মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬৫
দুর্যোধন ও ভীমের মধ্যে গদাযুদ্ধের উপক্রম
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
দুর্যোধন ও ভীমের মধ্যে গদাযুদ্ধের উপক্রম
দুর্যোধন পূর্বে কখনও ভর্ৎসনা শোনেননি, সকলের কাছেই তিনি রাজসম্মান পেতেন। সূর্যের অল্প কিরণেও যাঁর কষ্ট হোতো, সমস্ত লোক যাঁর প্রসাদের উপর নির্ভর করতো, এখন অসহায় সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে যুধিষ্ঠিরের কটুবাক্য শুনতে হোলো। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হাত নেড়ে বললেন, রাজা, আপনাদের শুভানুধ্যায়ী, রথ, বাহন সবই আছে। আমি একা, শোকার্ত, রথ ও বাহনহীন। আপনারা সশস্ত্র, রথারোহী এবং সংখ্যায় বহু। যদি আপনারা সকলে আমাকে বেষ্টন করেন, তবে নিরস্ত্র একা আমি কি কোরে যুদ্ধ করবো? আপনারা একে একে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন। রাত্রিশেষে সূর্য যেমন সমস্ত নক্ষত্র বিনষ্ট করেন, আমিও সেইরূপ নিরস্ত্র ও রথহীন হয়েও নিজের তেজে রথ ও অশ্বসমেত আপনাদের সকলকেই বিনষ্ট করবো।
যুধিষ্ঠির বললেন, মহাবাহু সুযোধন, ভাগ্যক্রমে তুমি ক্ষত্রধর্ম বুঝেছ এবং তোমার যুদ্ধে মতি হয়েছে। তুমি বীর এবং যুদ্ধ করতেও জানো। মনোমত অস্ত্র নিয়ে তুমি আমাদের এক এক জনের সঙ্গেই যুদ্ধ করো, আমরা আর সকলে দর্শক হয়ে থাকব। আমি তোমার মঙ্গলের জন্য আরও বলছি, তুমি আমাদের মধ্যে কেবল একজনকে বধ করলেই কুরুরাজ্য লাভ করবে। আর যদি নিহত হও তবে স্বর্গে যাবে। দুর্যোধন বললেন, একজন বীরই আমাকে দিন। আমি এই গদা নিলাম, আমার প্রতিদ্বন্দ্বীও গদা নিয়ে পদচারী হয়ে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন।
উত্তম ঘোড়া যেমন কশাঘাত সইতে পারে না দুর্যোধন সেইরূপ যুধিষ্ঠিরের বাক্যে বারবার আহত হয়ে অসহিষ্ণু হলেন। তিনি জল আলোড়িত কোরে নাগরাজের মতো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বৃহৎ লৌহগদা নিয়ে হ্রদ থেকে উঠলেন। বজ্ৰধর ইন্দ্রের এবং শূলপাণি মহাদেবের মতো দুর্যোধনকে দেখে পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ খুশি হয়ে হাততালি দিতে লাগলেন। উপহাস মনে কোরে দুর্যোধন সক্রোধে বললেন, পাণ্ডবগণ, তোমরা শীঘ্রই এই উপহাসের প্রতিফল পাবে, পাঞ্চালদের সঙ্গে তোমরাও যমালয়ে যাবে।
তারপর রক্তাক্ত শরীরে দুর্যোধন গম্ভীর স্বরে বললেন, যুধিষ্ঠির, আমি অবশ্যই আপনাদের সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করবো, কিন্তু আপনি জানেন যে একজনের সঙ্গে এককালে বহুলোকের যুদ্ধ উচিত নয়। যুধিষ্ঠির বললেন, দুর্যোধন, যখন অনেক মহারথ মিলে অভিমন্যুকে বধ করেছিলে তখন তোমার এই বুদ্ধি হয়নি কেন? লোকে বিপদে পড়লেই ধর্মের সন্ধান করে, কিন্তু সম্পদের সময় তারা পরলোকের দ্বার রুদ্ধ দেখে। বীর, তুমি বর্ম ধারণ করো, কেশ বন্ধন করো, যুদ্ধের যে উপকরণ তোমার নেই তাও নাও। আমি আবার বলছি, পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যাঁর সঙ্গে তোমার ইচ্ছা তারই সঙ্গে যুদ্ধ করো। তাকে বধ কোরে কুরুরাজ্যের অধিপতি হও, অথবা নিহত হয়ে স্বর্গে যাও। তোমার জীবনরক্ষা ভিন্ন আর কি প্রিয়কার্য করবো বলো।
