The body is the temple of the deity - 3 in Bengali Spiritual Stories by Yogi Krishnadev Nath books and stories PDF | শরীর মানেই শ্রীবিগ্রহের মন্দির - 3

Featured Books
Categories
Share

শরীর মানেই শ্রীবিগ্রহের মন্দির - 3


প্রয়াস — শরীরের জাগরণ ও কর্মই উপাসনা


সৃষ্টির মানেই হচ্ছে গতিশীলতা। নদী যখন বয়ে চলে, তখনই সে জীবন্ত। বাতাস যখন বইতে থাকে, তখনই তার স্পর্শ অনুভূত হয়। তেমনি শরীরও যতক্ষণ সচল থাকে, ততক্ষণই সে জীবনের গান গায়।
স্থবিরতা মানেই মৃত্যু — তা শরীরেরই হোক, মননেরই হোক, কিংবা আত্মারই হোক।

এই দেহমন্দিরে “প্রয়াস” মানে কেবল পরিশ্রম নয়,
এটা হলো — নিজের শক্তিকে সচেতনভাবে সক্রিয় করে রাখা। যেমন মন্দিরে প্রতিদিন ভোরবেলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেবতার আরাধনা শুরু হয়, তেমনি শরীরের ভেতরের দেবতাকে জাগাতে প্রতিদিনের প্রয়াস অপরিহার্য।

শরীরকে তুমি যদি শ্রীবিগ্রহের মন্দির ভাবো,
তবে প্রয়াসই তার সকালবেলার মঙ্গল আরতি।


প্রয়াসের অন্তরার্থ:

প্রয়াস মানে কেবল হাঁটা, দৌড়ানো, ব্যায়াম করা এসব নয়। এটা হলো — প্রতিটি অঙ্গের মধ্যে শরীরের প্রাণশক্তিকে জাগিয়ে তোলা। এই চলাচলই আমাদের ভেতরের স্থবিরতাকে ভাঙে। তুমি যখন হাঁটতে থাকো, তোমার রক্ত চলাচলের গতি বৃদ্ধি শুরু হয়, প্রতিটি কোষ যেন আনন্দে নেচে ওঠে — “আমি বেঁচে আছি” বলে।

প্রয়াস আসলে শরীরের প্রার্থনা।
যেখানে ঘাম মানে ধূপ,
আর শ্বাস মানে মন্ত্র।
একেকটি নড়াচড়া যেন শরীরের দেবতার প্রতি এক প্রণাম —
“আমি আমার শরীরকে সম্মান করছি, তাকে কাজে লাগাচ্ছি, তাকে ধন্য করছি।”


বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা ও দার্শনিক মিলন:

বিজ্ঞান বলে — যখন শরীর নড়াচড়া করে, তখন মস্তিষ্ক নতুন সংযোগ তৈরি করে। পেশিগুলো থেকে নির্গত ‘মায়োকাইন’ নামের প্রোটিন মস্তিষ্কে গিয়ে উদ্বেগ কমায়, মনোযোগ বাড়ায়। একই সঙ্গে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ে, শরীর ফ্যাট বার্ন করতে শেখে, আর মেটাবলিজম স্থিতিশীল হয়।

আর আমি বলি —
এটাই হলো ঈশ্বরের রহস্যময় যোগগণিত। যেখানে কর্ম মানেই পূজা, আর নড়াচড়া মানেই ধ্যান।

যদি গভীরভাবে অনুভব করা যায়, তাহলে বোঝা যায় – প্রতিটি পদক্ষেপ মাটিতে ফেলার মধ্যে, প্রতিটি নিঃশ্বাসের মধ্যে, একটা অনন্ত ছন্দ কাজ করে — যা মহাবিশ্বের ছন্দের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সুতরাং এই প্রয়াসই তোমাকে সেই ছন্দের সঙ্গে একাকার করে দেয়।


স্থবিরতাই বিপজ্জনক:

