Hotat Bristi in Bengali Love Stories by Soham Saha books and stories PDF | হঠাৎ বৃষ্টি

Featured Books
Categories
Share

হঠাৎ বৃষ্টি


বহুদিন পর হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ট্রেনের কামরায়। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইন। আজ কী তুমুল বৃষ্টির দিন !
      বালি থেকে সকাল ন'টার আশেপাশে যে চন্দনপুর লোকালটা থাকে , সেই ট্রেনেই ছিলাম আমি। ওই ট্রেনটা রোজই খালি থাকে। সেদিন অঝোরে বৃষ্টির জন্য প্যাসেঞ্জার ছিলনা বললেই চলে।
       কামরায় দু'চারজন মাত্র লোক থাকে বাড়ুইপাড়ার পর। আমি জানলার ধারে আরাম করেই বসেছিলাম, হাওয়া লাগছিল বেশ।
হঠাৎ দেখি পাশে এসে বসল মেয়েটা। বসার জায়গা আরও অনেক ছিল। কিন্তু এমন দিনে আমার পাশেই একটি মেয়ে এসে বসায় আমি ঘুরে তাকালাম তার দিকে।
       মেয়েটি আমার দিকেই তাকিয়েছিল।
এত বছর পরে দেখেও চিনতে অসুবিধে হয়নি।
দুজনেই দুয়েকমুহূর্ত মুখোমুখি থমকে থাকার পরেই দেখি আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার মুখে প্রথম থেকেই মিটিমিটি হাসি।
– চিনতে পেরেছিস?
তার মুখের কথা খসতে না খসতেই বলে উঠলাম, – তুই! এখানে?
মনে হল ট্রেনের জানলা দিয়ে হাওয়া যেন আরও বেশি বেশি আসছে। দরজায় লোকজন দাঁড়ায়নি আজ, সিটের রো-গুলোর মধ্যেকার চ্যানেলেও কেউ দাঁড়িয়ে নেই – হুহু করে শিরশিরে হাওয়া এসে তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে কেবল। 
      ওর মুখের গড়নটা আমার ভারি ভাল লাগে, আগেও লাগত। অনেকে বলে, এটা নাকি পানপাতা মুখ। অল্প হাসি সবসময় থেকেছে, শান্ত মুখশ্রী, শান্ত ধীরস্থির মেয়ে। কথা কমই বলত বরাবর, তবে বলতে শুরু করলে অনেক কথাই বলত। 

    কতগুলো বছর পর দেখা , কিন্তু আমাদের কোথাও কিছু আটকালো না। 
– কেমন আছিস?
– এই তো।
– তুই এদিকে চাকরি করিস বুঝি?
– হ্যাঁ। চাকরি এদিকে নয়। তবে একটা কাজে মধুসূদনপুর নামব। তুই?
– কামারকুন্ডু নামব।
মির্জাপুর-বাঁকিপুর ছাড়িয়ে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল। নড়তেই চায় না। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু যায় আসে না। ছোটবেলার বন্ধু আমরা, গল্পে মজে যেতে কতক্ষণ লাগে আর। বাইরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে।

      ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সেই শৈশব থেকে – পড়েছি ক্লাস ফোর অবধি একসঙ্গে। সেসব খুব মজার দিন ছিল! আমার ওপর গার্জেনগিরি ফলাতো খুব। রেগে গিয়ে আমি দুম দুম করে পিটে দিয়েছি কোনোদিন বা আমার ব্যাগে হাত দেওয়ায় তার পেন্সিল দিয়েই তার স্কার্ট পরা পায়ে ফটাস ফটাস করে মেরেছি। সে প্রাথমিক আঘাতে হাউহাউ করে কেঁদেছে। অন্য কেউ গিয়ে আমার নামে বড়দির কাছে নালিশ ঠুকে এসেছে , – মিস, মিস, ঋক না শিল্পীকে খুব মারছিল। শিল্পী কাঁদছে।
     বড়দি ডেকে পাঠালেন দুজনকেই। আমি ভয়ে আধমরা প্রায়, খুব ভয় পেতাম বড়দিকে। শিল্পীকে বারবার জিগ্যেস করলেন বড়দি এবং অন্য কোনও মিস। সে মেয়ে স্বীকারই করলনা যে আমি তাকে মেরেছি। স্কুলের বেঞ্চে হোঁচট খেয়ে হাঁটুতে লেগেছে, তাই নাকি কাঁদছিল! এরকম হয়েছিল বারচারেক। কোনোদিন আমার নামে ও অন্তত অভিযোগ করেনি।

