The body is the temple of the deity - 2 in Bengali Motivational Stories by Yogi Krishnadev Nath books and stories PDF | শরীর মানেই শ্রীবিগ্রহের মন্দির - 2

Featured Books
Categories
Share

শরীর মানেই শ্রীবিগ্রহের মন্দির - 2

#দেবমন্দির_দর্শন মানবদেহের মধ্যেই স্বয়ং পরব্রহ্মের অবস্থিতি। তাই এই দেহটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দেবমন্দির। এই মন্দিরের “দর্শন” অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই দর্শন শব্দটির মাধ্যমে যেমন সাধারণ চোখে দেখার বিষয়টি বোঝায়, অন্যদিকে এর ফিলোসফিক্যাল দিকটিকেও তুলে ধরে। নিজের শরীর তখনই একটি দেবমন্দির হয়ে ওঠে, যখন তার মধ্যে সপ্তাচারের বীজ বপন করা হয়।সপ্তাচার: সৃষ্টির আদিতে ছিল শব্দ। সেই শব্দ থেকেই জগতের উৎপত্তি; কম্পনের প্রথম ঝঙ্কার থেকেই সৃষ্টির সমস্ত রূপ মূর্ত আকার ধারণ করেছে। শব্দ যখন সুরে পরিণত হয়, তখন সঙ্গীত গড়ে ওঠে; সঙ্গীত যখন মিলন ঘটায়, তখন জীবননাদও সুগভীর হয়।  সপ্ত স্বর— সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি— এই সাতটি কম্পনই সঙ্গীতের মূলস্তম্ভ। যেমন প্রত্যেক স্বর পারস্পরিক সামঞ্জস্যে মিললে সুরের পূর্ণতা আসে, তেমনি জীবনের সাতটি আচারের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলেই দেহ-মন্দির পূর্ণতা পায়।  সারেগামাপাধানির অসামঞ্জস্যে যেমন সুর বিঘ্নিত হয়; তেমনি সপ্ত আচারের বিলুপ্তিতে শরীরের সুরও বিকৃত হয়ে অসুখে পরিণত হয়। অতএব শব্দের এই প্রাচীন মাত্রার কাছে শ্রদ্ধাশীল হয়ে— শব্দ, সুর ও আচারের সেতু রক্ষা করাই জীবনের প্রকৃত সাধনা।"শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম্।”  অর্থাৎ, শরীরই হলো ধর্ম সাধনার প্রধান মাধ্যম।  যে দেহ সচল, শুদ্ধ ও সজীব — সেই দেহেই বাস করেন ঈশ্বর। কারণ এই দেহই তো দেবমন্দির, যেখানে আত্মা, প্রাণ ও চেতনা মিলিত হয়ে জীবনের উৎস সৃষ্টি করে।এই দেহমন্দিরের স্থায়িত্ব ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সাতটি আচারের সমন্বিত সাধনা —  ভোজন, ভাণ্ডারা, প্রয়াস, উপবাস, নিদ্রা, শ্বাস ও ধ্যান। এই সপ্তাচারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবজীবনের পূর্ণ বিকাশের রহস্য।১) ভোজন: ভোজন মানে শুধুই খাওয়া নয়। এটি হলো দেহমন্দিরে অবস্থিত দেবতার জন্য নৈবেদ্য বা আহার। এই আহার শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, এটি দেহের প্রতিটি কোষে শক্তি ও চেতনা জাগিয়ে তোলে। যেমন মন্দিরে দেবতার ভোগ অর্পণ করা হয় শ্রদ্ধা ও শুদ্ধতায়, তেমনই আহারও হওয়া উচিত ভক্তি ও সচেতনতার সঙ্গে।  গীতার বাণী —  “যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসূ।”  অর্থাৎ, পরিমিত আহার ও সুষম জীবনযাপনই সুস্থতার মূল।  বিজ্ঞানও বলে —  সঠিক খাবার শরীরের কোষ পুনর্গঠন করে, হরমোন ও মেটাবলিজমকে ভারসাম্যের মধ্যে রাখে। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট বা প্রক্রিয়াজাত খাবার শুধু শরীর নয়, মনের স্থিরতাও নষ্ট করে।  অতএব আহার হলো একাধারে পূজা, বিজ্ঞান এবং শৃঙ্খলার প্রতীক।তৈত্তিরীয় উপনিষে আছে —  “অন্নং ব্রহ্মেতি ব্যবজনাত্।” অর্থাৎ, আহারই ব্রহ্ম। খাবার কেবল শরীরের জ্বালানি নয়, এটি আত্মার উপাসনা, এটি জীবনের স্পন্দন।মানুষের দেহ এক জটিল জৈব–যন্ত্র, যার প্রতিটি কোষে প্রবাহিত হয় প্রাণশক্তি।  এই যন্ত্রটিকে সচল রাখার প্রধান উপাদানই হলো — আহার। যেমন মন্দিরে প্রতিদিন দেবতার ভোগ অর্পণ করা হয় যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে, তেমনি আমাদের প্রতিটি আহারও আসলে দেহমন্দিরের প্রতি এক নিবেদন।  কিন্তু আজকের মানুষ আহারকে একেবারে ভোগবিলাসের স্তরে নামিয়ে ফেলেছে।  খাওয়ার বিষয়টা এখন একধরনের বিনোদন, তৃপ্তির উৎস নয়, বরং অতৃপ্তির প্রতিফলন।শাস্ত্রের দৃষ্টিতে আহার: উপনিষদে আহারের তিনটি গুণের কথা বলা হয়েছে — সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। * সাত্ত্বিক আহার: যা নির্মল, হালকা, জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে। যেমন — ফল, শাকসবজি, শস্য, ঘি, দুধ ইত্যাদি। এগুলো মনকে শান্ত ও স্পষ্ট করে, দেহকে শুদ্ধ রাখে।  * রাজসিক আহার: ঝাল, লবণাক্ত, অতিরিক্ত গরম বা উত্তেজক। এগুলো রক্তচাপ বাড়ায়, মনকে উদ্বিগ্ন করে।   * তামসিক আহার: বাসি, অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত বা প্রাণহীন খাবার। এগুলো দেহে অলসতা ও বিষ তৈরি করে।  গীতা (১৭.৭–১০) স্পষ্টভাবে বলেছে —  “আহার্যাস্ত্বপি সর্বস্য ত্রিবিধো ভবতি প্রিয়ঃ।  যজ্ঞস্তপস্তথা দানং তেষাং ভেদমিমং শৃণু॥”  অর্থাৎ, মানুষের আহারও তার স্বভাবের মতো তিন গুণে বিভক্ত।বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আহার: আধুনিক বিজ্ঞান এখন ধীরে ধীরে বুঝছে — “We are what we eat” —  এই বাক্যটি কোনো কাব্যিক উক্তি নয়, নিখাদ সত্য। আমাদের চিন্তা, মনোভাব, এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও অনেকাংশে নির্ভর করে  আমরা কী খাচ্ছি, কতখানি খাচ্ছি, এবং কখন খাচ্ছি তার ওপর। খাবার আমাদের হরমোন, নিউরোট্রান্সমিটার এবং কোষীয় যোগাযোগের প্যাটার্ন পর্যন্ত প্রভাবিত করে।  অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট, প্রসেসড ফুড, বা চিনি–যুক্ত খাবার শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, ফলে তৈরি হয় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, ফ্যাট জমে যায়, এবং শুরু হয় তথাকথিত “লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডার” —  যার মধ্যে আছে স্থুলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ও মানসিক অস্থিরতা।  অন্যদিকে, প্রাকৃতিক, আনপলিশড, নন রিফাইন্ড, ফাইবার ও এনজাইমসমৃদ্ধ আহার শরীরের মেটাবলিজমকে সুষম রাখে, লিভার ও অন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, এবং হরমোনকে প্রাকৃতিক ছন্দে ফিরিয়ে আনে।আহার ও চেতনার সম্পর্ক: বৈদিক দর্শন বলে,  “যৎ অন্নং, তৎ মনঃ।” — যেরকম আহার, সেরকম মন। অর্থাৎ, খাবার কেবল দেহ নয়, মনকেও পুষ্ট করে।  তুমি যা খাও, তা শুধু রক্তে মেশে না, তা তোমার চিন্তা, আবেগ ও আচরণেও প্রতিফলিত হয়। একজন ক্রুদ্ধ মানুষ প্রায়ই মশলাদার ও উত্তেজক খাবার পছন্দ করে, আবার একজন শান্ত স্বভাবের মানুষ চায় সহজ ও নির্মল আহার। এই চক্রই নির্ধারণ করে আত্মার বিবর্তন। ধ্যানীদের আহার তাই সর্বদা হালকা ও সাত্ত্বিক। কারণ ভারী খাবার শ্বাসকে ধীর করে, মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমিয়ে দেয়, এবং ধ্যানের স্বচ্ছতা নষ্ট করে।আহার, অগ্নি ও পুষ্টি: বেদে বলা হয়েছে, “অগ্নিরূপো ভবতি অন্নং।” অর্থাৎ, আহারই হলো অগ্নির বাহন। আমাদের দেহে ‘জঠরাগ্নি’ বা হজমের আগুন ক্রমাগত জ্বলছে। এই অগ্নিই হজম করে, শক্তি উৎপাদন করে, দেহকে সচল রাখে। যখন আমরা অতিরিক্ত বা অসঙ্গত আহার করি,  তখন এই অগ্নি নিভে যেতে শুরু করে। হজমে সমস্যা, গ্যাস, অ্যাসিডিটি, টক্সিন জমে যাওয়া — সবই তার ফল।  