Storey of Mahabharat Part 25 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 25

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 25

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২৫

পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে বাস এবং তিলোত্তমা ও সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে বাস এবং তিলোত্তমা ও সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনি
 

বিদুর নানাবিধ ধনরত্ন উপহার নিয়ে দ্রুপদের কাছে গিয়ে দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবকে হস্তিনাপুরে নিয়ে যাবার অনুমতি চাইলে, দ্রুপদ বললেন, আপনার প্রস্তাব অতি সংগত। তবে, যদি পাণ্ডবগণ ইচ্ছা করেন এবং বলরাম ও কৃষ্ণ তাতে মত দেন তবে পাণ্ডবগণ অবশ্যই যাবেন। কৃষ্ণ বললেন, এঁদের যাওয়াই উচিত মনে করি, এখন মহারাজা দ্রুপদ যেমন আদেশ করেন। দ্রুপদ বললেন, পুরুষোত্তম কৃষ্ণ যা উচিৎ মনে করেন, আমিও তাই কর্তব্য মনে করি।  তারপর পাণ্ডবগণ দ্রোণ, কৃপ, বিকর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে সুসজ্জিত হস্তিনাপুরে মহা আনন্দে প্রবেশ করলেন। দুর্যোধনের পত্নী এবং অন্যান্য বধুগণ দ্রৌপদীকে অতি আদরের সহিত বরণ করলেন। গান্ধারী তাকে আলিঙ্গন করে মনে করলেন, এই পাঞ্চালীর জন্য আমার পুত্রদের মৃত্যু হবে। তাঁর আদেশে বিদুর কুন্তী ও দ্রৌপদীকে পাণ্ডুর ভবনে নিয়ে গেলেন এবং সব বিষয়ে তাদের সাহায্য করতে লাগলেন। কিছুকাল পরে ভীষ্মের উপস্থিতিতে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তোমরা অর্ধেক রাজ্য নাও এবং খাণ্ডবপ্রস্থে বাস করো, তা হলে আমাদের মধ্যে আর বিবাদ হবে না।

পাণ্ডবগণ সম্মত হলেন। তারা কৃষ্ণকে সঙ্গে কোরে ঘোর বনপথ দিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে গেলেন এবং সেখানে বহু প্রাসাদ, পরিখা ও প্রাচীর বেষ্টিত উপবন, সরোবর শোভিত স্বর্গধামতুল্য এক নগর স্থাপন করলেন এবং খাণ্ডবপ্রস্থের নতুন নামকরণ করলেন ইন্দ্রপ্রস্থ। পাণ্ডবদের সেখানে প্রতিষ্ঠিত করে বলরাম ও কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরে গেলেন।

চার ভাই ও দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে সুখে বাস করতে লাগলেন। একদিন দেবর্ষি নারদ তাঁদের কাছে এলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে নিজের আসনে বসিয়ে যথাবিধি অর্ঘ্য নিবেদন করলেন। তাঁর আদেশে দ্রৌপদী নারদকে প্রণাম করে হাতজোড় কোরে দাঁড়িয়ে রইলেন। নারদ তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, এখন যেতে পারো। দ্রৌপদী চলে গেলে নারদ পাণ্ডবগণকে নিভৃতে বললেন, পাঞ্চালী একাই তোমাদের সকলের ধর্মপত্নী, এমন নিয়ম করো যাতে তোমাদের মধ্যে বিভেদ না হয়। তার পর নারদ সুন্দ উপসুন্দের কাহিনি বললেন।

