মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬৮
যুধিষ্ঠিরের স্বপ্ন-দর্শন এবং মুদ্গলের সিদ্ধিলাভের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
যুধিষ্ঠিরের স্বপ্ন-দর্শন এবং মুদ্গলের সিদ্ধিলাভের কাহিনি
দ্বৈতবনে বাস করার সময় একদিন রাতে যুধিষ্ঠির স্বপ্ন দেখলেন, হরিণেরা ভীত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলছে, মহারাজ, আমরা দ্বৈতবনের হরিণ। আপনার বীর ভাইয়েরা আমাদের অধিকাংশকে শিকার কোরে অল্পই অবশিষ্ট রেখেছেন। আপনি দয়া করুন, যাতে আমরা সংখ্যায় বাড়তে পারি। যুধিষ্ঠির দুঃখ পেয়ে বললেন, তোমরা যা বললে তাই হবে। সকালে তিনি সেই স্বপ্ন জানিয়ে ভাইদের বললেন, এখনও এক বৎসর আট মাস আমাদের হরিণের মাংস খেয়ে বনবাস করতে হবে। আমরা দ্বৈতবন ত্যাগ কোরে আবার কাম্যকবনে যাব, সেখানে অনেক হরিণ আছে।
যুধিষ্ঠিরের কথায় পাণ্ডবগণ আবার কাম্যকবনে এলেন, সেখানে তাঁদের কষ্টকর বনবাসের এগারো বছর পার হোলো। একদিন মহাযোগী বেদব্যাস তাদের কাছে এলেন এবং উপদেশ প্রসঙ্গে এই কাহিনি বললেন - কুরুক্ষেত্রে মুদ্গল নামে এক ধর্মাত্মা মুনি ছিলেন, তিনি কবুতরের মতো শিলোঞ্ছ বৃত্তি (শস্য কাটার পর ক্ষেত্রে যে শস্য পড়ে থাকে তাই সংগ্রহ করা) অবলম্বন কোরে জীবিকানির্বাহ ও ব্ৰতাদি পালন করতেন। তিনি স্ত্রী-পুত্রের সহিত পনের দিনে একদিন মাত্র খেতেন, প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় যজ্ঞ করতেন এবং অতিথিদের এক দ্রোণ পরিমাণ অন্ন দিতেন। যে অন্ন অবশিষ্ট থাকত তা নতুন অতিথি এলেই বৃদ্ধি পেত। একদিন দুর্বাসা ঋষি মুণ্ডিতমস্তকে দিগম্বর হয়ে কটুবাক্য বলতে বলতে পাগলের মতো উপস্থিত হয়ে বললেন, আমাকে অন্ন দাও। মুদ্গল অন্ন দিলে দুর্বাসা সমস্ত ভোজন করলেন এবং শরীরে উচ্ছিষ্ট মেখে চলে গেলেন। এইরূপ পর পর ছবার পর্বের দিনে এসে দুর্বাসা সমস্ত অন্ন খেয়ে গেলেন, মুদ্গল নির্বিকার মনে অনাহারে রইলেন। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমার মহৎ দানের সংবাদ স্বর্গে ঘোষিত হয়েছে, তুমি সশরীরে সেখানে যাবে।
এই সময়ে এক দেবদূত বিচিত্র বিমান নিয়ে এসে মুদ্গলকে বললেন, মুনি, আপনি পরম সিদ্ধি লাভ করেছেন, এখন এই বিমানে উঠে স্বর্গে চলুন। মুদ্গল বললেন, স্বর্ণবাসের গুণ আর দোষ কি আগে বলো। দেবদূত বললেন, যাঁরা ধর্মাত্মা, জিতেন্দ্রিয়, দানশীল, যাঁরা সম্মুখ সমরে নিহত, তারাই স্বর্গবাসের অধিকারী। সেখানে ঈর্ষা, শোক, ক্লান্তি, মোহ, মাৎসর্য কিছুই নেই। দেবগণ, সাধুগণ, মহর্ষিগণ প্রভৃতি সেখানে নিজ নিজ প্রাসাদে বাস করেন। তা ছাড়াও তেত্রিশ জন ঋভু আছেন, তাঁদের স্থান আরও উচ্চে, দেবতারাও তাদের পূজা করেন। আপনি দান ও তপস্যার প্রভাবে ঋভুগণের সমান সম্মান লাভ করেছেন। স্বর্গের গুণ আপনাকে বললাম, এখন দোষ শুনুন। স্বর্গে কৃতকর্মের ফলভোগ হয় কিন্তু নূতন কর্ম করা যায় না। সেখানে অপরের অধিকতর সম্পদ দেখে ক্ষোভ হয়, কর্মক্ষয় হলে আবার নরলোকে পতন হয়।
মুদ্গল বললেন, হে দেবদূত, আপনাকে নমস্কার, আপনি ফিরে যান, স্বর্গসুখ আমি চাই না। যে অবস্থায় মানুষ শোক বা দুঃখ পায় না, পতিতও হয় না, আমি সেই কৈবল্যের সন্ধান করবো। দেবদূত চলে গেলে মুদ্গল শুদ্ধ জ্ঞানযোগ অবলম্বন করে ধ্যানপরায়ণ হলেন এবং নির্বাণমুক্তিরূপ সিদ্ধি লাভ করলেন।
এই কাহিনি বলে এবং যুধিষ্ঠিরকে প্রবোধ দিয়ে বেদব্যাস নিজের আশ্রমে প্রস্থান করলেন।
______________
(ক্রমশ)