দুর্যোধন বর্ম ও শিরস্ত্রাণ ধারণ কোরে গদা হাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, দুর্যোধন যদি আপনার সঙ্গে অথবা অর্জুন নকুল বা সহদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চান তবে কি হবে? আপনি কেন এই দুঃসাহসের কথা বললেন-“আমাদের মধ্যে একজনকে বধ করেই কুরুরাজ্যের অধিপতি হও’? ভীমকে বধ করবার ইচ্ছায় দুর্যোধন তেরো বছর একটা লৌহমূর্তির উপর গদাপ্রহার অভ্যাস করেছেন। ভীম ভিন্ন দুর্যোধনের প্রতিযোদ্ধা দেখছি না, কিন্তু ভীমও গদাযুদ্ধশিক্ষায় অধিক পরিশ্রম করেননি। আপনি শকুনির সঙ্গে পাশা খেলে যেমন কাজ করেছিলেন, আজও তেমন করছেন। ভীম অধিকতর বলবান ও সহিষ্ণু, কিন্তু দুর্যোধন অধিকতর কৃতী} বলবান অপেক্ষা কৃতীই শ্রেষ্ঠ। মহারাজ, আপনি শত্রুকে সুবিধা দিয়ে আমাদের বিপদে ফেলেছেন। গদা হাতে দুর্যোধনকে জয় করতে পারেন এমন মানুষ বা দেবতা আমি দেখি না। আপনারা কেউ ন্যায়যুদ্ধে দুর্যোধনকে জয় করতে পারবেন না। পাণ্ডু ও কুন্তীর পুত্রগণ নিশ্চয়ই রাজ্যভোগের জন্য সৃষ্ট হননি, দীর্ঘকাল বনবাস ও ভিক্ষার জন্যই সৃষ্ট হয়েছেন।
ভীম কৃষ্ণকে বললেন, তুমি বিষগ্ন হয়ো না, আজ আমি দুর্যোধনকে বধ করবো তাতে সন্দেহ নেই। আমার গদা দুর্যোধনের গদার চেয়ে দেড় গুণ ভারী, অতএব তুমি চিন্তা কোরো না। দুর্যোধনের কথা দূরে থাক, আমি দেবগণ এবং ত্রিলোকের সকলের সঙ্গেই যুদ্ধ করতে পারি। বাসুদেব খুশি হয়ে বললেন, মহাবাহু, আপনাকে আশ্রয় করেই ধর্মরাজ শত্রুহীন হয়ে রাজলক্ষ্মী লাভ করবেন তাতে সন্দেহ নেই। বিষ্ণু যেমন দানবসংহার করে শচীপতি ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্য দিয়েছিলেন, আপনিও সেইরূপ দুর্যোধনকে বধ কোরে ধর্মরাজকে সসাগরা পৃথিবী দিন।
ভীম গদা হাতে নিয়ে দুর্যোধনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। এক মত্ত হাতি যেমন আর এক হাতির দিকে ধেয়ে যায়, দুর্যোধন তেমন ভীমের কাছে গেলেন। ভীম তাকে বললেন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর তুমি যেসব পাপ করেছ তা এখন স্মরণ করো। দুরাত্মা, তুমি সভামধ্যে রজস্বলা দ্রৌপদীকে কষ্ট দিয়েছিলে, শকুনির বুদ্ধিতে যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় জয় করেছিলে, নিরপরাধ পাণ্ডবদের প্রতি বহু দুর্ব্যবহার করেছিলে, তার ফল এখন পাবে। তোমার জন্যই আমাদের পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় পড়ে আছেন, দ্রোণ কর্ণ শল্য শকুনি, তোমার বীর ভাইয়েরা ও পুত্রেরা এবং তোমার পক্ষের রাজারা সসৈন্যে নিহত হয়েছেন। কুলঘ্ন পুরুষাধম একমাত্র তুমিই এখন অবশিষ্ট আছ, আজ তোমাকে গদাঘাতে বধ করবো তাতে সন্দেহ নেই।
দুর্যোধন ভীমকে বললেন, আত্মপ্রংশসা কোরে কি হবে, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো, তোমার যুদ্ধপ্রীতি আজ দূর করবো। পাপী, কোন্ শত্রু আজ ন্যায়যুদ্ধে আমাকে জয় করতে পারবে? ইন্দ্রও পারবেন না। কুন্তীপুত্র, শরৎকালীন মেঘের ন্যায় বৃথা গর্জন করো না, তোমার যত শক্তি আছে তা আজ যুদ্ধে দেখাও।
এই সময়ে হলায়ুধ বলরাম সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন যে দুর্যোধন ও ভীম যুদ্ধে উদ্যত হয়েছেন। কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণ তাকে যথাবিধি সম্মান জানিয়ে বললেন, আপনি আপনার দুই শিষ্যের যুদ্ধকৌশল দেখুন। বলরাম বললেন, কৃষ্ণ, আমি পুষ্যা নক্ষত্রে দ্বারকা ত্যাগ করেছি, তার পর বিয়াল্লিশ দিন গত হয়েছে, এখন শ্রবণা নক্ষত্রে এখানে এসেছি। এই বলে নীলবসন শুভ্রকান্তি বলরাম সকলকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন, আলিঙ্গন ও কুশল প্রশ্ন করে যুদ্ধ দেখবার জন্য উপবিষ্ট হলেন।
______________
(ক্রমশ)