Story of Mahabharat - Part-109 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 109

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 109

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০৯

ভগবদ্গীতা – অর্জুনকে কৃষ্ণ কর্তৃক উপদেশের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভগবদ্গীতা – অর্জুনকে কৃষ্ণ কর্তৃক উপদেশের কাহিনি

যুদ্ধস্থলে পৌঁছানোর পর দুর্যোধন দ্ৰোণকে বললেন, আচার্য, পাণ্ডুপুত্রগণের বিপুল সেনা দেখুন, ধৃষ্টদুম্ন্য ওদের সারিবদ্ধ করেছেন। ওখানে সাত্যকি, বিরাট, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, করুণীজ প্রভৃতি এবং অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ সকল মহারথই আছেন। আমাদের পক্ষে আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, ভূরিশ্রবা প্রভৃতি যুদ্ধ-বিশারদ বহু বীর রয়েছেন, আপনারা সকলেই আমাদের জন্য জীবনত্যাগে প্রস্তুত। এখন আপনারা সম্মিলিত ভাবে ভীষ্মকে রক্ষা করুন।

এমন সময় পিতামহ ভীষ্ম তীব্র আওয়াজে শঙ্খ বাজালেন। তখন ভেরী, পণব, আনক প্রভৃতি রণবাদ্য তুমুল শব্দে বেজে উঠল। কৃষ্ণ তাঁর পাঞ্চজন্য শঙ্খ এবং অর্জুন দেবদত্ত নামক শঙ্খ বাজালেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতিও নিজ নিজ শঙ্খ বাজালেন। সেই আওয়াজ আকাশ ও পৃথিবী কম্পিত কোরে দুর্যোধনাদির হৃদয় যেন বিদীর্ণ করে দিলো। যুদ্ধ আসন্ন জেনে অর্জুন তাঁর সারথি কৃষ্ণকে বললেন, দুই সেনার মধ্যে আমার রথ রাখো, কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে আমি দেখবো।

কৃষ্ণ কুরুপাণ্ডব সেনার মধ্যে রথ নিয়ে গেলেন। দুই পক্ষেই পিতা ও পিতামহ স্থানীয় গুরুজন, আচার্য, মামা, শ্বশুর, ভাই, পুত্র ও সুহৃদগণ রয়েছেন দেখে অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এই সব স্বজনদেরকে দেখে আমার সর্বাঙ্গ অবসন্ন হচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, শরীর কাঁপছে, হাত থেকে গাণ্ডীব পড়ে যাচ্ছে। আমি বিজয় চাই না, যাঁদের জন্য লোকে রাজ্য ও সুখ কামনা করে তারাই যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে এসেছেন। স্বজন বধ করে আমাদের কোন্ সুখ হবে? হায়, আমরা রাজ্যের লোভে মহাপাপ করতে উদ্যত হয়েছি। যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ আমাকে নিরস্ত্র অবস্থায় বধ করে তাও আমার পক্ষে শ্রেয় হবে। এই বলে অর্জুন ধনুর্বাণ ত্যাগ করে রথের মধ্যে বসে পড়লেন।

বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, এই সংকটকালে তুমি মোহগ্রস্ত হলে কেন? নপুংসক হয়ো না, মানসিক দৌর্বল্য ত্যাগ করো। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণকে আমি কি করে শরাঘাত করবো? মহানুভব গুরুজনকে হত্যা করা অপেক্ষা ভিক্ষার অন্ন ভোজন করাও শ্রেয়। আমি ধর্ম-অধর্ম বুঝতে পারছি না, আমাকে উপদেশ দাও, আমি তোমার শরণাপন্ন।

কৃষ্ণ বললেন, যারা তোমাদের শত্রু তাদের জন্য তুমি শোক করছ আবার জ্ঞানীদের মতো কথাও বলছ। মৃত বা জীবিত কারও জন্য পণ্ডিতগণ শোক করেন না -

