারে এমন কেউ অতীতকালে ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। আমি এবং বেদজ্ঞ মুনিরা পূর্বেই তোমাকে বারণ করেছিলাম যে কৃষ্ণের সঙ্গে বিরোধ করো না, পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করো না, কিন্তু তুমি মোহবশে এ কথা গ্রাহ্য করনি। আমার মনে হয় তুমি মোহগ্রস্ত রাক্ষস। পাণ্ডবগণ কৃষ্ণের সাহায্য ও আত্মীয়তায় রক্ষিত, সেজন্য তারা জয়ী হবেই।
যুদ্ধের পঞ্চমদিন সকালে ভীষ্ম মকর ব্যূহ এবং পাণ্ডবগণ শ্যেন ব্যূহ রচনা করলেন। দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হতে লাগল। আগের দিন কৌরবপক্ষের সৈন্যক্ষয় এবং ভাইদের মৃত্যু স্মরণ কোরে দুর্যোধন দ্রোণকে বললেন, আচার্য, আপনি সর্বদা আমার হিতকামী, আপনার ও পিতামহ ভীষ্মের সাহায্যে আমরা দেবগণকেও জয় করতে পারি, হীনবল পাণ্ডবরা তো দূরের কথা। আপনি এমন চেষ্টা করুন যাতে পাণ্ডবদের মৃত্যু হয়। দ্রোণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তুমি নির্বোধ তাই পাণ্ডবদের পরাক্রম জান না। তাদের জয় করা অসম্ভব, তথাপি আমি যথাশক্তি চেষ্টা করবো।
ভীষ্ম তুমুল যুদ্ধ করতে লাগলেন। ভীষ্মের সাথে অর্জুন, দুর্যোধনের সাথে ভীম, শল্যের সাথে যুধিষ্ঠির এবং দ্ৰোণ ও অশ্বত্থামার সাথ সাত্যকি, চেকিতান ও দ্রুপদ যুদ্ধ করতে লাগলেন। আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি হলে যেমন শব্দ হয়, তীক্ষ্ম বাণে ছিন্ন নরমুণ্ডের পতনে সেইরূপ শব্দ হতে লাগল। সাত্যকির মহাবল দশ পুত্র ভূরিশ্রবাকে বেষ্টন করে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। ভূরিশ্রবা ভল্লের আঘাতে দশ জনেরই শিরচ্ছেদ করলেন।
পুত্রদের নিহত দেখে সাত্যকি ভূরিশ্রবাকে আক্রমণ করলেন। দুজনেরই রথ ও ঘোড়া বিনষ্ট হোলে তারা খড়্গ ও ঢাল নিয়ে পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। তখন ভীম সাত্যকিকে এবং দুর্যোধন ভূরিশ্রবাকে নিজের রথে তুলে নিলেন। পঞ্চম দিনে অর্জুনের বাণের আঘাতে কৌরবপক্ষের পঁচিশ হাজার মহারথ নিহত হলেন। তার পর সূর্যাস্ত হলে ভীষ্ম যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলেন।
______________
(ক্রমশ)