মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২০
দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্মের পতনের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্মের পতনের কাহিনি
যুদ্ধের দশম দিনে সূর্যোদয় হলে পাণ্ডবগণ সর্বশত্রুজয়ী ব্যূহ রচনা করে শিখণ্ডীকে সামনে রেখে যুদ্ধ করতে গেলেন। ভীম, অর্জুন, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, অভিমন্যু, সাত্যকি, চেকিতান ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যূহের বিভিন্ন স্থানে রইলেন। যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, বিরাট, কেকয়দের পাঁচ ভাই ও ধৃষ্টকেতু তাদের পিছনে গেলেন। ভীষ্ম কৌরবসেনার সামনে রইলেন, দুর্যোধনাদি, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, ভগদত্ত, কৃতবর্মা, শকুনি, বৃহদ্বল প্রভৃতি তাঁর পিছনে গেলেন।
শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন প্রভৃতি বাণবর্ষণ করতে করতে ভীষ্মের প্রতি ধেয়ে গেলেন। ভীম, নকুল, সহদেব, সাত্যকি প্রভৃতি মহারথগণ কৌরবসৈন্য ধ্বংস করতে লাগলেন। ভীষ্ম জীবনের আশা ত্যাগ কোরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন, তার বাণের আঘাতে পাণ্ডবপক্ষের বহু রথী, অশ্বারোহী, গজারোহী ও পদাতিক সৈন্য বিনষ্ট হোলো। শিখণ্ডী তাকে শরাঘাত করলে ভীষ্ম একবার মাত্র তার দিকে দৃষ্টিপাত করে সহাস্যে বললেন, তুমি আমাকে প্রহার করো বা না করো আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবো না, বিধাতা তোমাকে শিখণ্ডিনী রূপে সৃষ্টি করেছিলেন, এখনও তুমি তাই আছ। শিখণ্ডী ক্রুদ্ধ হয়ে ভীষ্মকে বললেন, আপনার পরাক্রম যে ভয়ংকর তা আমি জানি, জামদগ্ন্য পরশুরামের সঙ্গে আপনার যুদ্ধের বিষয়ও জানি, তবুও নিজের এবং পাণ্ডবগণের কল্যাণের জন্য নিশ্চয়ই আপনাকে বধ করবো। আপনি যুদ্ধ করুন বা না করুন, আমার কাছ থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি পাবেন না, অতএব এই পৃথিবী ভাল কোরে দেখে নিন।
অর্জুন শিখণ্ডীকে বললেন, তুমি ভীষ্মকে আক্রমণ করো, আমি তোমাকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করবো, তোমাকে কেউ আহত করতে পারবে না। আজ যদি ভীষ্মকে বধ না কোরে ফিরে যাও তবে তুমি আর আমি লোকসমাজে উপহাসের পাত্র হবো।
অর্জুনের বাণবর্ষণে কৌরবসেনা ভীত হয়ে পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, আগুন যেমন বনকে পুড়িয়ে দেয় অর্জুন তেমন আমার সেনা বিনাশ করছে, ভীম, সাত্যকি, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ঘটোৎকচ প্রভৃতিও আমাদের সৈন্য বিনাশ করছে, আপনি রক্ষা করুন। মুহূর্তকাল চিন্তা করে ভীষ্ম বললেন, দুর্যোধন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে প্রতিদিন দশ হাজার ক্ষত্রিয় বিনাশ কোরে রণস্থল থেকে ফিরব, সেই প্রতিজ্ঞা আমি পালন করেছি। আজ আমি আর এক মহৎ কর্ম করবো, হয় নিহত হয়ে রণভূমিতে শয়ন করবো, না হয় পাণ্ডবগনকে বধ করবো। তুমি আমাকে অন্নদান করেছ, সেই মহৎ ঋণ আজ তোমার সেনার সম্মুখে নিহত হয়ে শোধ করবো।