যে দেহে চলাচল নেই, সেখানে জীবনও নেই। যেমন মন্দিরে দীর্ঘদিন প্রার্থনা না হলে ধুলো জমে যায়, তেমনি শরীরও নিষ্ক্রিয় থাকলে ক্লান্ত, ভারী, আর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এমনকি মনের ভেতরেও ঘন কুয়াশা জমা হয়ে যায় — আলস্য, বিষণ্ণতা, আত্মসন্দেহ, ভয় এসব।

চলাফেরা মানে শুধু শক্তি খরচ নয়, এটার মানে হচ্ছে — শরীরের মধ্যে নতুন আলো প্রবাহিত হওয়া। যতক্ষণ তুমি সক্রিয় থাকবে, ততক্ষণই সেই আলো জ্বলে থাকবে। একবার থেমে গেলে, ধীরে ধীরে আলোটা ম্লান হতে শুরু করে। তাই প্রয়াস মানে শুধু শরীরচর্চা নয় — এটা হলো আত্মার সঞ্চালন।


প্রয়াসের দৈনন্দিন রূপ:

ভোরের বাতাসে একটুখানি হাঁটাও একটা প্রয়াস। মাটির ঘ্রাণে, গাছের পাতায়, পাখির ডাকের ছন্দে নিজের শরীরকে মিলিয়ে দাও। এমনভাবে হাঁটো যেন মনে হয় — তুমি নিজেই পৃথিবীর নাড়ির সঙ্গে এক হয়ে গেছ।
গভীর শ্বাস নিয়ে প্রাণবায়ুর শক্তিকে শরীরের মধ্যে ঘোরাও, যেখানে জমে আছে আলস্য, সেখানেই আগুনের নিশ্বাস ছেড়ে দাও।

একদিনও বাদ দেবে না। প্রয়াস মানে রুটিন নয়, এটা হলো আত্ম-সম্মান। তুমি যতদিন এই প্রয়াস চালিয়ে যাবে, শরীর ততদিন তোমাকে শক্তি আর প্রশান্তি দিয়ে আশীর্বাদ করবে।


প্রয়াসের আধ্যাত্মিক দিক:

যখন তুমি মন দিয়ে কোনো কিছু করো — হাঁটো, ঘর পরিষ্কার করো, রান্না করো, সেই কাজটিই হয়ে যায় উপাসনা। শরীরের মধ্যে তখন জন্ম নেয় ভক্তি। যে ক্লান্তি আসে, সেটাই প্রমাণ করে যে তুমি বেঁচে আছো, কাজ করছো, জ্বলছো।

এই ক্লান্তির পরের নিঃশ্বাসটাই শান্তি। ঘামের পরের প্রশান্তিটাই ধ্যান। আর এই ধ্যানই শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় ঈশ্বরের কাছাকাছি।

প্রয়াস মানে তাই শুধুই শরীরচর্চা নয়, এটা হলো নিজের সীমাকে চ্যালেঞ্জ করা, নিজের ভেতরের আগুনটাকে জাগিয়ে তোলা।

তোমার দেহমন্দিরে প্রয়াস মানে ভোরের ঘণ্টাধ্বনি। যে মানুষ প্রতিদিন অন্তত কিছুটা নড়াচড়া করে, সে শুধু দেহ নয় — জীবনেরও যজ্ঞ করে।

চলো, প্রতিটি সকালে আমরা মাটিতে পা রাখি কৃতজ্ঞতায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে জাগিয়ে তুলি শক্তি, আর প্রতিটি কর্মের সময় মনে মনে বলো —
“আমি জীবিত আছি, আমি সক্রিয় আছি, আমি ধন্য।”
এই প্রয়াসই একদিন তোমার শরীরকে আবার করে তুলবে মন্দিরের মতো উজ্জ্বল, যেখানে ঈশ্বর নিজেই বসবাস করবেন — তোমার ভেতরে, তোমার চলায়, তোমার নিঃশ্বাসে।