Expansion is life. in Bengali Motivational Stories by DR RAJESH CHOUDHURI books and stories PDF | বিস্তারই জীবন

Featured Books
Categories
Share

বিস্তারই জীবন

একমুঠো নুন এক কাপ জলে মিশিয়ে দেখুন,- ভীষণ লবনাক্ত হয়ে যাবে৷সেই জল মুখে দেওয়া সম্ভব হবে না।

সেই একই পরিমান নুন এক ঘটি জলে গুলে দেখুন,- লবনাক্ত হবে,- কিন্তু একটু কম। হয়ত  মুখে সেই  জল একটু নিয়ে কুলকুচি করা যাবে। 

একই পরিমান নুন এক বালতি জলে গুলে দেখুন,- সামান্য লবনাক্ত হবে। একটি বড় ড্রাম ভর্তি জলে গুলে দেখুন,- লবনের স্বাদ হয়ত ঠাহরই পাওয়া যাবেনা।  পুকুরের জলে গুলে দেখুন,- লবনের কোন অস্তিত্বই আর টের পাবেন না। সেই লবন সমুদ্রের জলে ঢেলে দিলে মানুষ হাসাহাসি করবে,- এতটুকু লবন সমুদ্রের জলে ঢেলে কি হবে?

ঠিক একই ব্যাপার ঘটে আমাদের জীবনে। সমস্যা প্রত্যেকের জীবনেই আসে,- কিন্তু সেই সমস্যা আপনার আমার জীবনকে কতটা প্রভাবিত করবে তা নির্ভর করে আপনার আমার জীবন  একটা কাপের মত,- না ঘটির মত,- নাকি ড্রাম, পুকুর বা সমুদ্রের মত বিশাল। যার জীবন যত বড়,- যত বিস্তৃত,- তার জীবনে সমস্যাগুলি তত কম হতাশা সৃষ্টি করে। যার জীবন যত ক্ষুদ্র, যে যত বেশী আত্মকেন্দ্রিক,- তার জীবনে যেকোনো ছোটখাটো সমস্যা আসলেই সে দিশাহারা হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়।

তাই শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র বলেন,-" সংকোচই দু:খ, প্রসারনই সুখ। " তিনি আরো বলেন,-" বিস্তারই জীবন, বিস্তারই প্রেম। " 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র, প্রভু যীশু, শ্রীচৈতন্য, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আদি মহামানবদের জীবন পর্যালোচনা করে দেখুন,- তাদের প্রত্যেকের জীবনে এত বিশাল বিশাল সমস্যা ছিল যার হাজার ভাগের এক ভাগ সমস্যাও যদি আমার আপনার জীবনে থাকত,- তাহলে আমরা দিশেহারা হয়ে জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়তাম।

 পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র,- বিনা দোষে রাজমহলের সুখ ছেড়ে বনবাসে যেতে হল। সেখানে গিয়েও শান্তি নেই,- প্রবল পরাক্রমী রাবন এসে রামের স্ত্রী সীতাকে কিডনাপ করে নিয়ে গেল। একজন পুরুষের জীবনে এর চেয়ে বড় সমস্যা আর কি হতে পারে? অথচ, -সেখানেও রামের কোন দোষ ছিলনা। এত কষ্ট করে প্রবল যুদ্ধে জয়ী হয়ে সীতাকে উদ্ধার করলেন- তারপরও উনার পত্নীপ্রেম নিয়ে মানুষ অপবাদ দিল।

 এত বিশাল বিশাল সমস্যায় পড়েও,- প্রভু রামচন্দ্র হতাশ হননি, ঈশ্বরকে দোষ দিয়ে কপাল চাপড়াননি, মুখের দিব্য হাসি ম্লান হয়নি, শান্ত-সৌম্য-প্রেমময় রূপ নষ্ট হয়নি,কারো সাথে মাথা গরম করে ঝগড়াঝাটি করেননি। এত এত সমস্যা,- কোন অলৌকিক ক্ষমতাবলে, ছুঁ মন্তর করে তার সমাধান হয়ে যায়নি। যা যা বাস্তবভাবে করলে সমাধান হবে-তাই করেছেন। অথচ আমরা সমস্যায় পড়লে ঈশ্বরকে দোষারোপ করি, তাঁর কাছে প্রার্থনা করে ভাবি কোন এক অলৌকিক প্রভাবে বা যাদুবলে আমি সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে যাব।

একই ব্যাপার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনেও। তিনি স্বয়ং ঈশ্বর, এই বিশ্বভ্রম্মান্ডের অধীশ্বর, - অথচ তাঁর জন্মটাই হল কারাগারে,  জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ অব্দি পান করার সুযোগ হয়নি,- রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসতে হল অনেক দূরে পালিতা মায়ের কাছে। সেখানেও শান্তি নেই,- কিছুদিন পর পর কংস তাঁকে হত্যা করার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ থামানোর এত চেষ্টা করলেন,- কিন্তু পারলেন না। অথচ যুদ্ধ শেষে গান্ধারী সমস্ত দোষ শ্রীকৃষ্ণের উপরই চাপিয়ে দিলেন।

যীশু খৃষ্টের জীবনে চরম অত্যাচার ও লাঞ্চনার কথা আমরা সবাই জানি। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের শৈশব থেকে বার্ধক্য অব্দি যে পরিমান সমস্যা, অভাব অনটন, অপবাদ, চক্রান্ত সহ্য করতে হয়েছে- তার ছিটেফোঁটাও আমাদের জীবনে আমরা সহ্য করতে পারব না। 

অথচ,- এত বিশাল বিশাল অকল্পনীয় সমস্যার মধ্যেও তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ধর্মে  অবিচল, সত্যের পথে নিরন্তর, ছিলেন শান্ত-সৌম্য-সুন্দর। সমস্যা নিয়ে তাঁরা কেউ ব্যাতিব্যাস্ত হননি, হতাশায় ভোগেননি, দিশেহারা হয়ে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াননি। বরং তাদের জীবন এত বিশাল ছিল, এত মহৎ উচ্চতায় অবস্থান করতেন তাঁরা, এতটা বিশ্বময় বিস্তৃত ছিল তাদের জীবন,- এত বড় বড় সমস্যাগুলোও ক্ষুদ্র বোধ হয়। এতটাই পজিটিভ এনার্জির আধার ছিলেন তাঁরা যে,- কোন নেগেটিভ এনার্জি তাঁদের টলাতে পারেনি। 

আমরা যদি নিজেদের জীবনের নানা সমস্যার মধ্যেও শান্তিতে, আনন্দে, স্বচ্ছন্দে থাকতে চাই,- তবে যার যার জীবনকে আরো বিস্তৃত করতে হবে, আরো বিশাল করতে হবে। তার সহজতম উপায়,- সেই "বিরাট শিশু"র সাথে যুক্ত হওয়া। যুগে যুগে সেই বিরাট পুরুষ আমাদের মাঝে আসেন,- আমাদের মত হয়ে। তিনি যুগোপযোগী সদগুরু, - তিনিই সমস্ত সমস্যার সমাধান। তাঁকে গ্রহন করে, তাঁর সাথে যুক্ত হয়ে, তাঁর নিদেশ পালনে আমরা যতই আন্তরিক হই,- ততই আমাদের জীবন ক্ষুদ্র আত্মকেন্দ্রিকতার গন্ডি ভেঙে বিরাটের দিকে ধাবিত হতে থাকে। তাঁর কাজের দায়ীত্ব মাথায় নিয়ে যতই আমরা তাঁর স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত হই,- ততই আমাদের জীবন মহান উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়। তখন বড় বড় সমস্যাগুলোও হেলায় পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। সমস্যাগুলো তখন জীবনকে হারাতে পারেনা।

বহু ক্যান্সার আক্রান্ত গুরুভাই ও মায়েদের দেখি,- কোন রকম হতাশা ও নিরানন্দ তাদের গ্রাস করতে পারেনি। স্বাভাবিক হাসিখুশি ভাবেই তারা ক্যান্সারের চিকিৎসা করিয়ে চলেছে। ভয়ংকর দুর্ঘটনায়  একটা আস্ত পা কাটা গেল,- তারপরও এক গুরুভাইকে দেখি সবসময় হাসি দিয়ে বলে,-" দাদা, খুব ভাল আছি। "  সদ্য যৌবনে পা দেওয়া একমাত্র সন্তানের অকাল মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই এক ভক্তিমতী মা'কে দেখলাম হাসিখুশি ভাবে মাতৃসম্মেলনে যাচ্ছে। চাকরি চলে গেল,- তারপরও এক গুরুভাইকে দেখলাম মন খারাপ না করে নতুন উদ্যমে নতুন ব্যাবসা শুরু করে আজ বেশ অর্থ উপার্জনের ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। ঈশ্বরকে ভালবাসলে, তাঁর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলে অমনই হয়। 

একটি লোক,- সংসার জীবনে নানা সমস্যায় জর্জরিত। অনেক চেষ্টা করেও সমস্যা দূর করতে পারছেনা। এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে সে গেল এক সাধুবাবার সন্নিকটে,- সমস্যার সমাধান প্রাপ্তির আশায়। 

সব শুনে সাধুবাবা লোকটিকে বলল,- "আমি তোমায় একটি মন্ত্র বলে দিচ্ছি। তুমি যদি সর্বক্ষন এই মন্ত্র জপ করতে পার,- তবে তুমি সমস্যামুক্ত হবে। "

লোকটি কাতরভাবে সেই মন্ত্রের জন্য প্রার্থনা জানাল। সাধুবাবা বললেন,-" তুমি এখন থেকে সারাক্ষন জপ করবে,-" "আমি সুখী, আমি আনন্দিত"। এই কথা দুটো দিবারাত্র জপতে থাক। "

এই মন্ত্র পেয়ে লোকটি তা জপ করতে করতে চলে যাচ্ছিল,- তখন সাধুবাবা ডেকে বললেন,-" যখন এই মন্ত্র জপ করবে তখন কিন্তু কোন বাঁদরের কথা যেন তোমার মনে না আসে। তাহলে মন্ত্রের গুন নষ্ট হয়ে যাবে। " 

