Storey of Mahabharat Part 26 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 26

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 26

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২৬

অর্জুনের বনবাস এবং উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে বিবাহ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 
অর্জুনের বনবাস এবং উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে বিবাহ

নারদের উপদেশ মেনে পাণ্ডবগণ নিয়ম করলেন যে দ্রৌপদী এক একজনের গৃহে এক এক বৎসর বাস করবেন এবং সেই সময়ে অন্য কোনও ভাই যদি তাঁদের দেখেন, তবে তাকে বারো বৎসর বনবাসে যেতে হবে। এই নিয়ম পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকে পালন করবে বলে প্রতিজ্ঞা করবার কিছুদিন পরে একদিন কয়েক জন ব্রাহ্মণ ইন্দ্রপ্রস্থে এসে অভিযোগ করলেন, কিছু নীচ লোকে আমাদের গরু চুরি করছে। যে রাজা ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ কর নেন অথচ প্রজাদের সম্পদ রক্ষা করেন না, তাঁকে লোকে পাপী বলে। ব্রাহ্মণের ধন চোরে নিয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিকার করো। অর্জুন ব্রাহ্মণদের আশ্বাস দিয়ে অস্ত্র আনতে গেলেন, কিন্তু যে ঘরে অস্ত্র ছিল সেই ঘরে তখন দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠির বাস করছিলেন। অর্জুন সমস্যায় পড়ে ভাবলেন, যদি ব্রাহ্মণের ধনরক্ষা না করি তবে রাজা যুধিষ্ঠিরের মহা অধর্ম হবে, আর যদি নিয়মভঙ্গ করে তার ঘরে যাই, তবে আমাকে বনবাসে যেতে হবে। যাই হোক আমি ধর্ম পালন করবো। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ঘরে গেলেন এবং তার সম্মতিক্রমে ধনুর্বাণ নিয়ে ব্রাহ্মণদের কাছে এসে বললেন, শীঘ্র চলুন, চোরেরা দূরে যাবার আগেই তাদের ধরতে হবে।

অর্জুন রথে চড়ে  চোরদের পিছনে তাড়া কোরে তাদের ধরে ফেলে শাস্তি দিয়ে সমস্ত গরু উদ্ধার করে ব্রাহ্মণদের দিলেন এবং ফিরে এসে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমি নিয়ম লঙ্ঘন করেছি, আজ্ঞা দিন, প্রায়শ্চিত্তের জন্য বনে যাবো। যুধিষ্ঠির কাতর হয়ে বললেন, তুমি আমার ঘরে এসেছিলে সেজন্য আমি অসন্তুষ্ট হইনি, জ্যেষ্ঠের ঘরে কনিষ্ঠ এলে দোষ হয় না, তার বিপরীত হলেই দোষ হয়। অর্জুন বললেন, আপনার মুখেই শুনেছি — ধর্মাচরণে ছল করবে না। আমি অস্ত্র স্পর্শ করে বলছি, সত্য থেকে বিচলিত হবো না। তার পর যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিয়ে অর্জুন বারো বৎসরের জন্য বনে গেলেন।

বহু দেশ ভ্রমণ করে অর্জুন গঙ্গাদ্বারে এসে সেখানে বাস করতে লাগলেন। একদিন তিনি স্নানের জন্য গঙ্গায় নামলে নাগরাজকন্যা উলূপী তাকে টেনে নিয়ে গেলেন। অর্জুনকে উলূপী বললেন, আমি কৌরব্য নামক নাগের কন্যা, আপনি আমাকে বিবাহ করুন। উলূপীর কাতর অনুনয়ে অর্জুন উলূপীকে বিবাহ করলেন। উলূপী অর্জুনকে বর দিলেন, আপনি জলে অজেয় হবেন এবং সকল জলচর আপনার বশ হবে।

