মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১১০
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রারম্ভে যুধিষ্ঠিরের শিষ্ঠাচারের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রারম্ভে যুধিষ্ঠিরের শিষ্ঠাচারের কাহিনি
কুরুক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির দেখলেন, দুই পক্ষের বিশাল সেনা যুদ্ধের জন্য উদ্যত হয়েছে। তিনি তাঁর বর্ম খুলে ফেলে অস্ত্র ত্যাগ করে দ্রুত রথ থেকে নামলেন এবং শত্রুসেনার ভিতর দিয়ে হেঁটে হাত জোড় কোরে ভীষ্মের কাছে চললেন। তাঁকে এইভাবে যেতে দেখে তাঁর ভাইয়েরা, কৃষ্ণ, এবং প্রধান প্রধান রাজারা উৎকণ্ঠিত হয়ে তার অনুসরণ করলেন। ভীম ও অর্জুনাদি জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজ, আপনার উদ্দেশ্য কি? আমাদের ত্যাগ করে নিরস্ত্র হয়ে একা শত্রুসেনার দিকে কেন যাচ্ছেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন না, যেতে লাগলেন। কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, আমি এঁর উদ্দেশ্য বুঝেছি, ইনি ভীষ্ম ও দ্রোণাদি গুরুজনকে সম্মান দেখিয়ে তার পর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। শাস্ত্রে আছে, গুরুজনকে সম্মানিত করে যুদ্ধ করলে নিশ্চয় জয়লাভ হয়, আমিও তাই মনে করি।
যুধিষ্ঠিরকে আসতে দেখে দুর্যোধনের সৈন্যরা বলাবলি করতে লাগল, এই কুলাঙ্গার ভয় পেয়ে ভাইদের সঙ্গে নিয়ে ভীষ্মের শরণ নিতে আসছে। ভীম অর্জুনাদি থাকতে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে ভীত হোলো কেন? বিখ্যাত ক্ষত্রিয় বংশে নিশ্চয় এর জন্ম হয়নি। সৈন্যরা এই বলে আনন্দিত মনে আস্ফালন করতে লাগল।
ভীষ্মের কাছে এসে দুই হাতে তার পা ধরে যুধিষ্ঠির বললেন, দুর্ধর্ষ পিতামহ, আপনাকে আমন্ত্রণ করছি, আপনার সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করবো, আপনি অনুমতি দিন, আশীর্বাদ করুন। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, যদি এইভাবে আমার কাছে না আসতে তবে তোমাকে আমি পরাজয়ের জন্য অভিশাপ দিতাম। পাণ্ডুপুত্র, আমি প্রীত হয়েছি, তুমি যুদ্ধ করো, জয়ী হও, তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক। মানুষ অর্থের দাস, কিন্তু অর্থ কারও দাস নয়, এ সত্য। কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, তাই নপুংসকের মতো তোমাকে বলছি - আমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারি না। এ ছাড়া আমার কাছে তুমি আর কি চাও বলো। যুধিষ্ঠির বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ, আমার হিতের জন্য আপনি মন্ত্রণা দিন এবং কৌরবদের জন্য যুদ্ধ করুন, এই আমার প্রার্থনা। ভীষ্ম বললেন, আমি তোমার শত্রুদের পক্ষে যুদ্ধ করবো, তুমি আমার কাছে কি সাহায্য চাও? যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি অপরাজেয়, যদি আমাদের শুভকামনা করেন তবে বলুন আপনাকে কোন্ উপায়ে জয় করবো? ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির, আমাকে যুদ্ধে জয় করতে পারে এমন পুরুষ দেখি না, এখন আমার মৃত্যুকালও উপস্থিত হয় নি। তুমি আবার আমার কাছে এসো।
