মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬৪
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত কৌশিক, পতিব্রতা নারী ও ধর্মব্যাধের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত কৌশিক, পতিব্রতা নারী ও ধর্মব্যাধের কাহিনি
যুধিষ্ঠির মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে বললেন, আপনার কাছে বিভিন্ন কাহিনি শুনে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, এখন আপনি কৃপা কোরে নারীর শ্রেষ্ঠ মাহাত্ম্য এবং সূক্ষ্ম ধর্ম সম্পর্কে বলুন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় বললেন, আমি পতিব্রতা নারীর ধর্ম বলছি শোন -
কৌশিক নামে এক তপস্বী ব্রাহ্মণ ছিলেন। একদিন তিনি গাছের নীচে বসে বেদপাঠ করছিলেন, এমন সময়ে একটি বক তার মাথার উপরে মলত্যাগ করলো। কৌশিক ক্রুদ্ধ হয়ে তার দিকে চাইলে সেই বক তখনই মরে পড়ে গেল। তাকে এইভাবে মরতে দেখে ব্রাহ্মণ অনুতপ্ত হয়ে ভাবলেন, আমি ক্রোধের বশে অন্যায় কাজ করে ফেলেছি।
তারপর কৌশিক ভিক্ষার জন্য গ্রামে গিয়ে একটি পূর্বপরিচিত গৃহস্থের বাড়িতে প্রবেশ করে ভিক্ষা চাইলেন। তাকে অপেক্ষা করতে বলে গৃহিণী ভিক্ষা দ্রব্য আনতে অন্দরে গেলেন। এমন সময়ে গৃহকর্তা ক্ষুধার্ত হয়ে বাড়িতে এলে তার সাধ্বী গৃহিণী ব্রাহ্মণকে অপেক্ষায় রেখে স্বামীর পা আর মুখ ধোবার জল, খাদ্য ও পানীয় দিয়ে স্বামীর সেবা করতে লাগলেন। তার পর তাঁর ভিক্ষার্থী ব্রাহ্মণকে মনে পড়ায় লজ্জিত হয়ে তাকে ভিক্ষা দিতে গেলেন। কৌশিক তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তুমি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে আটকে রাখলে কেন? সাধ্বী গৃহিণী বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার কাছে স্বামী পরম দেবতা, তিনি শ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে এসেছেন সেজন্য তার সেবা আগে করেছি। কৌশিক বললেন, তুমি স্বামীকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে ব্রাহ্মণকে অপমান করলে! দেবরাজ ইন্দ্রও ব্রাহ্মণের নিকট নত থাকেন। তুমি কি জান না যে, ব্রাহ্মণ পৃথিবী দগ্ধ করতে পারেন?
গৃহিণী বললেন, ক্রোধ ত্যাগ করুন, আমি বক নই, ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে আপনি আমার কিছু ক্ষতি করতে পারবেন না। আমি আপনাকে অবহেলা করিনি, ব্রাহ্মণদের তেজ ও মাহাত্ম্য আমার জানা আছে। তাদের ক্রোধ যেমন ভয়ঙ্কর, অনুগ্রহও তেমন বিপুল। আপনি আমার ত্রুটি ক্ষমা করুন। পতির সেবাই আমি শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করি, তার ফল আমি কি পেয়েছি দেখুন — আপনি ক্রুদ্ধ হয়ে দৃষ্টিপাত করায় বক মারা গেছেন তা আমি জানতে পেরেছি। ক্রোধ মানুষের পরম শত্রু, যিনি ক্রোধ ও মোহ ত্যাগ করেছেন দেবতারা তাকেই ব্রাহ্মণ মনে করেন। আপনি ধর্মজ্ঞ, কিন্তু ধর্মের যথার্থ তত্ত্ব জানেন না। মিথিলায় এক ব্যাধ আছেন, তিনি পিতা-মাতার সেবক, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। আপনি সেই ধর্মব্যাধের কাছে যান, তিনি আপনাকে ধর্মশিক্ষা দেবেন। আমার বাচালতা ক্ষমা করুন, স্ত্রী সকলেরই অবধ্য।
