মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯২
শান্তি প্রস্তাব নিয়ে কৌরবসভায় কৃষ্ণের বক্তব্য পেশের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
শান্তি প্রস্তাব নিয়ে কৌরবসভায় কৃষ্ণের বক্তব্য পেশের কাহিনি
রাতে বিদুরের ভবনে কৃষ্ণ বিশ্রাম নিয়ে পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর দুর্যোধন ও শকুনি তাঁর কাছে এসে বললেন, মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্ম প্রভৃতি তোমার প্রতীক্ষা করছেন। কৃষ্ণ আগুন ও ব্রাহ্মণদেরকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং কৌস্তুভ মণি ধারণ করে বিদুরকে নিয়ে রথে উঠলেন। দুর্যোধন, শকুনি এবং সাত্যকি প্রভৃতি অন্য রথে তাকে অনুসরণ করলেন। বহু অস্ত্রধারী সৈন্য কৃষ্ণের আগে এবং বহু হাতি ও রথ তার পিছনে চলতে থাকল। রাজসভার নিকট এসে কৃষ্ণের অনুচরগণ শঙ্খ বাজালে বিদুর ও সাত্যকির হাত ধরে কৃষ্ণ সভাদ্বারে রথ থেকে নামলেন। তিনি সভায় প্রবেশ করলে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণাদি এবং সমস্ত রাজারা সসম্মানে উঠে দাঁড়ালেন।
ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে একটি স্বর্ণভূষিত অতি উত্তম আসন কৃষ্ণের জন্য রাখা ছিল। সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করে কৃষ্ণ ভীষ্মকে বললেন, নারদ এবং অন্যান্য ঋষিগণ অন্তরীক্ষে রয়েছেন। তারা এই রাজসভা দেখতে এসেছেন, তাদেরকে সংবর্ধনা করে আসন দিন, তারা না বসলে আমরা কেউ বসতে পারি না। ভীষ্মের আদেশে ভৃত্যেরা মহামূল্যবান বহু আসন নিয়ে এলে ঋষিরা তাতে বসলেন।
কৃষ্ণের আসন স্পর্শ করে বিদুর একটি মৃগচর্মে ঢাকা মণিময় বেদীতে বসলেন। কর্ণ ও দুর্যোধন কৃষ্ণের কাছাকাছি একই আসনে বসলেন। সভা কিছুক্ষণ নীরব থাকার পরে গম্ভীর কণ্ঠে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করে বললেন, যাতে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে শান্তি হয় এবং অসংখ্য মানুষের বিনাশ না হয় তার জন্য আমি প্রার্থনা করতে এসেছি। আপনাদের বংশ সকল রাজবংশের শ্রেষ্ঠ, এই মহাবংশে কোনও অন্যায় কাজ হওয়া উচিত নয়। দুর্যোধনাদি আপনার পুত্রগণ অশিষ্ট, মর্যাদাজ্ঞানশূন্য ও লোভী, এঁরা ধর্মের পথ বর্জন কোরে নিজের শ্রেষ্ঠ ধার্মিক আত্মীয়দের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন। কৌরবগণের ঘোর বিপদ উপস্থিত হয়েছে, আপনি যদি উপেক্ষা করেন তবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি ইচ্ছা করলেই এই বিপদ আটকাতে পারেন। মহারাজ, যদি পুত্রদের শাসন করেন এবং সন্ধির জন্য যত্নবান হন তবে দুই পক্ষেরই মঙ্গল হবে। পাণ্ডবগণ যদি আপনার রক্ষক হন তবে ইন্দ্রও আপনাকে জয় করতে পারবেন না। যে পক্ষে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ প্রভৃতি আছেন সেই পক্ষে যদি পঞ্চপাণ্ডব ও সাত্যকি প্রভৃতি যোগ দেন তবে কেউ তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইবে না। কৌরব ও পাণ্ডবগণ মিলিত হলে আপনি অজেয় ও পৃথিবীর অধিপতি হবেন, প্রবল রাজারাও আপনার সঙ্গে সন্ধি করবেন। পাণ্ডবগণ অথবা আপনার পুত্রগণ যুদ্ধে নিহত হলে আপনার কি সুখ হবে বলুন। পৃথিবীর সকল রাজা যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়েছেন, তারা ক্রুদ্ধ হয়ে সৈন্য ধ্বংস করবেন। মহারাজ, এই প্রজাদেরকে আপনি রক্ষা করুন, আপনি ধর্মের পথে থেকে শান্তি স্থাপন করলে এরা জীবিত থাকবে। এরা নিরপরাধ, দাতা, লজ্জাশীল, সজ্জন, সদ্বংশীয়, এবং পরস্পরের মিত্র, আপনি মহাভয় থেকে এদের রক্ষা করুন। এই রাজারা, যাঁরা এখানে সমবেত হয়েছেন, এঁরা ক্রোধ ও শত্রুতা ত্যাগ কোরে পানভোজনে তৃপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যান। পিতৃহীন পাণ্ডবগণ আপনার আশ্রয়ে থেকে বড় হয়েছিলেন, আপনি এখনও তাদের পুত্রের মতো পালন করুন। পাণ্ডবগণ আপনাকে এই কথা বলেছেন, আপনার আদেশে আমরা বারো বছর বনবাসে এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে থেকে বহু দুঃখ ভোগ করেছি, তথাপি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিনি। আপনি আমাদের পিতার তুল্য, আপনিও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন, আমাদের প্রাপ্য রাজ্যের ভাগ দিন। আমরা সকলে বিপথে চলেছি, আপনি পিতা হয়ে আমাদের সৎপথে আনুন, নিজেও সৎপথে থাকুন। পাণ্ডবরা এই সভাসদগণের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এঁরা ধর্মজ্ঞ, যেন অন্যায় কাজকে সমর্থন না করেন। যে সভায় অধর্ম ধর্মকে এবং অসত্য সত্যকে দমন করে সেখানকার সভাসদগণও বিনষ্ট হন।
তার পর কৃষ্ণ বললেন, এই সভায় যে সকল রাজা উপস্থিন আছেন তারা বলুন আমার কথা ধর্মসংগত ও হিতকর কিনা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনি ক্ষত্রিয়গণকে অকাল মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করুন, ক্রোধের বশীভূত হবেন না। অজাতশত্রু ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আপনার সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করেছেন তা আপনি জানেন। জতুগৃহ দাহের পর তিনি আপনার আশ্রয়েই ফিরে এসেছিলেন। আপনি তাকে ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সকল রাজাকে বশে এনে আপনারই অধীন করেছিলেন, আপনার মর্যাদা লঙ্ঘন করেন নি। তার পর শকুনি কপট পাশা খেলায় তার সর্বস্ব হরণ করেছিলেন। সে অবস্থাতেও এবং দ্রৌপদীর নিগ্রহ দেখেও যুধিষ্ঠির ধৈর্য্য হারাননি। মহারাজ, পাণ্ডবগণ আপনার সেবা করতে প্রস্তুত, যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। আপনি যা উভয় পক্ষের জন্য হিতকর মনে করেন তাই করুন।
______________
(ক্রমশ)