Story of Mahabharat Part 91 Story of visiting Krishna with Kunti Duryodhan and Bidur in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 91

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 91

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯১

কৃষ্ণের সঙ্গে কুন্তী, দুর্যোধন ও বিদুরের সাক্ষাৎকারের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কৃষ্ণের সঙ্গে কুন্তী, দুর্যোধন ও বিদুরের সাক্ষাৎকারের কাহিনি

হস্তিনাপুরে গিয়ে কৃষ্ণ কুন্তীর সঙ্গে দেখা করলে কুন্তী কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বৎস, আমার পুত্রেরা বাল্যকালেই পিতৃহীন হয়েছিল, আমিই তাদের পালন করেছিলাম। আগে যারা রাজার ঐশ্বর্যের মধ্যে সুখে বাস করতো তারা কি করে তেরো বছর বনবাসের কষ্ট সহ্য করতে পারল? যাদের না দেখে আমি এক মূহুর্ত থাকতে পারতাম না সেই যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, সহদেব, নকুল কেমন আছে? যে আমার সকল পুত্র অপেক্ষা প্রিয়, যে কুরুসভায় নিগৃহীত হয়েছিল, সেই কল্যাণী দ্রৌপদী কেমন আছে? আমি দুর্যোধনের দোষ দিচ্ছি না, বরং নিজের পিতারই নিন্দা করি। বাল্যকালে যখন আমি খেলা করতাম তখন তিনি কেন আমাকে কুন্তিভোজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন? আমি আমার পিতা ও ভাশুর ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক বঞ্চিত হয়েছি, আমার বেঁচে থেকে লাভ কি? অর্জুনের জন্মকালে দৈববাণী হয়েছিল,এই পুত্র পৃথিবীজয়ী হবে, এর যশ ত্রিভুবনে ব্যাপ্ত হবে। কৃষ্ণ, যদি ধর্ম থাকে, তবে যাতে সেই দৈববাণী সফল হয় তার চেষ্টা করো। অর্জুন আর ভীমকে বলো, ক্ষত্রিয় নারী যে জন্য পুত্র প্রসব করে তার উপয়ুক্ত সময় উপস্থিত হয়েছে। এই সময় যদি বৃথা নষ্ট করো তবে তা অত্যন্ত অশুভ হবে। উপযুক্ত সময় উপস্থিত হলে জীবনত্যাগও করতে হয়, তোমরা যদি নীচ কর্ম করো তবে চিরকালের জন্য আমি তোমাদের ত্যাগ করবো। নকুল ও সহদেবকে বলো, তোমরা যুদ্ধ দ্বারা অর্জিত সম্পদ ভোগ করো, প্রাণের মায়া করো না। অর্জুনকে বলো, সে যেন দ্রৌপদী যেমন চায় তেমনই করে।

কুন্তীকে সান্ত্বনা দিয়ে কৃষ্ণ বললেন, আপনার ন্যায় মহীয়সী কে আছেন? হংসী যেমন এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে আসে তেমন আপনার পিতা শূরের বংশ থেকে আপনি কুন্তিভোজের বংশে এসেছিলেন। আপনি বীরপত্নী, বীরজননী। আপনি শীঘ্রই আপনার পুত্রদের নীরোগ সফল শত্রুহীন ও পৃথিবীর অধিপতি হোতে দেখবেন।

কুন্তীর নিকট বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ দুর্যোধনের ভবনে গেলেন। সেখানে দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি এবং নানা দেশের রাজারা ছিলেন। দুর্যোধনের দ্বারা সংবর্ধনার পর কৃষ্ণ আসনে বসলে দুর্যোধন তাকে ভোজনের জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু কৃষ্ণ রাজি হলেন না। দুর্যোধন কৃষ্ণকে বললেন, তোমার জন্য যে খাদ্য, পানীয়, বসন ও শয্যার আয়োজন করা হয়েছে তা তুমি নিলে না কেন? তুমি কৌরব ও পাণ্ডব দুই পক্ষেরই হিতাকাঙক্ষী ও আত্মীয়, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয়, তবুও আমাদের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান করলে কেন?

