মানুষ যখন কোন সৃষ্টিশীল কর্মে ব্যাস্ত থাকে,- তখন সে আনন্দে থাকে। যত আনন্দে থাকে,- ততই শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে।
তেমনি যখন কেউ সম্মান পায়, সমাদর পায়, কোন দায়ীত্বপূর্ন কাজে ব্যাস্ত থাকে, কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মরত থাকে,পরিবারে-সমাজে-সন্তানসন্ততির কাছে গূরত্ব পায়,- তখন তার সময় খুব ভাল কাটে, খুব সুখে থাকে সে, নিজের জীবনকে খুব গুরত্বপূর্ণ মনে হয়।
যার জীবনে কোন উদ্দেশ্য নেই, কর্মব্যাস্ততা নেই, সৃষ্টিশীলতা নেই, - তার জীবন বড় অসহনীয় হয়ে পড়ে৷ যার জীবন অন্য মানুষের কোন উপকারে লাগেনা,- সে মানুষ নিজেকে খুব গূরত্বহীন ও একা ভাবতে শুরু করে। এইভাবে চলতে চলতে সে মানসিক অবসাদ ও জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে নানান অসুখে ভুগতে শুরু করে।
তাই সুস্থ থাকার মূল উপায় হচ্ছে,- আনন্দে থাকা, কর্মব্যস্ত থাকা, সৃষ্টিশীলতা বজায় রাখা, মানুষের উপকারে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা, একটা উদ্দেশ্য পূরনে নিজেকে নিয়োজিত করা, নিজের জীবনকে গূরত্ব দেওয়া৷
বয়স পয়সট্টি -সত্তর অব্দি, - বিশেষ করে চাকুরিজীবীদের, জীবন বেশ কেটে যায়। যারা গুরত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন বা বিশেষ দায়ীত্ব নিয়ে থাকেন,- তারা খুব কর্মব্যাস্ততায় দিনগুলি অতিবাহিত করতে থাকেন, সবার কাছে সম্মান, ভালবাসা, সমাদর, গূরত্ব ও কতৃত্ব পেয়ে নিজের জীবনটাকে বেশ গুরত্বপূর্ণ ভাবেন। যারা চাকরি করেন না,- তারাও সংসারে, সন্তানসন্ততিদের কাছে, সমাজে, পরিবেশীদের কাছে, ব্যাবসায়, কাজে বেশ গুরত্বপূর্ণ হয়ে থাকেন, বিশেষ দায়ীত্বে ব্যাস্ত থাকেন, নিজের কতৃত্ব থাকে। দিনগুলো বেশ কেটে যায়। পরিবারের গৃহবধূ মায়েরা সন্তান সন্ততিতের মানুষ করতে, স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ীদের সেবাযত্নে খুব কর্মব্যস্ত জীবন কাটাতে থাকেন।
সমস্যা শুরু হয় পয়ষট্টি-সত্তর বৎসর বয়সের পর। যারা চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করেন,- তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা বেশী হয়৷ হঠাৎ করে একদিন তারা কর্মব্যস্ততা হারিয়ে ফেলেন, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সারাদিনের কোন উদ্দেশ্য খুঁজে পাননা, অফুরন্ত সময়, এতদিন অফিসে যে দায়ীত্ব-কতৃত্ব-গূরত্ব পেয়ে এসেছেন,- তা হারিয়ে যায়৷ তখন শুরু হয় একাকীত্ব, অবসাদ, এক ঘেয়েমি জীবন, গূরত্বহীন জীবন। এই অবসাদ ও একাকীত্ব নানা অসুখের সৃষ্টি করে,- দেখতে দেখতে কিছুদিনের মধ্যে তারা বৃদ্ধ-জরাগ্রস্থ হয়ে পড়েন৷ যারা চাকরিজীবি নন,- তারাও এই বয়সে গূরত্বহীন ও উদ্দেশ্যহীন ভাবতে শুরু করেন নিজেকে। সবকিছুর উপর কতৃত্ব আর আগের মত না থাকায়,- হীনমন্যতায় ভুগেন অনেকে৷
খুব সমস্যা হয়,- গৃহবধূ মায়েদের ক্ষেত্রে। এতদিন যে সন্তানসন্ততিদের মানুষ করার জন্য দিনরাত খেটেছেন, ভীষণ ব্যাস্ত ছিলেন,- সেই ছেলেমেয়েরাই যার যার ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দূরে চলে যায়, নিজের জগতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে৷ অনেকেই বিয়ে করে আলাদা সংসার করে। স্বামীদেবতা তো আগে থেকেই বাইরের জগৎ নিয়ে ব্যাস্ত,- স্ত্রীকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকার প্রবনতা চলে গেছে বিয়ের দুই তিন বছর পরেই। শ্বশুর শাশুড়ীও সেই বয়সে আর পৃথিবীতে থাকেন না৷ তাই,- এই বয়সে গৃহবধূ মায়েরা ভীষণ একা হয়ে পড়েন। অফুরান সময়, একাকীত্ব, উদ্দেশ্যহীনতা, গূরত্বহ্রাস,- সবকিছু মিলিয়ে মায়েদের জীবনকে ভীষণ অসুস্থ করে তোলে।
কিন্তু,- সৎসঙ্গ জগতে ঠিক এর উলটো চিত্র দেখা যায়৷ যারা শ্রীশ্রীঠাকুরের চরনাশ্রিত হয়ে নিয়মিত নামধ্যান, ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী, যজন-যাজন, সৎসঙ্গে আসা যাওয়া, গুরুগৃহে গিয়ে আচার্য্যসঙ্গ করা, সময় সময় প্রাপ্ত আচার্য্যনির্দেশে নিজেকে যুক্ত রাখেন,- তাদের জীবনে কোন অবসর মুহুর্ত নেই৷ ঠাকুরকে কেন্দ্র করে তাদের একটা নিজস্ব সঙ্গ তৈরী হয়, একটা আনন্দের জগতে আমৃত্যু যুক্ত থাকেন। কিছুদিন পর পর আচার্য্যদেব এক একটা নির্দেশ দিচ্ছেন,- আর সৎসঙ্গী দাদারা মায়েরা, বাচ্ছারা, যুবারা, বৃদ্ধবৃদ্ধারা পাগলপারা হয়ে সেই নির্দেশ পূরনে ছুটে চলেছেন। সেই ছুটার কোন বিরাম নেই, কোন ঢিলেমি নেই। আমৃত্যু এই আনন্দের জগতে নিজেকে ব্যাস্ত রাখা যায়৷ নিজের জীবনটার একটা সার্থক উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। কখনো কোন বয়সেই নিজের জীবনটাকে গূরত্বহীন বোধ হয়না।
বরং,- যারা চাকরি, ব্যাবসা, সংসার, সন্তান সন্ততি নিয়ে কিছুটা ব্যাস্ত,- তারা চিন্তা করেন,- কখন এই চাকরি থেকে অবসর পাবেন যাতে আরো পুরোদমে ইষ্টকাজ করতে পারবেন। নিজের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত কবে শুধু আচার্য্যদেবের ইচ্ছা পূরনে কাটাতে পারবেন। চাকরি থেকে অবসর পেয়ে তারা আরো আনন্দিত হন,- নিজের জীবন আরো ব্যাস্ত হয়ে উঠে ঠাকুরকে কেন্দ্র করে। চাকুরী ক্ষেত্রে যে সম্মান, ভালবাসা, গূরত্ব পেয়েছিলেন,- অবসরের পর গুরুভাইদের মাঝে তা আরো বেশী বেশী পেয়ে থাকেন।
বয়স্কা মায়েরাও মাতৃসম্মেলন নিয়ে, ডিপি ওয়ার্ক নিয়ে, সৎসঙ্গে আসা যাওয়া নিয়ে খুব ব্যাস্ত থাকেন। উৎসবের প্রস্তুতি ও মন্দির নির্মানে তাদেরও সমান কর্ম ব্যাস্ততা, সমান গূরত্ব। ঠাকুরকে কেন্দ্র করে এই মায়েদেরও একটা নিজস্ব আনন্দের জগৎ তৈরি হয়, নিজেদের সঙ্গ তৈরি হয়। ছেলেমেয়ে খোঁজ নিল কি নিলনা, স্বামী সময় দিল কি দিলনা,- এইসব নিয়ে দু:খ করার সময়ই নেই। তারা তো ঠাকুর নিয়েই মশগুল।
সৎসঙ্গে এসে কত কত বয়স্ক দাদাদের ও বয়স্কা মায়েদের দেখি,- যাদের শরীরের বয়স হয়ত সত্তর আশি হয়ে গেছে,- কিন্তু তাদের কর্মোদ্যম, কর্মব্যাস্ততা, আনন্দ, ইষ্টপ্রানতা অনেক অল্প বয়সী যুবক যুবতীদের চেয়ে বেশী৷ তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক অনেক সুস্থ ও কর্মপটু।
তাই,- আমরা যে যাই করি,- চাকরি, ব্যাবসা, কৃষি, সংসার যাই করিনা কেন,- নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ইষ্টকাজে যুক্ত করতে হয়, নিয়মিত আচার্য্যসঙ্গ করতে হয়, সৎসঙ্গে নিয়মিত যেতে হয়, আচার্য্যদেবের ইচ্ছা পূরনে উৎপ্রোতভাবে যুক্ত থাকতে হয়।তবেই সারাজীবন আনন্দে, শান্তিতে থাকা সম্ভব, অনেক বেশী শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব।