"শ্রী বিগ্রহের মন্দির ভেবে যত্ন করিস শরীরটাকে"
এই পৃথিবী নামক গ্রহের বুকে সবচেয়ে মূল্যবান সৃষ্টি হলো — মানুষের শরীর।
এই দেহ শুধু রক্ত মাংস-মজ্জা, হাড়-চামড়ার সমষ্টি নয়, এটি এক অলৌকিক মন্দির।
এই মন্দিরের মধ্যে বিরাজ করেন পরমাত্মা, যিনি সকল জীবের হৃদয়গুহায় অবস্থান করেন —
**“ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশে অর্যুন তিষ্ঠতি।”**(ভগবদ্গীতা ১৮.৬১)
অর্থাৎ, প্রতিটি প্রাণীর অন্তরে ঈশ্বর অবস্থান করেন।
তাহলে এই দেহ, যেখানে ঈশ্বর নিজে বসবাস করেন, সেটিই তো শ্রীবিগ্রহের মন্দির।
মানুষ একমাত্র জীব, যে নিজের আত্মাকে সচেতনভাবে উন্নীত করতে পারে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, জীবাত্মা স্থাবর ও জঙ্গম রূপে **আশি লক্ষ বার** জন্ম নেয়;
তারপর মানবদেহ লাভ করে আত্মোন্নতির সুযোগ হিসেবে।
**“জন্মান্তর সহস্রেষু দুর্লভং মানবং লভেৎ।” (গরুড় পুরাণ)**
অর্থাৎ, অসংখ্য জন্মের পর মানুষরূপে জন্ম পাওয়া এক বিরল সৌভাগ্য।
কিন্তু এই সৌভাগ্যের মূল্য না বুঝে যারা নিজেদের দেহকে অযত্নে ফেলে রাখে, তারা প্রকৃত অর্থে নিজের দেবত্বকে অপমান করে।
যেমন একটি মন্দিরে মূর্তি থাকলেও যদি তা নোংরা, ধূলিধূসর ও ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকে, তাহলে সেখানে পূজার ভাব আসে না।
তেমনি, এই দেহমন্দিরও যদি অসুস্থ, ক্লান্ত ও অস্বচ্ছ থাকে, তাহলে ভগবানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
**“শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম্।” (মহাভারত)**
অর্থাৎ, শরীরই সব ধর্মচর্চার প্রথম উপায়।
এই শরীর না থাকলে তপস্যা, যোগ, ধ্যান, জপ— কোনোটিই সম্ভব নয়।
সুতরাং শরীরকে অবহেলা নয়, বরং শ্রদ্ধা করাই সত্যিকারের ধর্ম।
আমাদের দেহ আসলে এক আশ্চর্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র। এর প্রতিটি কোষের মধ্যে ঈশ্বরীয় শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মানবদেহ এক অলৌকিক জৈব প্রযুক্তি —
যার হরমোন, নিউরন, এনার্জি সার্কিট ও চক্রসমূহ এক সুসমঞ্জস ছন্দে কাজ করে চলে।
**যোগশাস্ত্র** বলছে, মানবদেহে সাতটি প্রধান চক্র বা শক্তিকেন্দ্র আছে —
মূলাধার থেকে সাহস্রার পর্যন্ত।
এই চক্রগুলো একে একে জাগ্রত হলে মানুষ নিজের ভেতরে পরমসত্তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে।
তবে এই জাগরণ তখনই সম্ভব, যখন দেহ থাকে শুদ্ধ, মন থাকে শান্ত, আর প্রাণ থাকে নিয়ন্ত্রিত।
তাই ঋষিমুনিরা প্রথম থেকেই দেহের সার্বিক ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিকে সাধনার অঙ্গ করে তুলেছিলেন।
তাঁরা বলেছিলেন — **“যোগঃ চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ।” (পতঞ্জলি যোগসূত্র)**
মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে প্রাণকে, আর প্রাণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে দেহকে শুদ্ধ রাখতে হয়।
এই শুদ্ধ দেহই পরিণামে হয়ে ওঠে শ্রীবিগ্রহের মন্দির।
আজকের যুগে মানুষ শরীরের চাহিদাকে অতিমাত্রায় উপভোগের বস্তু করে ফেলেছে।
ফাস্টফুড, নেশা, ঘুমের অভাব, উদ্বেগ —
এই সবই সেই পবিত্র মন্দিরের ভিত নষ্ট করছে।
যেখানে আগে মানুষ শরীরকে “অর্ঘ্য” দিত উপবাস, প্রার্থনা ও শ্বাসের নিয়মিত অনুশীলনে,
এখন সেখানে শরীরকে করা হচ্ছে কেমিক্যাল আর জাঙ্কফুডের কারখানা।
ভগবদ্গীতা (৬.১৬–১৭) বলছে —
**“নাত্যশ্নতস্তু যোগোস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ।
ন চাতি স্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন॥”**
অর্থাৎ, অতিরিক্ত খাওয়া, না খাওয়া, অতিরিক্ত ঘুম বা জাগরণ —
সবই যোগের বিরোধী।
শরীরকে সামঞ্জস্যে রাখতে হবে, সেটাই প্রকৃত যোগ।
তাই যারা সত্যিই আধ্যাত্মিক উন্নতি চায়,
তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজের দেহকে পবিত্র ও সুষম রাখার সাধনা।
সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত প্রণায়াম ও ধ্যান,
এই চারটি দেহমন্দিরকে দেবালয় করে তোলে।
চিকিৎসা ও ধর্ম উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা যায়,
যখন শরীর ভারসাম্য হারায়, তখন মনও অস্থির হয়।
যখন মন অস্থির হয়, তখন প্রার্থনাও ফলপ্রসূ হয় না।
অতএব দেহ, মন ও আত্মা— এই তিনটির ভারসাম্য রক্ষা করাই প্রকৃত সাধনা।
এমনকি **অদ্বৈত বেদান্ত**ও বলছে—
দেহ-মন-আত্মা পৃথক নয়; এরা একই ব্রহ্মতত্ত্বের বিভিন্ন স্তর।
তাই প্রাচীন ঋষিদের পথ অনুসরণ করে আমাদেরও শিখতে হবে দেহকে শ্রদ্ধা করতে।
প্রতিদিন সকালে সূর্যোদয়ের আলোয় কয়েক মিনিট নীরবে নিজের শরীরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাও।
মনেমনে বলো—
**“হে দেহ, তুমিই আমার সাধনার প্রথম অর্ঘ্য,
তোমার ভেতরেই আছে সেই চিরন্তন সত্তা— শ্রীবিগ্রহ নিজে।”**
যেমন গৃহে দেবতার মূর্তি স্থাপন করলে আমরা প্রতিদিন তাঁকে স্নান করাই,
পুষ্প দিই, ধূপ জ্বালাই— তেমনি নিজের দেহকেও প্রতিদিন যত্ন দাও।
শুদ্ধ খাদ্যই সেই প্রসাদ,
ব্যায়ামই সেই প্রণাম,
প্রাণায়ামই সেই ধূপ,
আর ধ্যানই সেই আরতি।
এইভাবেই প্রতিদিন নিজের শরীরকে পূজা করলে
ভেতর থেকে জেগে উঠবে চেতনার আলো।
তখনই তুমি বুঝবে, ঈশ্বর বাইরে নন— তোমার ভেতরেই বিরাজমান।
তাই পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছেন—
**“শ্রী বিগ্রহের মন্দির ভেবে যত্ন করিস শরীরটাকে।”**
এ শরীরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তোমার মুক্তির পথ,
এই মন্দিরের মধ্যেই বাস করেন স্বয়ং পরমেশ্বর।