দেহিনোঽস্মিন্যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা। 

তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি॥

মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ। 

আগমাপায়িনোঽনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত॥

যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।

সমদুঃখসুখং ধীরং সোঽমৃতত্বায় কল্পতে॥

নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ। 

উভয়োরপি দৃষ্টোঽন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ॥

অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্। 

 বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিত্কর্তুমর্হতি ॥

অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ। 

অনাশিনোঽপ্রমেয়স্য তস্মাদ্যুধ্যস্ব ভারত॥

য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্। 

উভৌ তৌ ন বিজানীতো নাযং হন্তি ন হন্যতে॥

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥

বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্। 

অথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্॥

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী॥

- দেহধারী আত্মার যেমন এই দেহে কৌমার্য যৌবন জরা হয়, তেমন দেহান্তর প্রাপ্তি ঘটে। ধীর ব্যক্তি তাতে মোহগ্রস্ত হন না। যার দ্বারা এই সমস্ত বিশ্ব ব্যাপ্ত তাঁকে অবিনাশী জেনো। কেউ এই অব্যয়ের বিনাশ করতে পারে না। ইনি কখনও জন্মেন না বা মরেন না, অথবা একবার জন্মগ্রহণ কোরে আবার জন্মাবেন না-এও নয়। ইনি জন্মহীন নিত্য অক্ষয় অনাদি। শরীর হত হলে এই আত্মা হত হন না। মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ কোরে অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, তেমন আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ কোরে অন্য নতুন শরীর পান।

জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।

তস্মাদপরিহার্যেঽর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি॥

অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।

অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিবেদনা॥

আশ্চর্যবত্পশ্যতি কশ্চিদেনমাশ্চর্যবদ্বদতি তথৈব চান্যঃ।

আশ্চর্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিত্॥

দেহী নিত্যমবধ্যোঽয়ং দেহে সর্বস্য ভারত।

তস্মাত্সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি॥

স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।

ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োঽন্যত্ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে॥

যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্।

সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্॥

অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।

ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি॥

- যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চয় হবে এবং মৃতব্যক্তি নিশ্চয় পুনর্বার জন্মাবে। অতএব এই অপরিহার্য বিষয়ে তুমি শোক করতে পার না। হে ভারত, জীবসকল জন্মের পূর্বে অব্যক্ত, জীবিতকালে ব্যক্ত, মরণের পর অব্যক্ত। তবে কিসের খেদ? আর, তোমার স্বধর্ম বিচার করেও তুমি বিরত হতে পার না, কারণ ধর্মযুদ্ধের চেয়ে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয় কিছু নেই। উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার আপনা থেকেই উপস্থিত হয়েছে, সুখী ক্ষত্রিয়রাই এমন যুদ্ধ লাভ করেন। যদি তুমি এই ধর্মযুদ্ধ না করো তবে স্বধর্ম ও কীর্তি হারিয়ে পাপগ্রস্ত হবে। যদি হত হও তবে স্বর্গ পাবে, যদি জয়ী হও তবে পৃথিবীর রাজ্য ভোগ করবে। অতএব হে অর্জুন, যুদ্ধে উদ্যমী হয়ে গাত্রোত্থান করো। সুখ-দুঃখ লাভ-অলাভ জয়-পরাজয় সমান জ্ঞান করে যুদ্ধে নিযুক্ত হও, এরূপ করলে তুমি পাপগ্রস্ত হবে না।

তারপর কৃষ্ণ বললেন, এখন আমি কর্মযোগ অনুসারে ধর্মতত্ত্ব বলছি শোন, এই ধর্ম মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। সকল বেদ ত্রিগুণাত্মক পার্থিব বিষয়ের বর্ণনায় পূর্ণ, তুমি ত্রিগুণ অতিক্রম কোরে রাগদ্বেষাদির অতীত, সঞ্চয় ও রক্ষণে নিস্পৃহ এবং আত্মনির্ভরশীল হও।–

