Storey of Mahabharat Part 27 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 27

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 27

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২৭

অর্জুনের সুভদ্রাহরণ এবং অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের জন্ম
 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

অর্জুনের সুভদ্রাহরণ এবং অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের জন্ম


প্রভাস তীর্থ থেকে কৃষ্ণ অর্জুনকে রৈবতক পর্বতে নিয়ে যাওয়ার পরে কিছুদিন সেখানে বিশ্রাম করে অবশেষে রথে চড়ে কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বারকায় যাত্রা করলেন।

কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুন দ্বারকায় পৌঁছানোর কিছুদিন পরে রৈবতক পর্বতে বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়দের মহোৎসব আরম্ভ হোলো। বহু সহস্র নগরবাসী স্ত্রী ও অনুচরদের সঙ্গে পদব্রজে ও নানা রকম যান-বাহনে কোরে মহোৎসবে যোগ দিতে এলো। হলধর মদিরা পান কোরে মত্ত হয়ে তার পত্নী রেবতীর সঙ্গে বিচরণ করতে লাগলেন। প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, অক্রুর, সারণ, সাত্যকি প্রভৃতি সকলে তাদের স্ত্রীদের নিয়ে এলেন। কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুন নানাপ্রকার বিচিত্র সমারোহ দেখে বেড়াতে লাগলেন।

একদিন অর্জুন বসুদেবের কন্যা সালংকারা সুদর্শনা সুভদ্রাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কৃষ্ণ তা লক্ষ্য করে হাসিমুখে বললেন, অর্জুন তোমার মন হঠাৎ উদাস হোলো কেন? ইনি আমার বোন সুভদ্রা, আমার পিতার অত্যন্ত প্রিয় কন্যা। যদি চাও তো আমি নিজেই পিতাকে বলব। অর্জুন বললেন, তোমার এই বোন যদি আমার পত্নী হন তবে আমি কৃতার্থ হবো, কিন্তু এঁকে পাবার উপায় কি? কৃষ্ণ বললেন, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে স্বয়ংবর বিহিত, কিন্তু স্ত্রীস্বভাব অনিশ্চিত, কাকে পতিরূপে বরণ করবে কে জানে। তুমি আমার বোনকে জোর কোরে হরণ করো। ধর্মজ্ঞগণ বলেন জোর কোরে কন্যাকে হরণ কোরে বিবাহ বীরগণের পক্ষে ধর্মবিহিত। তার পর কৃষ্ণ ও অর্জুন দ্রুতগামী দূত পাঠিয়ে যুধিষ্ঠিরের সম্মতি আনালেন।

অর্জুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দ্রুতগামী রথে যাত্রা করলেন। সুভদ্রা পূজা শেষ করে রৈবতক পর্বত প্রদক্ষিণ করে দ্বারকায় ফিরছিলেন, অর্জুন তখন তাঁকে জোর কোরে রথে তুলে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে চললেন। কয়েকজন সৈনিক এই ব্যাপার দেখে কোলাহল করতে করতে সুধর্মা নামক মন্ত্রণাসভায় এসে সভার প্রধানকে জানালে, সভার প্রধান যুদ্ধসজ্জার জন্য মহাভেরী বাজাতে লাগলেন। সেই শব্দ শুনে যাদবগণ পানভোজন ত্যাগ করে সভায় এসে মন্ত্রণা করলেন এবং অর্জুনের আচরণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।

সুরাপানে মত্ত বলরাম সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর পরিধানে নীল বসন, গলায় বনমালা। তিনি বললেন, ওহে নির্বোধগণ, কৃষ্ণের মত না জেনেই তোমরা গর্জন করছো কেনো? তিনি কি বলেন আগে শোন তার পর যা হয় করো। তার পর তিনি কৃষ্ণকে বললেন, তুমি নির্বাক হয়ে রয়েছ কেনো? তোমার জন্যই আমরা অর্জুনকে সম্মান করেছি, কিন্তু সেই কুলাঙ্গার তার যোগ্য নয়। সুভদ্রাকে হরণ করে সে আমাদের অপমান করেছে, এই অন্যায় আমি সইব না। আমি একাই পৃথিবী থেকে পাণ্ডবসহ কুরুকুল বিনাশ করব। সভাস্থ সকলেই বলরামের কথার অনুমোদন করলেন। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন যা করেছেন তাতে আমাদের বংশের অপমান হয় নি, বরং মানবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা ধনের লোভে কন্যা বিক্রয় করবো এমন কথা তিনি ভাবেন নি, স্বয়ংবরেও তিনি সম্মত নন, এই কারণেই তিনি ক্ষাত্রধর্ম অনুসারে কন্যা হরণ করেছেন। অর্জুন ভরত-শান্তনুর বংশে কুন্তীর গর্ভে জন্মেছেন, তিনি যুদ্ধে অজেয়, এমন সুপাত্র কে না চায়? আপনারা শীঘ্র গিয়ে মিষ্টবাক্যে তাকে ফিরিয়ে আনুন, এই আমার মত। তিনি যদি আপনাদের পরাজিত করে স্বভবনে চ’লে যান তবে আপনাদের যশ নষ্ট হবে, কিন্তু মিষ্ট কথায় ফিরিয়ে আনলে তা হবে না। আমাদের পিসির পুত্র হয়ে তিনি শত্রুতা করবেন না।

যাদবগণ কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুনকে ফিরিয়ে আনলেন, তিনি সুভদ্রাকে বিবাহ করে এক বৎসর দ্বারকায় রইলেন, তার পর বনবাসের অবশিষ্ট কাল পুষ্করতীর্থে যাপন করলেন। বারো বছর পূর্ণ হলে অর্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে গেলেন। দ্রৌপদী তাকে বললেন, কৌন্তেয়, তুমি সুভদ্রার কাছেই যাও, পুনর্বার বিবাহ করলে পূর্বের বিবাহ বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। অর্জুন বার বার ক্ষমা চেয়ে দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিলেন এবং সুভদ্রাকে গোপবধূর বেশে কুন্তীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কুন্তী পরম প্রীতির সহিত তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। সুভদ্রা দ্রৌপদীকে প্রণাম করলেন। দ্রৌপদী তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন, তোমার স্বামীর যেন শত্রু না থাকে।

সৈন্যদলে বেষ্টিত হয়ে যদুবীরগণের সঙ্গে কৃষ্ণ ও বলরাম নানাবিধ মহার্ঘ উপহার নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন। অনেক দিন আনন্দে যাপন করে সকলে দ্বারকায় ফিরে গেলেন, কেবল কৃষ্ণ থেকে গেলেন।

কিছুকাল পরে সুভদ্রা একটি পুত্র প্রসব করলেন। নির্ভিক তেজস্বী সেই পুত্রের নাম রাখলেন অভিমন্যু। জন্মকাল থেকেই কৃষ্ণ এই বালকের সমস্ত শুভকার্য সম্পন্ন করলেন। অর্জুন দেখলেন, অভিমন্যু শৌর্যে বীর্যে কৃষ্ণেরই তুল্য। দ্রৌপদীও যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডবের ঔরসে পাঁচটি বীর পুত্র লাভ করলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন।

______________

(ক্রমশ)