ভীষ্মের কাছে বিদায় নিয়ে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যের কাছে গেলেন এবং প্রণাম ও প্রদক্ষিণ কোরে বললেন, আপনাকে আমন্ত্রণ করছি, আমি নিস্পাপ হয়ে যুদ্ধ করবো, কোন উপায়ে সকল শত্রু জয় করতে পারবো তা বলুন। ভীষ্মের ন্যায় দ্রোণাচার্যও বললেন, যুদ্ধের পূর্বে যদি আমার কাছে না আসতে তবে আমি অভিশাপ দিতাম। মানুষ অর্থের দাস, অর্থ কারও দাস নয়। কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, সেজন্য নপুংসকের মতো তোমাকে বলছি - আমি কৌরবদের জন্যই যুদ্ধ করবো, কিন্তু তোমার বিজয় কামনায় আশীর্বাদ করছি। যেখানে ধর্ম সেখানেই কৃষ্ণ, যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই জয়। তুমি যাও, যুদ্ধ করো। আর যদি কিছু জানাতে চাও তো বলো। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি অপরাজেয়, যুদ্ধে কি কোরে আপনাকে জয় করবো? দ্রোণ বললেন, বৎস, আমি যখন রথে চড়ে বাণবর্ষণ করি তখন আমাকে বধ করতে পারে এমন লোক দেখি না। আমি যদি অস্ত্র ত্যাগ কোরে অচেতনপ্রায় হয়ে মরণের প্রতীক্ষা করি তবেই আমাকে বধ করা যেতে পারে। যদি কোনও বিশ্বস্ত পুরুষ আমাকে অত্যন্ত দুঃসংবাদ দেয় তবে আমি যুদ্ধকালে অস্ত্র ত্যাগ করি — তোমাকে এই কথা সত্য বলছি।
তারপর যুধিষ্ঠির কৃপাচার্যের কাছে গেলেন। তিনিও ভীষ্ম-দ্রোণের ন্যায় নিজের পরাধীনতা জানিয়ে বললেন, যুধিষ্ঠির, আমি অবধ্য, তথাপি তুমি যুদ্ধ করো, জয়ী হও। তোমার আগমনে আমি প্রীত হয়েছি। সত্য বলছি, আমি প্রত্যহ নিদ্রা থেকে উঠে তোমার বিজয় কামনা করবো।
তারপর যুধিষ্ঠির শল্যের কাছে গিয়ে তাকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করলেন। শল্যও বললেন, তোমার সম্মান প্রদর্শনে আমি প্রীত হয়েছি, তুমি না এলে আমি শাপ দিতাম। আমি কৌরবগণের বশীভূত, তোমাকে কি ভাবে সাহায্য করবো বলো। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি আমাকে পূর্বে বর দিয়েছিলেন যে যুদ্ধকালে কর্ণের তেজ নষ্ট করবেন, আপানি সেই কাজই করবেন। শল্য বললেন, তোমার কামনা পূর্ণ হবে, তুমি যাও, যুদ্ধ করো, তুমি নিশ্চয় জয়ী হবে।
কৌরব সৈন্যদের থেকে বেরিয়ে এসে যুধিষ্ঠির তাঁর ভাইদের সঙ্গে ফিরে গেলেন। তখন কৃষ্ণ কর্ণের কাছে গিয়ে বললেন, শুনেছি তুমি ভীষ্মের প্রতি বিদ্বেষের জন্য এখন যুদ্ধ করবে না। যত দিন ভীষ্ম না মরেন তত দিন তুমি আমাদের পক্ষে থাকো। ভীষ্মের মৃত্যুর পর যদি দুর্যোধনকে সাহায্য করা উচিত মনে করো তবে আবার কৌরবপক্ষে যেয়ো। কর্ণ বললেন, আমি দুর্যোধনের অপ্রিয় কোনো কাজ করবো না। আমি তার হিতৈষী, তার জন্য আমি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।
কৃষ্ণ পাণ্ডবদের কাছে ফিরে গেলেন। তারপর যুধিষ্ঠির কৌরব পক্ষের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে উচ্চকণ্ঠে বললেন, যিনি আমাদের সাহায্য করতে চান তাকে আমি বরণ করে নেবো। এই কথা শুনে যুযুৎসু বললেন, যদি আমাকে নেন তবে আমি কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। যুধিষ্ঠির বললেন, যুযুৎসু, চলে এস, আমরা সকলে মিলে তোমার নির্বোধ ভাইদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো, কৃষ্ণ ও আমরা সবাই তোমাকে বরণ করছি। দেখছি তুমিই ধৃতরাষ্ট্রের বংশ রক্ষা করবে।
ভাইদের ত্যাগ করে যুযুৎসু দুন্দুভি বাজিয়ে পাণ্ডবসৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠিরাদি আবার বর্ম ধারণ করে রথে উঠলেন, রণবাদ্য বেজে উঠল, বীরগণ সিংহনাদ করলেন। পাণ্ডবগণ মান্যজনকে সম্মানিত করেছেন দেখে সকলেই তাদের প্রশংসা করতে লাগলেন।
______________
(ক্রমশ)