      তারপর স্কুল আলাদা। দেখা হতনা , তবে ক্লাস নাইনে একবার টিউশনি পড়ার সূত্রে আবার যোগাযোগ হয়। তারপর সম্ভবত ওরা অন্য কোথাও চলে যায়, আর দেখা হয়নি কখনও।
মনে ছিল তাকে, ভুলিনি। অন্য পুরনো বন্ধুদের কে কোথায় আছে, কী করছে খবর পাওয়া যেত – সোশ্যাল মিডিয়া যুগ আসার পরে তো আরওই। কিন্তু শিল্পীর খোঁজ পাইনি, কেউই ঠিকঠাক বলতে পারেনি।
      এটাই আশ্চর্য লাগে আমার। সে গেল কোথায়? 
আর গেলই বা যদি, তবে কেউ জানেনা কেন?
 এই ট্রেনে সে উঠল কোত্থেকে? বারুইপাড়া থেকে ট্রেনের এই দরজা দিয়ে অন্তত ওঠেনি। তবে কী পিছনের দিকে দরজা দিয়ে উঠল? খেয়াল করিনি আমি? হতে পারে।

      কী সুন্দর দেখতে লাগছে শিল্পীকে! অবশ্য আগেও তেমনই লাগত। এদিক ওদিক থেকে জলের ছিটে এসে ওর কপালে কুমকুমের টিপের মত আটকেছে।
      ভরাট চেহারা। একটু ভারী স্বাস্থ্য বলা যায়। পরনে পিচ রঙের সালোয়ার কামিজ। 
বললুম, ট্রেন যে দাঁড়িয়ে গেল রে।
সে পাল্টা প্রশ্ন করল , তাড়া কীসের তোর? এই বৃষ্টিতে নেমেই বা কী করতিস? 
ফাঁকা কামরায় আয়েশ করে পা দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে দেয় শিল্পী। কোলে ব্যাগটা ধরে রাখে।
      জানলা দিয়ে জলের ঝাপটা আসছে বলে কাচ নামিয়ে দিতে গেলাম।
ও বারণ করল। ইশারায় ওর দিকে সরে এসে বসতে বলল আমাকে।
আমিও ওর কাছাকাছি ঘেঁষে এসে বসলাম। 
     নাগাড়ে বৃষ্টির কেমন একটা শিরশিরে ঝিমঝিমে মাদকতা আছে। আমি শিল্পীকে দেখছিলাম। মেলে ধরা পা'দুটো বেশ লাগছে। পায়ের আঙুলে লাল নেলপলিশ। পাশাপাশি সাজানো আঙুলগুলো মুগ্ধ করছে আমাকে ।
      বাইরে বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে আকাশজুড়ে মেঘের কালি, বাইরের সবুজে সবুজ ফাঁকা মাঠে, গাছে গাছে আঁকা জলছবি। ভিতরে ট্রেনের কামরায় বহুদিনের চেনা বান্ধবীর গভীর চোখের চাওয়া, টানটান করে সামনে ছড়িয়ে দেওয়া আদুরে শরীর আর নীচু স্বরে এতোলবেতল কথা আমাকে কেমন যেন অবশ করে দিচ্ছিল।
      আমি ওর গায়ে গা ঘেঁষে বসলাম। শিল্পীও বাধা দিলনা। 
আমার হাতটা টেনে নিল নিজের হাতে। নিজের ডানহাতের আঙুলে আমার বাঁহাতের আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আমার কাঁধে মাথা রাখল অন্যমনস্ক হয়ে। আরেকটা হাতে আমার শার্টের উপর দিয়ে বুকের মাঝখানে আঁকিবুকি কাটতে লাগল।
     আমি শিল্পীর দিকে একটু ঘুরে কানের পাশের চুলগুলো সাজাতে সাজাতে ওর গালটা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিই। বড্ড সুন্দর যে ও!
– এখন আদর করছিস! তুই আমাকে পিঠে মেরেছিলি খুব জোরে। কাউকে বলিনি আমি।
      ওকে জড়িয়ে নিয়ে কাছে টেনে কানের ওপর ঠোঁট রাখি, – স্যরি রে। ছোট ছিলাম তো, বুঝিনি। তোর খুব লেগেছিল। না রে? 
– হুঁ।
– এখন ভালোবেসে দিই একটু।
       কানের লতিতে সুড়সুড়ি লেগে মেয়েটা হাসতে থাকে। আমি ওর ক্লাচারে আটকানো একঢাল খোঁপার নীচ দিয়ে চুলে আঙুল চালিয়ে দিই। ঘাড়ে আদর পেয়ে শিল্পী আমার মধ্যে বিড়ালছানার মত ঢুকে যেতে চায়।

শান্তি, শান্তি, কতদিন পরে কাছে এলি শিল্পী...শিল্পী...থাকিস আমার কাছাকাছি.....

       আমার না-কাটা দাড়িতে ঘষে যাচ্ছিল ওর তুলতুলে ফর্সা ঘাড়, গলা। 
– ইসস দাড়ি কাটিসনি কেন? তুই ছোট থেকেই ভীষণ অগোছালো ছিলি, এখনও তাই। লাগেনা আমার?
        দু'হাতে আমার মাথা আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নেয় শিল্পী। 
ফিসফিসিয়ে ওঠে , কেন খুঁজিসনি আমাকে এতদিনেও?
আমি বলি, খুঁজেছি রে ; অনেককে জিগ্যেস করেছি। কেউ বলতে পারেনি। 
শিল্পী অভিমানী গলায় বলে, মন থেকে খুঁজলে ঠিকই পেতিস। 
        আমি ওর নরম শরীরটাকে নিজের গায়ের উপর টেনে আনি। কোমরটা চেপে ধরি, শিল্পী একটা পা তুলে দেয় আমার কোলে। ওর নরম উরুতে ঘষা খেয়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি আমি।
 ট্রেনের জানলা দিয়ে জল আসছে। ভিজে যাচ্ছি আমরা। 
        শিল্পী শিউরে ওঠে, জলে শীত করছে আমার। আমাকে জড়িয়ে থাক ঋক।
ওর গলার স্বরে কী যেন আছে। পুরু নরম ঠোঁটে ডুবে যায় আমার পুরুষালি ঠোঁট। 
উঁ উঁ আস্তে ঋক.... শিল্পীর আকুল কন্ঠ ফিকে হয়ে আসে গুরুগুরু মেঘের শব্দে।
ট্রেনটা এতক্ষণ পর নড়ে ওঠে। শিল্পী চমকে উঠে আমাকে জাপটে ধরে।

      আমার চোখের সামনে থেকে সব মুছে যায় এক লহমায়। এখন সাদা নিয়ন আলোয় ভরা একটি ফাঁকা ট্রেনের কামরা। এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম এতেও লোকজন নেই, কেবল শেষের দিক থেকে এক হকার হেঁটে এগিয়ে আসছে। হারিয়ে গেছে মেঘলা সকাল, সবুজ পাতা। শিল্পীও নেই। 

      কেবল বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি। বাইরে একদিকে অন্ধকার। অন্যদিকে একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম।
এটা কোন ট্রেন? আমাদের লাইন তো এত শুনশান নয়।
আমি হাওড়া থেকে কি ভুল ট্রেনে উঠলাম নাকি?
মাথা থেকে শিল্পীর সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘোর এখনও কাটেনি পুরোটা।
       আবার এরকম হল। গত কয়েকবছরে এই নিয়ে তিন-চারবার শিল্পীকে দেখলাম। আগেও স্বপ্নে দেখেছি, তবে রাতে বা ভোর রাতে। ভুল ট্রেনে উঠে ঘুমিয়ে পড়া এই প্রথম।

    আমাকে বসে থাকতে দেখে হকার দাদা বললেন, নামবেন না?
আমি জানতে চাইলাম, কোন স্টেশন এটা?
– মশাগ্রাম, লাস্ট স্টেশন। কী ব্যাপার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি?
বললাম , হ্যাঁ তাই হবে।
– কোথায় যাওয়ার ছিল?
– যাব তো মেন লাইনে। ভুল ট্রেনে কীরকম উঠে পড়েছি মনে হচ্ছে।
উনি বললেন, নেমে গিয়ে ডাউন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ান। আজ এত বৃষ্টি , লোকজন সেরকম নেই কোথাও।
তার ওপর ট্রেন লেট। রাত পৌনে দশটা হয়ে গেল তো। দেরি করবেন না, ডাউন ট্রেনও লেট চলছে ।
আমি নেমে পড়লাম ছাতা খুলে বৃষ্টির মধ্যেই।

     শিল্পী কেন আসে? ও তো আছে কোথাও না কোথাও, তবে এভাবে আসা কেন?
আমাকে বড্ড বিহ্বল করে রাখে যে চলে যাওয়ার অনেকগুলো ঘন্টা পরেও।
জানিনা আমার আশেপাশে এখনও সে চলে আসবে কিনা। ছাতাটা খুলে এমনভাবে ধরি যাতে সে পাশে এসে হঠাৎ দাঁড়ালে বৃষ্টিতে না ভেজে।
আপাতত সে কাছে নেই, তবে প্ল্যাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে তার গন্ধ আসছে নাকে, ট্রেনে তার ঘামেভেজা গলা থেকে এই মেয়েলি গন্ধটাই পেয়েছিলাম।

      বৃষ্টিটা ধরে আসছে। এখন টিপটিপ করে পড়ছে।
প্ল্যাটফর্মে সত্যিই লোকজন নেই। 
ডাউন প্ল্যাটফর্মে টিকিট ঘরের দিকে দুটো কুকুর লেজ গুটিয়ে ঘুমোচ্ছে। ট্রেন থেকে নামা কয়েকজন লোক ঐদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। কুকুরগুলো মাথা তুলে দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
       ওখানেই একটা বসার জায়গায় বসলাম । পকেট থেকে ফোন বার করে একটা গান শোনার ইচ্ছে হল। গানটা বহুবার শুনেছি। ছোটবেলায় স্কুলে এই গানের সঙ্গে কয়েকবার নেচেছিল শিল্পী। ছোটবয়স, কী সুন্দর নাচত মেয়েটা এই গানের সঙ্গে। এক একজনের সঙ্গে এক একটা গান সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ওর সঙ্গে সেই থেকেই তেমনি এই গানটা।
       শ্যামল মিত্র-কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ডুয়েট শুনতে লাগলাম – 'বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা'। আমার বন্ধু শিল্পী হয়তো নিজেও জানেনা এই গানটা তার সঙ্গে জুড়ে গেছে সেই কবে থেকে। বয়স বাড়ছে, গানটাও তত জড়াচ্ছে; শ্যামল-কণিকাও জড়াচ্ছেন।
       সময় অনেক হাতে। আমি ফোনটা হাতে নিয়েই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে ইতস্তত হাঁটছিলাম। গান চলতে থাকলে তবু একা থাকার বোধটা কমবে। ট্রেন আসতে দেরি আছে। 

        হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নীচে বাঁধানো বসার জায়গায় চোখ গেল। টিকিটঘরের আলো এখানেও পড়েছে কিছুটা। এখানকার আলোটা বোধহয় কেটে গেছে।
সেই আলোয় দেখি একজন মহিলা বসে আছে আমার দিকে পিছন ফিরে। কুর্তি আর লংস্কার্ট পরে আছে বলে মনে হল। পাশে একটি স্ট্রোলিব্যাগ মাটিতে নামানো। হয়তো দূরে কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু একা এখানে বসে কেন?
একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে চাইছিলাম।
পিছন থেকে গড়নটা ঠিক যেন ওর মত। 
আবার শিল্পী? এখানে? এখন? 
আমি এগোতে চাইছিলাম না। স্থির বিশ্বাস ছিল , আমি ভুল দেখছি আবার। তাও এগোতে লাগলাম সেইদিকে।
যদি সত্যি শিল্পী হয়...