Story of Mahabharat Part 65 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 65

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 65

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬৫

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত দেবসেনাপতি কার্তিকেয়র কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত দেবসেনা ও কার্তিকেয়র কাহিনি

পতিব্রতা নারী এবং ধর্মব্যাধের কাহিনি বর্ণনা কোরে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বললেন, আমি এখন অগ্নিপুত্র কার্তিকেয়র কথা বলছি তোমরা শোন -

দেবগণের সঙ্গে যুদ্ধে দানবগণ সর্বদাই জয়ী হয় দেখে দেবরাজ ইন্দ্র একজন শক্তিশালী সেনাপতির অনুসন্ধান করতে লাগলেন। একদিন তিনি মানস পর্বতে নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শুনে কাছে গিয়ে দেখলেন, কেশী দানব একটি কন্যার হাত ধরে টানছে। ইন্দ্রকে দানব বললো, এই কন্যাকে আমি বিবাহ করবো, তুমি বাধা দিও না, চলে যাও। তখন কেশীর সঙ্গে ইন্দ্রের যুদ্ধ হোলে কেশী পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেল। সেই কন্যা ইন্দ্রকে বললেন, আমি প্রজাপতির কন্যা দেবসেনা, আমার বোন দৈত্যসেনাকে কেশী হরণ করেছে। আপনার নির্দেশে আমি অজেয় পতি লাভ করতে ইচ্ছা করি। ইন্দ্র বললেন, তুমি আমার শাশুড়ীর বোনের কন্যা। এই বলে ইন্দ্র দেবসেনাকে ব্রহ্মার কাছে নিয়ে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন, এক মহাবিক্রমশালী পুরুষ জন্মগ্রহণ করে এই কন্যার পতি হবেন, তিনি তোমার সেনাপতিও হবেন।

ইন্দ্র তখন দেবসেনাকে বশিষ্ঠাদি সপ্তর্ষির যজ্ঞস্থানে নিয়ে গেলেন। সেখানে অগ্নিদেব হোমকুণ্ড থেকে উঠে দেখলেন, অপূর্বসুন্দরী ঋষিপত্নীগণ কেউ আসনে বসে আছেন, কেউ শুয়ে আছেন। তাঁদের দেখে অগ্নি কামার্ত হলেন, কিন্তু তাদের পাওয়া অসম্ভব জেনে দেহত্যাগের সংকল্প করে বনে চলে গেলেন।

দক্ষকন্যা স্বাহা অগ্নিকে কামনা করতেন। তিনি মহর্ষি অঙ্গিরার পত্নী শিবার রূপ ধারণ কোরে অগ্নির কাছে এসে মিলিত হলেন এবং অগ্নির শুক্র নিয়ে পাখির রূপ ধারণ কোরে কৈলাস পর্বতের এক কাঞ্চনকুণ্ডে তা নিক্ষেপ করলেন। তারপর তিনি সপ্তর্ষিগণের অন্যান্য ঋষিদের পত্নীর রূপ ধারণ কোরে আগের মতো অগ্নির সঙ্গে মিলিত হলেন, কেবল বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতীর তপস্যার প্রভাবে তার রূপ ধারণ করতে পারলেন না। এই প্রকারে স্বাহা ছ-বার কাঞ্চনকুণ্ডে অগ্নির শুক্র নিক্ষেপ করলেন। সেই স্কন্ন অর্থাৎ নির্গত শুক্র থেকে স্কন্দ জন্ম নিলেন। তার ছয়টি মাথা, একটি গলা, একটি পেট। এক সময় ত্রিপুরাসুরকে বধ করে মহাদেব তার ধনু রেখে দিয়েছিলেন, বালক স্কন্দ সেই ধনু নিয়ে গর্জন করতে লাগলে বহু লোক ভীত হয়ে তার শরণাপন্ন হোলো।

অগ্নির সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঘটনা জানতে পেরে সপ্তর্ষিদের ছয় জন নিজ পত্নীদের ত্যাগ করলেন, তারা ভাবলেন তাদের পত্নীরাই স্কন্দের মা। স্বাহা তাঁদের বারবার বললেন, আপনাদের ধারণা ঠিক নয়, স্কন্দ আমারই পুত্র। মহামুনি বিশ্বামিত্র কামার্ত অগ্নির পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন সেজন্য তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন। তিনি স্কন্দের সমস্ত মঙ্গলকার্য সম্পন্ন কোরে সপ্তর্ষিদের বললেন, আপনাদের পত্নীদের কোনো অপরাধ নেই, কিন্তু ঋষিরা তা বিশ্বাস করলেন না।

স্কন্দের বৃত্তান্ত শুনে দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, এর শক্তি সহ্য করা সম্ভব হবে না, শীঘ্র একে বধ করুন। কিন্তু ইন্দ্র সাহস করলেন না। তখন দেবতারা স্কন্দকে মারবার জন্য লোকমাতাদের পাঠালেন। কিন্তু তারা গিয়ে বালককে বললেন, তুমি আমাদের পুত্র হও। স্কন্দ তাদের স্তন্যপান করলেন। সেই সময়ে অগ্নিও এলেন এবং মাতৃগণের সঙ্গে স্কন্দকে রক্ষা করতে লাগলেন। ছয় জন লোকমাতা বা কৃত্তিকা স্কন্দকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন বলে স্কন্দের অপর নাম কার্তিকেয়।

স্কন্দকে জয় করা দুঃসাধ্য জেনেও বজ্রধর ইন্দ্র সদলবলে তার কাছে গিয়ে যুদ্ধ করলেন। অগ্নিপুত্র কার্তিকেয় ভীষণ গর্জন করে মুখ থেকে ভয়ঙ্কর আগুন নির্গত কোরে দেবসৈন্য দগ্ধ করতে লাগলেন। তখন ইন্দ্র বজ্র নিক্ষেপ করলে কার্তিকেয়র দক্ষিণ পাশ বিদীর্ণ হল, তা থেকে বিশাখ নামে এক মহাবল যুবা সৃষ্টি হলেন, তার দেহ কাঞ্চনবর্ণ, কানে দিব্য কুণ্ডল, হাতে শক্তি অস্ত্র। তখন দেবরাজ ভয় পেয়ে কার্তিকেয়র শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে দেবতাদের সেনাপতি করলেন। সেই সময় পার্বতীর সঙ্গে মহাদেব এসে কার্তিকেয়র গলায় সুবর্ণমালা পরিয়ে দিলেন। দ্বিজগণ রুদ্রকে অগ্নি বলে থাকেন, সেজন্য কার্তিকেয় মহাদেবেরও পুত্র। মহাদেব অগ্নিদেবের শরীরে প্রবেশ কোরে এই পুত্র উৎপাদন করেছিলেন।

দেবগণ কর্তৃক সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হয়ে কার্তিকেয় রথে আরোহণ করলেন, তাঁর রথে অগ্নিদেবের দেওয়া মোরগ চিহ্নিত রক্তবর্ণের পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হোলো। তারপর ইন্দ্র দেবসেনাকে কার্তিকেয়র সঙ্গে বিবাহ দিলেন। সেই সময়ে ছয় ঋষিপত্নী এসে কার্তিকেয়কে বললেন, পুত্র, আমরা তোমার জননী এই মনে কোরে আমাদের স্বামীরা অকারণে আমাদের ত্যাগ করেছেন এবং পুণ্যস্থান থেকে বহিস্কার করেছেন, তুমি আমাদের রক্ষা করো। কার্তিকেয় বললেন, আপনারা আমার মাতা, আমি আপনাদের পুত্র, আপনারা যা চান তাই হবে।

স্কন্দের পালিকা মাতৃগণকে এবং স্কন্দ থেকে উৎপন্ন সমস্ত কুমার-কুমারীদের স্কন্দগ্রহ বলা হয়। এই সব স্কন্দগ্রহ যোলো বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের নানাপ্রকার অমঙ্গল ঘটান। এইসকল গ্রহের শান্তি এবং কার্তিকেয়র পূজা করলে মঙ্গল, আয়ু ও বীর্য লাভ হয়।

তারপর স্বাহা কার্তিকের কাছে এসে বললেন, আমি দক্ষকন্যা স্বাহা, তুমি আমার আপন পুত্র। অগ্নিদেব জানেন না যে আমি বাল্যকাল থেকে তাঁকে কামনা করি। আমি তার সঙ্গেই বাস করতে ইচ্ছা করি। কার্তিকেয় বললেন, দেবী, দ্বিজগণ হোমাগ্নিতে হব্য-কব্য আহুতি দেওয়ার সময় “স্বাহা” বলবেন, তার ফলেই অগ্নিদেবের সঙ্গে আপনার সর্বদা বাস হবে।

তারপর মহাদেব ও পার্বতী রথে চড়ে দেবতা ও অসুরের যুদ্ধস্থল ভদ্রবটে যাত্রা করলেন। দেবসৈন্য সঙ্গে নিয়ে কার্তিকেয়ও তাঁদের সঙ্গে গেলেন। সহসা নানা অস্ত্রধারী ভয়ঙ্কর অসুরসৈন্য মহাদেব ও দেবগণকে আক্রমণ করলো। মহিষ নামক মহাবল দানব এক বিপুল পর্বত নিক্ষেপ করলে তার আঘাতে কয়েক হাজার দেবসৈন্য নিহত হোলো। ইন্দ্রাদি দেবগণ ভয়ে পলায়ন করলেন। মহিষ দ্রুতবেগে এসে মহাদেবের রথ ধরলে কার্তিকেয় এসে প্রজ্বলিত শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করে মহিষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর প্রায় সমস্ত দানব তার নিক্ষিপ্ত বাণের আঘাতে মারা গেল। যারা অবশিষ্ট রইল, কার্তিকেয়র সঙ্গে আসা পারিষদগণ তাদের বিনাশ করলো।

যুদ্ধস্থান দানবশূন্য হোলে, ইন্দ্র কার্তিকেয়কে আলিঙ্গন করে বললেন, এই মহিষ-দানব ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে দেবগণকে তুচ্ছ জ্ঞান করতো, তুমি এই দেবশত্রু ও তার তুল্য শত শত দানবকে সংহার করেছো। তুমি শিবের ন্যায় তেজস্বী, ত্রিভুবনে তোমার কীর্তি অক্ষয় হয়ে থাকবে।

______________

(ক্রমশ)