আয়ুর্বেদ বলে — "রোগা: সর্বে আপি মন্দাগ্নৌ।” অর্থাৎ, সব রোগই জন্ম নেয় হজমের দুর্বলতা থেকে। বৈজ্ঞানিকভাবে বললে, দুর্বল হজম মানে ধীর মেটাবলিজম, অর্থাৎ শরীরের শক্তি–উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত। এতে লিভারের ফাংশন কমে যায়, ইনসুলিনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, এবং কোষগুলো টক্সিনে ভরে যায়।আহারের সময়, পরিমাণ ও অনুভব: শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “ভোজনং অর্ধপূর্তং, জলপূর্তং চতুর্থভাগম্।” অর্থাৎ, পেটের অর্ধেক অংশ খাবারে, চতুর্থাংশ জলে, বাকিটা ফাঁকা রাখবে। বিজ্ঞানে একেই বলে "digestive space" — যেখানে হজমের এনজাইম ও গ্যাসের স্থান থাকে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, খাবারের সাথে জল গ্রহণ করা বারণ। খাবার খাওয়ার অন্তত ঘন্টা খানেক পরে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল খেতে হবে।খাবারের সঠিক সময় হিসেবে আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে — সূর্যোদয়ের পর ও সূর্যাস্তের আগে খাবার সবচেয়ে উপকারী। রাতে দেরি করে খাওয়া মানে বিপাকীয় ছন্দকে ভেঙে দেওয়া,  যা ঘুম ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ — আহার অনুভব করে খাওয়া। অর্থাৎ ক্ষিদের তাগিদ আছে কিনা সেটা বুঝে খাবার খাওয়া। খাবার কখনোই অমনোযোগী হয়ে খেতে নেই। যখন তুমি প্রতিটি গ্রাস ধীরে ধীরে, মনোযোগ দিয়ে খাও, তখন শরীর এনজাইম নিঃসরণে প্রস্তুত হয়, হজম সহজ হয়। এটাই “Mindful Eating” — আধুনিক বিজ্ঞান যেটাকে আজ বড় করে বলছে, আর আমাদের শাস্ত্র বলেছিল সহস্র বছর আগে —  “বিনাযত্নেন ভোজ্যং, তদন্নং বিষসম্ভবম্।”  অর্থাৎ, অসচেতনভাবে খাওয়া খাবারই শরীরে বিষ তৈরি করে।আহারের আধ্যাত্মিক রূপ: অন্নগ্রহণই একপ্রকার যজ্ঞ। যজ্ঞের আগুন যেমন ভোগ গ্রহণ করে আশীর্বাদ দেয়, তেমনি হজমের অগ্নিও আহার গ্রহণ করে শরীরকে আশীর্বাদ দেয় শক্তি হিসেবে।  ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে —  “আন্নময়ো হি প্রানময়ঃ।”  অর্থাৎ, আহার থেকেই উৎপন্ন হয় প্রাণ। তুমি যা খাও, সেটাই তোমার প্রানশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।  তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন —  “অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা, প্রানিনাং দেহমাশ্রিতঃ।”  অর্থাৎ, আমি নিজেই সেই হজমের আগুন, যা তোমার দেহে বিরাজমান।  অতএব, প্রতিটি আহারের আগে নীরবে এক মুহূর্ত ভগবানকে স্মরণ করো। খাবারকে ভাবো প্রণাম হিসেবে, ভোগ হিসেবে।  তখন সেই আহার কেবল শরীর নয়, আত্মাকেও পুষ্ট করবে। আহার মানে কেবল মুখে কিছু তোলা নয়, এটি একধরনের আরাধনা — দেহমন্দিরে নিবেদিত প্রসাদ। খাবারই দেহের শক্তি, মননের স্বচ্ছতা ও আত্মার জাগরণ। অসচেতন আহার মানুষকে রুগ্ন করে তোলে, আর সচেতন আহার মানুষকে দেবত্বের পথে নিয়ে যায়।  তুমি যদি প্রতিদিন খাওয়ার সময় এই ভাবনা রাখো — “আমি আমার দেহমন্দিরে প্রসাদ নিবেদন করছি”, তাহলে দেখবে, তোমার খাদ্যও ওষুধে রূপ নেবে। দেহ, মন, ও আত্মা — তিনটিই পাবে সেই পরম তৃপ্তি, যেখান থেকে শুরু হয় দেবমন্দির দর্শনের প্রকৃত যাত্রা।