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি॥

যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।

সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে॥

- কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মের ফলে কখনও নয়। কর্মের ফল কামনা করো, নিষ্কর্মা হয়ো না। অর্জুন, যোগস্থ হয়ে আসক্তি ত্যাগ করে সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমান হয়ে কর্ম কর। সমতাকেই যোগ বলা হয়।

যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তোঽনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেঽপি কর্মভিঃ॥

যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্। 

সর্বজ্ঞানবিমূঢাংস্তান্বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ॥

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।

প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিম করিষ্যতি॥

ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ। 

তযোর্ন বশমাগচ্ছেত্তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ॥

শ্রেয়ান্স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাত্স্বনুষ্ঠিতাত্।

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ॥

- শ্রেষ্ঠ পুরুষ যে যে আচরণ করেন সাধারণ মানুষও তেমন করে। তিনি যা প্রমাণ বা পালনীয় গণ্য করেন লোকে তারই অনুসরণ করে। অর্জুন, ত্রিলোকে আমার কিছুই কর্তব্য নেই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্যও নেই, তথাপি আমি কর্মে নিযুক্ত আছি। স্বধর্ম যদি গুণহীনও হয় তবুও তা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্মের চেয়ে শ্রেয়। স্বধর্মে নিধনও ভাল, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ।

অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্।      
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সংভবাম্যাত্মমায়যা॥

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।      
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।      
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥

- জন্মহীন অবিকারী এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হয়েও আমি স্বীয় প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান কোরে আপনার মায়াবলে জন্মগ্রহণ করি। হে ভারত, যখন যখন ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভূত্থান হয় তখন আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতগণের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

কৃষ্ণ পরমার্থ ষয়ক বহু উপদেশ দিলেন এবং অর্জুনের অনুরোধে নিজের বিশ্বরূপ প্রকাশ করলেন। বিস্ময়ে অভিভূত ও রোমাঞ্চিত হয়ে অর্জুন হাত জোড় কোরে বললেন -

পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসংঘান্।

ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থমৃষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্॥

অনেকবাহূদরবক্ত্রনেত্রং পশ্যামি ত্বাং সর্বতোঽনন্তরূপম্।

নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপম্॥

- হে দেবশ্রেষ্ঠ, তোমার দেহে সমস্ত দেবগণ, বিভিন্ন প্রাণী, কমলাসন ব্রহ্মা, সমস্ত ঋষিগণ এবং দিব্য উরগগণকে দেখছি। হে বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ, অনেক বাহু উদর মুখ চোখ বিশিষ্ট অনন্তরূপ তোমাকে সর্বত্র দেখছি, কিন্তু তোমার অন্ত মধ্য বা আদি দেখতে পাচ্ছি না।

দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি দৃষ্ট্বৈব কালানলসংনিভানি।

দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস॥

অমী চ ত্বাং ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ সর্বে সহৈবাবনিপালসংঘৈঃ।

ভীষ্মো দ্রোণঃ সূতপুত্রস্তথাসৌ সহাস্মদীয়ৈরপি যোধমুখ্যৈঃ॥

বক্ত্রাণি তে ত্বরমাণা বিশন্তি দংষ্ট্রাকরালানি ভয়ানকানি।

কেচিদ্বিলগ্না দশনান্তরেষু সংদৃশ্যন্তে চূর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ॥

- করাল দাঁতবিশিষ্ট কালানলের মতো তোমার মুখসকল দেখে দিক জানতে পারছি না, সুখও পাচ্ছি না। হে দেবেশ, প্রসন্ন হও। ওই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, রাজাদের সঙ্গে ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ এবং তাঁদের সঙ্গে আমাদের মুখ্য যোদ্ধারাও তোমার দিকে ধাবিত হয়ে তোমার করাল ভয়ানক মুখসমূহে প্রবেশ করছে। কেউ বা চূর্ণিত মস্তকে তোমার দশনের অন্তরালে বিলগ্ন দেখা যাচ্ছে।

যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতঙ্গা

বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ।

তথৈব নাশায় বিশস্তি লোকা

স্তবাপি বক্ৰাণি সমৃদ্ধবেগাঃ ৷৷

লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমন্তা

লোকান্ সমগ্রান্ বদনৈর্ভূলভিঃ।।

তেজোভিরাপূৰ্য জগৎ সমগ্রং

ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো।

আখ্যাহি মে কো ভবানুগ্ররূপে

নমোহস্তুতে দেববর প্রসীদ।।

বিজ্ঞতুমিচ্ছামি ভবন্তমাদ্যং

ন হি প্রজানামি তব প্রবৃত্তি ৷৷

- পতঙ্গগণ যেমন বিনাশের জন্য জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করে তেমন সমস্ত প্রাণী বিনাশের জন্য দ্রুতবেগে তোমার মুখসমূহে প্রবেশ করছে। তুমি জ্বলন্ত মুখে সমস্ত দিক থেকে সবাইকে গ্রাস করতে করতে লেহন করছ। বিষ্ণু, তোমার উগ্র প্রভা সমস্ত জগতকে তেজে সন্তপ্ত করছে। কে তুমি উগ্ররূপ? তোমাকে নমস্কার। হে দেবেশ, প্রসন্ন হও। আদিস্বরূপ তোমাকে জানতে ইচ্ছা করি, তোমার প্রকৃতি বুঝতে পারছি না।

তখন কৃষ্ণ বললেন, আমি লোকক্ষয়কারী কাল। এখানে যে যোদ্ধারা সমবেত হয়েছে, তুমি না মারলেও তারা মরবে। আমি পূর্বেই তাদের মেরেছি। অর্জুন, তুমি নিমিত্ত মাত্র। ওঠ, যশোলাভ করো, শত্রু জয় কোরে সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ করো।

অর্জুন বললেন, হে দেবশ্রেষ্ঠ, তোমাকে সহস্রবার নমস্কার করি। তোমার মহিমা না জেনে প্রমাদবশে বা প্রণয়বশে তোমাকে কৃষ্ণ, যাদব ও সখা বলে সম্বোধন করেছি, বিহার ভোজন ও শয়ন কালে উপহাস করেছি, সে সমস্ত ক্ষমা করো। তোমার অদৃষ্টপূর্ব রূপ দেখে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি, ভয়ে আমার মন ব্যথিত হয়েছে, তুমি প্রসন্ন হও, পূর্বরূপ ধারণ করো।

কৃষ্ণ তার স্বাভাবিক রূপ গ্রহণ করলেন এবং আরও বহু উপদেশ দিয়ে পরিশেষে বললেন, অর্জুন, যদি অহংকারবশে মনে করো যে যুদ্ধ করবো না, তবে সে সংকল্প মিথ্যা হবে, তোমার প্রকৃতিই তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবে। আমি করছি — এই ভাব যাঁর নেই তার বুদ্ধি কর্মে আসক্ত হয় না, তিনি সর্বলোক হত্যা করেও হত্যা করেন না। ঈশ্বর হৃদয়ে অধিষ্ঠান করে সর্বভূতকে যন্ত্রের ন্যায় চালিত করেন, তুমি তাঁর শরণ নাও।

মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।      
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে॥

সর্বধর্মান্পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। 
অহং ত্বা সর্বপাপেভ্যো মোক্ষযিষ্যামি মা শুচঃ॥

- আমাকে তোমার মন সমর্পণ করো, আমার ভক্ত ও উপাসক হও, আমাকে নমস্কার করো। তুমি আমার প্রিয়, তোমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি - তুমি আমাকেই পাবে। সর্ব ধর্ম ত্যাগ কোরে একমাত্র আমাকে শরণ কোরে চলো, আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবো, শোক কোরো না।

অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, আমার মোহ বিনষ্ট হয়েছে, তোমার প্রসাদে আমি ধর্মজ্ঞান লাভ করেছি, আমার সন্দেহ দূর হয়েছে, তোমার আদেশ আমি পালন করব।

______________

(ক্রমশ)