ভীম, নকুল, সহদেব, ঘটোৎকচ, সাত্যকি, অভিমন্যু, বিরাট, দ্রুপদ, যুধিষ্ঠির, শিখণ্ডীর পশ্চাতে অর্জুন এবং সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন সকলেই ভীষ্মকে বধ করবার জন্য ধেয়ে গেলেন। ভুরিশ্রবা, বিকর্ণ, কৃপ, দুর্মুখ, অলম্বুষ, কম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, অশ্বত্থামা, দ্রোণ, দুঃশাসন প্রভৃতি ভীষ্মকে রক্ষা করতে লাগলেন। দ্রোণ তার পুত্র অশ্বত্থামাকে বললেন, বৎস, আমি নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, ভীষ্ম ও অর্জুন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এই চিন্তা কোরে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, মন অবসন্ন হচ্ছে। পাপমতি শঠ শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন যুদ্ধ করতে এসেছে, কিন্তু শিখণ্ডী পূর্বে স্ত্রী ছিলো এজন্য ভীষ্ম তাকে প্রহার করবেন না। অর্জুন সকল যোদ্ধার শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রাদি দেবগণেরও অজেয়। আজ যুদ্ধ অতি ভয়ংকর হবে। পুত্র, পরের আশ্রিত জনের প্রাণ রক্ষার সময় এ নয়, তুমি স্বর্গলাভের উদ্দেশ্যে এবং ও বিজয়ের জন্য যুদ্ধে যাও। ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব যাঁর ভাই, কৃষ্ণ যাঁর রক্ষক, সেই যুধিষ্ঠিরের ক্রোধই দুর্মতি দুর্যোধনের বাহিনী ধ্বংস করছে। কৃষ্ণের আশ্রয়ে অর্জুন দুর্যোধনের সামনেই তাঁর সমস্ত সৈন্য বিনাশ করছেন। বৎস, তুমি অর্জুনের পথে থেকো না, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করো, আমি যুধিষ্ঠিরের দিকে যাচ্ছি। প্রিয় পুত্রের দীর্ঘ জীবন কে না চায়, তথাপি ক্ষত্রধর্ম বিচার কোরে তোমাকে যুদ্ধে পাঠাচ্ছি।
একটানা দশ দিন পাণ্ডববাহিনীর অসংখ্য সৈন্য বিনাশ কোরে ধর্মাত্মা ভীষ্ম নিজের জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি স্থির করলেন, আমি আর কাউকে হত্যা করবো না। নিকটে যুধিষ্ঠিরকে দেখে তিনি বললেন, বৎস, আমার এই দেহের উপর অত্যন্ত বিরাগ জন্মেছে, আমি যুদ্ধে বহু প্রাণী বধ করেছি। এখন অর্জুন এবং পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে সামনে রেখে আমাকে বধ করবার চেষ্টা করো। ভীষ্মের এই কথা শুনে যুধিষ্ঠির ও ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদের সৈন্যগণকে বললেন, তোমরা ভীষ্মকে জয় করো, অর্জুন তোমাদের রক্ষা করবেন।
এই দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম একাকী অসংখ্য ঘোড়া, হাতি, সাত মহারথ, পাঁচ হাজার রথী, চোদ্দ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং বহু গজারোহী ও অশ্বারোহী বিনাশ করলেন। বিরাট রাজার ভাই শতানীক এবং বহু হাজার ক্ষত্রিয় ভীষ্ম কর্তৃক নিহত হলেন। শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন ভীষ্মকে বাণবিদ্ধ করতে লাগলেন। ভীষ্ম ক্ষিপ্রগতিতে বিভিন্ন যোদ্ধাদের মধ্যে বিচরণ কোরে পাণ্ডবগণের নিকটে এলেন। অর্জুন বার বার ভীষ্মের ধনু ছেদন করলেন। ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনের প্রতি এক ভয়ংকর শক্তি-অস্ত্র নিক্ষেপ করলে অর্জুন ভল্লের আঘাতে তা খণ্ড খণ্ড করে দিলেন।