এই কথা শুনে লোকটি খুশী মনে বাড়ী রওয়ানা দিল। কিন্তু রাস্তার পাশে একটি বাঁনর দেখতে পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল,-" ধুত, আমি তো বাঁদর দেখে ফেললাম,- এখন ত আমার মনে এর কথা আসবে। "

 বাড়ী গিয়ে দেখল ছেলেপুলেগুলো উঠানে দৌড়াদৌড়ি করছে।  রেগে গিয়ে ধমক দিল,-" এই বানরের দল,- তোদের পড়াশোনা নেই?" এই কথা বলেই তার মন খারাপ হয়ে গেল,-" ধুত আমি বানর শব্দটা কেন উচ্চারণ করলাম?"

 এইভাবে সে কিছুক্ষন পর পরই বানরের দেখা পেতে লাগল, বানরের নাম নিতে লাগল,- মন থেকে বানর আর দূর করতে পারছেনা। 

শেষে লোকটি আবার সাধুবাবার চরনে গিয়ে প্রার্থনা জানাল,-" বাবা, আমি ত আগে এত বানর দেখিনি। এখন প্রতিদিন বানর দেখতে পাচ্ছি। বানরের কথা বারবার মনে পড়ছে। "

সাধু স্মিত হেসে লোকটিকে বলল,-" বৎস, - বানর আগেও ছিল,- এখনও আছে। কিন্তু আগে তুমি বানরের প্রতি মনোযোগ দাওনি,- তাই আশেপাশে বানর থাকা সত্ত্বেও তোমার চোখে পড়েনি। আমি বলামাত্র তুমি বানর থেকে দূরে থাকার জন্য বানরের প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়লে। তাই এখন এত বানর দেখতে পাচ্ছ।

 তেমনি,- তোমার জীবনে ভাল আছে, মন্দও আছে। আনন্দ আছে - কষ্টও আছে। সমস্যা আছে,- সুখও আছে। কিন্তু তুমি সমস্যা থেকে দূরে থাকার জন্য সমস্যার প্রতি এত মনোযোগী হয়ে পড়েছ যে,- তুমি সর্বক্ষন শুধু তোমার সমস্যাগুলোই দেখছ। সুখ ও আনন্দগুলো ভুলে গেছ। সমস্যায় নিমজ্জিত থাকায় সমাধানের পথগুলো তোমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছেনা। 

তাই,- সমস্যা থেকে মুক্তি চাইলে সারাক্ষন আনন্দ ও সুন্দরের কথা ভাব। তোমার জীবনের সুখের স্মৃতিগুলো মনে কর। দেখবে ধীরে ধীরে সমস্যা দূর হয়ে যাচ্ছে।"

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্রও একই কথা বললেন,-" দুর্বলতার সময় সুন্দর ও সবলতার চিন্তা কর।"

 সুন্দর ও আনন্দের সাথে যুক্ত থাকলে মন আলোয় উদ্ভাষিত হয়ে উঠে। সব তালারই চাবি আছে। কিন্তু অন্ধকার ঘরে হাতরালে সেই চাবি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। চাবি খুঁজে পেতে হলে ঘরে আলো জ্বালাতে হবে। যতক্ষন আমরা দু:খে নিমজ্জিত থাকি, সমস্যার কথা ভাবতে থাকি,- ততক্ষন মন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তাই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাইনা। 

কিন্তু সমস্যায় পড়ে হঠাৎ করে সুন্দর, আনন্দ ও সুখের চিন্তা করা সম্ভব নয়। হঠাৎ করে দুর্বলতায় পতিত হয়ে সবলতার চিন্তা মাথায় আসেনা৷ হঠাৎ করে একদিন জীবনকে বিস্তারিত করা যায়না।  তাই প্রতিদিন প্রতিক্ষন এই সুন্দর ও আনন্দের সাথে যুক্ত থাকার অনুশীলনে রত থাকতে হয়। 

এই কারনেই সদগুরুর দীক্ষা গ্রহন করে নিত্য নামধ্যান,  নিত্য ইষ্টভৃতি পালন, নিত্য যজন-যাজন, ইষ্টকর্মে নিত্য যুক্ত থাকা, আচার্য সঙ্গ করা, আচার্য্যের ইচ্ছাপূরনে ব্যাপৃত থাকা। প্রতিদিন ডিপি ওয়ার্ক করা। এই করতে করতে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমাদের জীবনকে বিস্তৃতির দিকে প্রসারিত করতে থাকি, সুন্দর ও আনন্দের মূর্ত বিগ্রহকে ধ্যান করতে করতে আনন্দ ও সুন্দরে মন নিয়ত বিরাজ করে। তখন কত কত সমস্যা আমাদের জীবনে আসে,- আবার চলে যায়। কিন্তু সেই সমস্যা আমাদের হতাশায় নিমজ্জিত করেনা, আমাদের জীবন বিধ্বস্ত হয়না৷

 আমরা নিরন্তর আনন্দে জীবন অতিবাহিত করার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলি।