মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬৬
বলরামের তীর্থভ্রমণ, চন্দ্রের যক্ষ্মারোগ, একত দ্বিত ও ত্রিতের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
বলরামের তীর্থভ্রমণ, চন্দ্রের যক্ষ্মারোগ ও একত দ্বিত ত্রিতের কাহিনি
জনমেজয় বৈশম্পায়নকে বললেন, বলরাম আগেই কৃষ্ণকে বলেছিলেন যে তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্র বা পাণ্ডুপুত্র কাকেও সাহায্য করবেন না, ইচ্ছানুসারে দেশভ্রমণ করবেন। তবে আবার তিনি কুরুক্ষেত্রে কেন এলেন? বৈশম্পায়ন বললেন, কৃতবর্মা যখন যাদবসৈন্য নিয়ে দুর্যোধনের পক্ষে গেলেন এবং কৃষ্ণ ও সাত্যকি পাণ্ডবপক্ষে গেলেন, তখন বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে তীর্থযাত্রায় গেলেন। তিনি বহু সোনা রূপা বস্ত্র ঘোড়া হাতি রথ গর্দভ উট প্রভৃতি সঙ্গে নিলেন, ঋত্বিক ও ব্রাহ্মণগণও তার সঙ্গে যাত্রা করলেন। বলরাম সমুদ্র থেকে সরস্বতী নদীর স্রোতের বিপরীত দিকে যেতে লাগলেন এবং দেশে দেশে শ্রান্ত ও ক্লান্ত, শিশু ও বৃদ্ধ বহু লোককে এবং ব্রাহ্মণগণকে খাদ্য পানীয় ধনরত্ন গাভী যানবাহন প্রভৃতি দান করলেন।
বলরাম প্রথমে পবিত্র প্রভাসতীর্থে গেলেন। প্রাচীনকালে প্রজাপতি দক্ষ চন্দ্রকে তাঁর সাতাশটি কন্যা দান করেছিলেন। এই কন্যারা সকলেই অতুলনীয় রূপবতী ছিলেন, কিন্তু চন্দ্র সর্বদা রোহিণীর সঙ্গেই বাস করতেন। দক্ষের অন্য কন্যারা রুষ্ট হয়ে দক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন। দক্ষ বহু বার চন্দ্রকে বললেন, তুমি সকল স্ত্রীর সঙ্গে সমান ব্যবহার করবে, কিন্তু চন্দ্র তা শুনলেন না। তখন দক্ষের অভিশাপে চন্দ্র যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলেন। চন্দ্রের ক্ষয় দেখে দেবতারা দক্ষকে বললেন, প্রসন্ন হন, আপনার শাপে চন্দ্র ক্ষীণ হচ্ছেন, তার ফলে লতা ওষধি বীজ এবং প্রজাগণও ক্ষীণ হচ্ছে, আমরাও ক্ষীণ হচ্ছি। দক্ষ বললেন, আমার কথার অন্যথা হবে না। চন্দ্র সকল স্ত্রীর সঙ্গে সমান ব্যবহার করুন, সরস্বতী নদীর প্রধান তীর্থ প্রভাসে অবগাহন করুন, তারপর চন্দ্র বৃদ্ধিলাভ করবেন। কিন্তু মাসের অর্ধেক দিন তার ধীরে ধীরে ক্ষয় হবে এবং বাকি অর্ধেক দিন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি হবে। চন্দ্র পশ্চিম সমুদ্রে সরস্বতীর সংগমস্থলে গিয়ে বিষ্ণুর আরাধনা করুন তা হলে কান্তি ফিরে পাবেন। চন্দ্র প্রভাসতীর্থে গেলেন এবং অমাবষ্যায় অবগাহন কোরে ক্রমশ তার শীতল কিরণ ফিরে পেলেন। তখন থেকে তিনি প্রতি অমাবস্যায় প্রভাসতীর্থে স্নান করে বৃদ্ধি পেতে থাকেন। চন্দ্র সেখানে প্রভা লাভ করেছিলেন এজন্যই ‘প্রভাস’ নাম।
তারপর বলরাম ক্রমশ উদপানতীর্থে গেলেন। সত্যযুগে সেখানে গৌতমের তিন পুত্ৰ একত, দ্বিত ও ত্রিত বাস করতেন। তারা স্থির করলেন যে তাদের যজমানদের কাছ থেকে বহু পশু সংগ্রহ করবেন এবং মহাফলপ্রদ যজ্ঞ কোরে আনন্দে সোমরস পান করবেন। তিন ভাই বহু পশু লাভ কোরে ফিরলেন, ত্ৰিত আগে আগে এবং একত ও দ্বিত পশুর দল নিয়ে পিছনে চললেন। দুষ্টবুদ্ধি একত ও দ্বিত পরামর্শ করলেন, ত্রিত যজ্ঞনিপুণ ও বেদজ্ঞ, সে বহু পশু লাভ করতে পারবে। আমরা দুজনে এইসকল পশু নিয়ে চলে যাই, ত্রিত একাকী যেখানে ইচ্ছা হয় যাক। রাত্রিকালে চলতে চলতে ত্ৰিত এক নেকড়ে দেখতে পেলেন এবং ভীত হয়ে পালাতে গিয়ে সরস্বতী নদীর তীরে এক গভীর কূয়োতে পড়ে গেলেন। তিনি আর্তনাদ করতে লাগলেন, একত ও দ্বিত শুনতে পেয়েও এলেন না, নেকড়ের ভয়ে এবং লোভের বশে পশু নিয়ে চলে গেলেন। ত্ৰিত দেখলেন, কূপের মধ্যে একটি লতা ঝুলছে। তিনি সেই লতাকে সোম, কূপের জলকে ঘৃত এবং কাঁকরকে চিনি কল্পনা কোরে যজ্ঞ করলেন। তার উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বৃহস্পতি দেবগণকে সঙ্গে নিয়ে কূপের নিকটে এলেন। দেবতারা বললেন, আমরা যজ্ঞের ভাগ নিতে এসেছি। ত্রিত যথাবিধি মন্ত্রপাঠ কোরে যজ্ঞভাগ দিলেন। দেবগণ প্রীত হয়ে বর দিতে চাইলেন। ত্রিত বললেন, আপনারা আমাকে উদ্ধার করুন এবং এই বর দিন, যে এই কূপের জল স্পৰ্শ করবে সে সোমপায়ীদের গতি লাভ করবে। তখন কূপ থেকে ঊর্মিমতী সরস্বতী নদী বেরিয়ে এলেন আর তার ধারায় ত্রিত তীরে উঠে দেবগণের পূজা করলেন। তার পর তিনি তার দুই লোভী ভ্রাতাকে শাপ দিলেন —তোমরা নেকড়ের মতো দাঁতযুক্ত ভীষণ পশু হবে, তোমাদের সন্তানগণ ভল্লুক ও বানর হবে।
______________
(ক্রমশ)