ভীষ্ম চিন্তা করলেন কৃষ্ণ যদি এদের রক্ষক না হতেন তবে আমি এক ধনু দিয়েই পাণ্ডবপক্ষ বিনাশ করতে পারতাম। পিতা যখন সত্যবতীকে বিবাহ করেন তখন তুষ্ট হয়ে আমাকে দুই বর দিয়েছিলেন, ইচ্ছামৃত্যু ও যুদ্ধে অবধ্যত্ব। আমার মনে হয় এই আমার মৃত্যুর উপযুক্ত কাল। ভীষ্মের সংকল্প জেনে আকাশ থেকে ঋষিগণ ও বসুগণ বললেন, বৎস, তুমি যা স্থির করেছ তা আমাদের খুশি করেছে, তুমি যুদ্ধে বিরত হও। তখন সুগন্ধ সুখস্পর্শ জলীয় বাতাস বইতে লাগল, মহাশব্দে দেবদুন্দুভি বেজে উঠল, ভীষ্মের উপর পুষ্পবৃষ্টি হোলো। কিন্তু ভীষ্ম এবং ব্যাসদেবের বরে সঞ্জয় ভিন্ন আর কেউ তা জানতে পারলেন না।
ভীষ্ম অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে বিরত হলেন। শিখণ্ডী নয়টি তীক্ষ্ম বাণ দিয়ে তার বক্ষে আঘাত করলেন, কিন্তু ভীষ্ম বিচলিত হলেন না। তখন অর্জুন ভীষ্মের প্রতি বহু বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ভীষ্ম ঈষৎ হাস্য করে দুঃশাসনকে বললেন, এইসকল মর্মভেদী বজ্রতুল্য বাণ নিরবচ্ছিন্ন হয়ে আসছে, এ বাণ শিখণ্ডীর নয়, অর্জুনেরই। ভীষ্ম একটি শক্তি-অস্ত্র নিক্ষেপ করলে অর্জুনের বাণের আঘাতে তা ভেঙ্গে গেল। ভীষ্ম তখন ঢাল ও খড়্গ নিয়ে রথ থেকে নামবার উপক্রম করলেন। অর্জুনের বাণে ঢাল ছিন্ন হয়ে গেল। যুধিষ্ঠিরের আদেশে পাণ্ডবসৈন্যগণ নানা অস্ত্র নিয়ে চতুর্দিক থেকে ভীষ্মের প্রতি ধেয়ে গেল, দুর্যোধনাদি ভীষ্মকে রক্ষা করতে লাগলেন।
পঞ্চপাণ্ডব এবং সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু প্রভৃতির বাণে আহত হয়ে দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, শল্য প্রভৃতি ভীষ্মকে পরিত্যাগ করলেন। যিনি হাজার হাজার বিপক্ষ যোদ্ধাকে বিনাশ করেছেন সেই ভীষ্মের গায়ে দুই আঙ্গুল পরিমাণ স্থানও অক্ষত রইল না। সূর্যাস্তের একটু আগে অর্জুনের বাণের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভীষ্ম পূর্ব দিকে মাথা রেখে রথ থেকে পড়ে গেলেন। আকাশে দেবগণ এবং ভূতলে রাজগণ হাহাকার কোরে উঠলেন। উৎপাটিত ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় ভীষ্ম রণভূমিতে নিপাতিত হলেন, কিন্তু বাণে তার সমস্ত শরীর ঢাকা থাকায় তিনি ভূমি স্পর্শ করলেন না। দক্ষিণ দিকে সূর্য দেখে ভীষ্ম বুঝলেন এখন দক্ষিণায়ণ। তিনি আকাশবাণী শুনলেন — মহাত্মা নরশ্রেষ্ঠ গঙ্গাপুত্র তুমি দক্ষিণায়ণে কি করে প্রাণত্যাগ করবে? ভীষ্ম বললেন, ভূতলে শায়িত থেকেই আমি উত্তরায়ণের প্রতীক্ষায় প্রাণধারণ করবো।
মানস সরোবরবাসী মহর্ষিগণ হাঁসের রূপ ধরে ভীষ্মকে দর্শন করতে এলে ভীষ্ম বললেন, সূর্য দক্ষিণায়ণে থাকতে আমি মৃত্যুবরণ করবো না, উত্তরায়ণেই দেহত্যাগ করবো, পিতা শান্তনুর বরে মৃত্যু আমার ইচ্ছাধীন।
কৌরবগণ কি করবেন ভেবে পেলেন না। কৃপ, দুর্যোধন প্রভৃতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁদতে থাকলেন, তাঁদের আর যুদ্ধে মন রইল না, যেন সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল। বিজয়ী পাণ্ডবগণ শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগলেন। শান্তনুপুত্র ভীষ্ম যোগস্থ হয়ে মৃত্যুকালের প্রতীক্ষায় রইলেন।
______________
(ক্রমশ)