কৌশিক বললেন, কল্যাণী, আমি খুশি হয়েছি, আমার ক্রোধ দূর হয়েছে, তোমার কথায় আমার মঙ্গল হবে। তার পর কৌশিক জনকরাজার পুরী মিথিলায় গেলেন এবং ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা কোরে ধর্মব্যাধের নিকট উপস্থিত হলেন। ধর্মব্যাধ তখন তার দোকানে বসে মাংস বিক্রয় করছেন, বহু ক্রেতা সেখানে এসেছে। কৌশিককে দেখে ধর্মব্যাধ সসম্ভ্রমে নমস্কার কোরে বললেন, এক পতিব্রতা নারী আপনাকে এখানে আসতে বলেছেন তা আমি জানি। এই স্থান আপনার যোগ্য নয়, আমার বাড়িতে চলুন। ধর্মব্যাধের বাড়িতে গিয়ে কৌশিক বললেন, বৎস, তুমি যে পাপ কর্ম করো তা তোমার যোগ্য নয়। ধর্মব্যাধ বললেন, আমি আমার স্বধর্ম অনুযায়ী কর্মই করি। আমি বিধাতা নির্দিষ্ট ধর্ম পালন করি, বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করি, সত্য বলি, ঈর্ষা করি না, যথাশক্তি দান করি, দেবতা অতিথি ও দাস-দাসীদের ভোজনের পর অবশিষ্ট অন্ন খাই। আমি নিজে প্রাণীবধ করি না, অন্যে যে শুয়োর, মহিষ, হরিণ মারে আমি তাদের মাংস বেচি। আমি মাংস খাই না, দিনে উপবাসী থেকে রাত্রে ভোজন করি। আমার পেশা যে ভালো নয় তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু বিধির বিধান খণ্ডন করা যায় না, আমি পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল ভোগ করছি। মাংসে দেবতা, পিতৃগণ, অতিথি ও পরিজনের সেবা হয়, সেজন্য নিহত পশুরও ধর্ম হয়। বেদে নির্দিষ্ট আছে যে, অন্নের ন্যায় ওষধি, লতা, পশু, পক্ষীও মানুষের খাদ্য। রাজা রন্তিদেবের পাকশালায় প্রত্যহ দু হাজার গরুর মাংস রান্না হতো। বিধান মেনে মাংস খেলে পাপ হয় না। ধান আদি শস্যবীজও জীব। বিভিন্ন প্রাণী পরস্পরকে ভক্ষণ করেই জীবিত থাকে, মানুষ পথে চলবার সময় মাটিতে থাকা বহু প্রাণী বধ করে। জগতে অহিংসক কেউ নেই।
তার পর ধর্ম, দর্শন ও মোক্ষ সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিয়ে ধর্মব্যাধ বললেন, যে ধর্ম দ্বারা আমি সিদ্ধিলাভ করেছি তা আপনি প্রত্যক্ষ করুন। এই বলে তিনি কৌশিককে এক মনোরম প্রাসাদে নিয়ে গেলেন, সেখানে ধর্মব্যাধের মাতা-পিতা আহারের পর শুভ্র বসন পরে সন্তুষ্ট মনে উত্তম আসনে বসে আছেন। ধর্মব্যাধ মাতা-পিতার পায়ে মাথা রাখলে তারা বললেন, পুত্র ওঠো, ধর্ম তোমাকে রক্ষা করুন। ধর্মব্যাধ কৌশিককে বললেন, এঁরাই আমার পরম দেবতা এবং ইন্দ্রাদি তেত্রিশ কোটি দেবতার সমান। আপনি নিজের মাতা-পিতাকে অবজ্ঞা করে তাদের অনুমতি না নিয়ে বেদাধ্যায়নের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আপনার শোকে তারা অন্ধ হয়ে গেছেন, আপনি শীঘ্র গিয়ে তাদের কষ্ট দূর করুন।
কৌশিক বললেন, আমি নরকে পতিত হচ্ছিলাম, তুমি আমাকে উদ্ধার করলে। তোমার উপদেশ অনুসারে আমি মাতা-পিতার সেবা করবো। তোমাকে আমি শূদ্র মনে করি না, কিন্তু কোন্ কর্মের ফলে তোমার এই দশা হয়েছে? ধর্মব্যাধ বললেন, পূর্বজন্মে আমি বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ ও এক রাজার বন্ধু ছিলাম। তার সঙ্গে মৃগয়ায় গিয়ে আমি হরিণ মনে করে এক ঋষিকে বাণবিদ্ধ করি। তার অভিশাপে আমি ব্যাধ হয়ে জন্মেছি। আমার প্রার্থনায় তিনি বললেন, তুমি শূদ্রযোনিতে জন্মগ্রহণ করেও ধর্মজ্ঞ, জাতিস্মর ও মাতা-পিতার সেবাপরায়ণ হবে, শাপক্ষয় হলে আবার ব্রাহ্মণ হবে। তার পর আমি সেই ঋষির দেহ থেকে শর তুলে ফেলে তাকে তার আশ্রমে নিয়ে গেলাম। তিনি মারা যাননি। তখন ধর্মব্যাধকে প্রদক্ষিণ করে কৌশিক তার আশ্রমে ফিরে গেলেন এবং মাতা-পিতার সেবা করতে থাকলেন।
______________
(ক্রমশ)