কিছুদিন পরে উলূপীর কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন নানা তীর্থ পর্যটন করলেন, তার পর মণিপুরে এলেন। সেখানকার রাজা চিত্ৰবাহনের সুন্দরী কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুন তাঁকে বিবাহ করতে চাইলেন। রাজা অর্জুনের পরিচয় জেনে নিয়ে বললেন, আমাদের বংশে প্রভঞ্জন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি পুত্রের জন্য তপস্যা করলে মহাদেব তাকে বর দিলেন, তোমার বংশে প্রতি পুরুষের একটিমাত্র সন্তান হবে। আমার পূর্বপুরুষদের একটি কোরে পুত্র হয়েছিল, কিন্তু আমার একটি কন্যা হয়েছে, কিন্তু, তাকেই আমি পুত্র বলে মনে করি। তার গর্ভজাত পুত্র আমার বংশধর হবে — এই প্রতিজ্ঞা যদি কর তবে আমার কন্যাকে বিবাহ করতে পারো। অর্জুন সেইরূপ প্রতিজ্ঞা করে চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করলেন এবং মণিপুরে তিন বৎসর বাস করলেন। তার পর পুত্র হলে, চিত্রাঙ্গদাকে আলিঙ্গন করে পুনর্বার ভ্রমণ করতে গেলেন।

একদিন অর্জুন দেখলেন, অগস্ত্য, সৌভদ্র, পৌলম, কারন্ধম, ও ভরদ্বাজ এই পঞ্চতীর্থ তপস্বিগণ বর্জন করেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করে তিনি জানলেন যে এইসকল তীর্থে পাঁচটি কুম্ভীর আছে, তারা মানুষকে টেনে নেয়। তপস্বীদের বারণ না শুনে, অর্জুন সৌভদ্র তীর্থে স্নান করতে নামলেন। এক বৃহৎ জলজন্তু তার পা ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে অর্জুন তাকে সবলে উপরে তুলে আনলে সেই প্রাণী সালংকারা সুন্দরী নারী হয়ে গেলো। সে বললো, আমার নাম বর্গা, আমি অপ্সরা, কুবেরের প্রিয়া। আমি চার সখীর সঙ্গে ইন্দ্রলোকে গিয়েছিলাম, ফেরবার সময় আমরা দেখলাম এক রূপবান ব্রাহ্মণ নির্জন স্থানে বেদাপাঠ করছেন। আমরা তাকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করলে তিনি শাপ দিলেন, তোমরা কুম্ভীর হয়ে শতবর্ষ জলে বাস করবে। আমরা অনুনয় করলে তিনি বললেন, কোনও পুরুষশ্রেষ্ঠ যদি তোমাদের জল থেকে তোলেন, তবে নিজ রূপ ফিরে পাবে। পরে নারদ আমাদের দুঃখের কথা শুনে বললেন, তোমরা দক্ষিণ সাগরের তীরে পঞ্চতীর্থে যাও, অর্জুন তোমাদের উদ্ধার করবেন। তখন থেকেই আমরা এখানে আছি। আমাকে যেমন মুক্ত করেছেন তেমন কৃপা কোরে আমার অন্য সখীদেরও মুক্ত করুন। অর্জুন অন্য চার অপ্সরাকেও শাপমুক্ত করলেন।

সেখান থেকে অর্জুন পুনর্বার মণিপুরে গেলেন এবং রাজা চিত্ৰবাহনকে বললেন, আমার পুত্র বভ্রুবাহনকে আপনার কাছেই রাখুন। তিনি চিত্রাঙ্গদাকে বললেন, তুমি এখানে থেকে পুত্রকে পালন করো, পরে ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে আমার মা, ভাই প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হবে। যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করবেন, তখন তোমার পিতার সঙ্গে যেও আর আমার বিরহে দুঃখ কোরো না।

তার পর অর্জুন পশ্চিম সমুদ্রের তীরবর্তী সকল তীর্থ দেখে প্রভাসে এলেন। সেই সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ সেখানে এসে অর্জুনকে রৈবতক পর্বতে নিয়ে গেলেন। অর্জুন সেখানে সুখে বিশ্রাম করে রথে চড়ে কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বারকায় যাত্রা করলেন।

______________

(ক্রমশ)