কৃষ্ণ দুর্যোধনকে গম্ভীর স্বরে বললেন, দূত কৃতকার্য হলে ভোজন ও পূজা গ্রহণ করে। দুর্যোধন বললেন, এমন কথা বলা তোমার উচিত নয়, তুমি কৃতকার্য বা অকৃতকার্য যাই হও আমরা তোমাকে পূজা করবার জন্য আগ্রহান্বিত হয়ে আছি, তোমার সঙ্গে আমাদের শত্রুতা বা কলহ নেই, তবে আপত্তি করছ কেন? ঈষৎ হেসে কৃষ্ণ বললেন, সম্প্রীতি থাকলে অথবা বিপদে পড়লে পরের অন্ন খাওয়া যায়। তুমি আমাদের উপর খুশি নও, আমি বিপদেও পড়ি নি। শত্রুর অন্ন খাওয়া অনুচিত, তাকে অন্ন দেওয়াও অনুচিত। তুমি পাণ্ডবদের হিংসা করো, কিন্তু তারা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। যে পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা করে সে আমার সঙ্গেও শত্রুতা করে, যে তাঁদের প্রিয় সে আমারও প্রিয়। তোমার অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য তোমার অন্ন দূষিত, তা আমার পক্ষে গ্রহণ করা উচিৎ নয়, আমি কেবল বিদুরের অন্নই খেতে পারি।

তার পর কৃষ্ণ বিদুরের ভবনে গেলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি সেখানে গিয়ে বললেন, কৃষ্ণ, তোমার থাকবার জন্য সুসজ্জিত ভবন প্রস্তুত করছি। কৃষ্ণ বললেন, আপনাদের আগমনেই আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি, কিন্তু আমি রাতে বিদুরের ভবনে থাকবো। ভীষ্মাদি চলে গেলে বিদুর নানা রকম সুস্বাদু ও উপাদেয় খাদ্য এবং পানীয় এনে বললেন, কৃষ্ণ এতেই খুশি হও, তোমার যোগ্য সমাদর করার সাধ্য আমার নেই? ব্রাহ্মণগণকে নিবেদন কোরে কৃষ্ণ তার অনুচরদের সঙ্গে বিদুরের দেওয়া অন্ন ভোজন করলেন।

রাতে বিদুর কৃষ্ণকে বললেন, এখানে আসা তোমার উচিত হয়নি। দুর্যোধন অধার্মিক, ক্ৰোধী, দুর্বিনীত ও মূর্খ। সে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতির ভরসায় এবং বহু সেনা সংগ্রহ করে নিজেকে অজেয় মনে করে। যার হিতাহিত জ্ঞান নেই তাকে কিছু বলা বধিরকে গান শোনানোর সমান। দুর্যোধন তোমার কথা শুনবে না। নানা দেশের রাজারা সসৈন্যে কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে পূর্বে তোমার শত্রুতা ছিল, পরাজিত কোরে যাঁদের ধন তুমি হরণ করেছ, তারা সকলেই এখানে এসেছেন। কৌরবসভায় এইসকল শত্রুদের মধ্যে তুমি কি করে যাবে? পাণ্ডবদের উপর আমার যে প্রীতির সম্পর্ক আছে তারও অধিক প্রীতির সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আছে, সেজন্যই এই কথা বলছি।

কৃষ্ণ বিদুরকে বললেন, আপনার কথা মহাপ্রাজ্ঞ বিচক্ষণ এবং পিতামাতার মতো হিতৈষী ব্যক্তিরই উপযুক্ত। আমি দুর্যোধনের দুষ্ট স্বভাব এবং তার অনুগত রাজাদের শত্রুতা জেনেও এখানে এসেছি। মৃত্যুর বন্ধন থেকে পৃথিবীকে যে মুক্ত করতে পারে সে মহান ধর্ম লাভ করে। মানুষ যদি ধর্মসঙ্গত কাজে যথাসাধ্য চেষ্টা করে তবে তা সম্পন্ন করতে না পারলেও তার পুণ্য হয়। আবার, কেউ যদি মনে মনে পাপচিন্তা করে কিন্তু পাপকর্ম করে না, তা হলেও সে পাপের ফল পায়। আমি কৌরব ও পাণ্ডবের মধ্যে শান্তি স্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করবো, যাতে তারা যুদ্ধে বিনষ্ট না হন। জ্ঞাতিদের মধ্যে বিভেদ হলে যিনি সর্বতোভাবে মধ্যস্থতা না করেন তাকে মিত্র বলা যায় না। আমি শান্তির চেষ্টা করলে কোনও শত্রু বা মূর্খ লোক বলতে পারবে না যে কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ কৌরব ও পাণ্ডবদেরকে বারণ করেননি। দুর্যোধন যদি আমার ধর্মসম্মত হিতকর কথা না শোনেন তবে তিনি ধ্বংস হবেন।

______________

(ক্রমশ)