প্রাচীনকালে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বংশজ দৈত্যরাজ নিকুম্ভের সুন্দ উপসুন্দ নামে দুই পরাক্রান্ত পুত্র জন্মেছিল। তারা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলো এবং সকল কাজ মিলেমিশে করতো। ত্রিভুবন বিজয়ের কামনায় তারা বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলো। দেবতারা ভয় পেয়ে নানাপ্রকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের তপস্যা ভঙ্গ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সুন্দ-উপসুন্দ বিচলিত হল না। তার পর ব্রহ্মা বর দিতে এলে তারা বললো, আমরা যেন মায়াবিদ, অস্ত্রবিদ, বলবান এবং অমর হই। ব্রহ্মা বললেন, তোমরা ত্রিভুবন বিজয়ের জন্য তপস্যা করছো, সে কারণে অমরত্বের বর দিতে পারি না। তখন তারা বললো, তবে এই বর দিন যে ত্রিভুবনের স্থাবর ও জঙ্গম থেকে আমাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং আমাদের মৃত্যু যদি হয় তো আমাদের পরস্পরের হাতেই হবে। ব্রহ্মা তাদের প্রার্থিত বর দিলেন। ব্রহ্মার কাছে বর পেয়ে তারা দৈত্যপুরীতে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠ্ল এবং বহু বৎসর ধরে নানাপ্রকার উৎসব করতে লাগল। তার পর তারা বিপুল সৈন্যদল নিয়ে দেবলোক জয় করতে গেল। দেবগণ ব্রহ্মার বরের বিষয় জানতেন, সেজন্য স্বর্গ ত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে পালিয়ে গেলেন। সুন্দ ও উপসুন্দ ইন্দ্রলোক এবং যক্ষ, রক্ষ, খেচর, মর্ত্যলোক, পাতালবাসী নাগ, সমুদ্রতীরবাসী ম্লেচ্ছ প্রভৃতি সকলকেই জয় করলো এবং আশ্রমবাসী তপস্বীদের উপরেও অত্যাচার করতে লাগল।

সুন্দ ও উপসুন্দের কাছে অত্যাচারিত হোয়ে দেবগণ ও মহর্ষিগণ ব্রহ্মার কাছে প্রতিকার প্রার্থনা  করলে ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে আদেশ দিলেন, তুমি এমন এক অপরূপা সুন্দরী রমণী সৃষ্টি করো যাকে সকলেই কামনা করবে। বিশ্বকর্মা ত্রিভুবনের স্থাবর ও জঙ্গম থেকে সর্বপ্রকার সুন্দর উপাদান দিয়ে এক অতুলনীয়া রূপবতী নারী সৃষ্টি করলেন। জগতের উত্তম বস্তু তিল তিল পরিমাণে মিলিত করে সেই নারীকে সৃষ্টি করার জন্য ব্রহ্মা তার নাম দিলেন তিলোত্তমা। তিনি আদেশ দিলেন, তুমি সুন্দ ও উপসুন্দের কাছে গিয়ে তাদেরকে প্রলুব্ধ করো। তিলোত্তমা যাবার পূর্বে দেবগণকে প্রদক্ষিণ করলো। ঘুরতে ঘুরতে তিলোত্তমা যে দিকে যায়, তাকে দেখবার জন্য সেই দিকেই ব্রহ্মার একটি কোরে মুখ সৃষ্টি হোলো, এইরূপে তিনি চতুর্মুখ হলেন। তিলোত্তমাকে দেখার জন্য ইন্দ্রের সহস্র নয়ন সৃষ্টি হল। শিব স্থির হয়ে তিলোত্তমাকে দেখছিলেন, সেজন্য তাঁর নাম হোলো স্থাণু।

সুন্দ ও উপসুন্দ বিন্ধ্যপর্বতের নিকট পুষ্পশোভিত উপবনে সুরাপানে মত্ত হয়ে বিহার করছিল, এমন সময় মনোহর বেশে তিলোত্তমা সেখানে উপস্থিত হোলো। তিলোত্তমার রূপ দেখে আকৃষ্ট হোয়ে সুন্দ তার ডান হাত এবং উপসুন্দ বাঁ হাত ধরলো। ক্রোধান্বিত হোয়ে সুন্দ বললো, এ আমার পত্নী, তোমার মাতৃসমা, তুমি এর হাত ছেড়ে দাও। উপসুন্দ বললো, এ আমার পত্নী, তোমার কন্যাসমা, তাই তুমি এর হাত ছেড়ে দাও। দুই ভাইযের কেউই তিলোত্তমাকে ছাড়তে রাজি না হওয়ায়, পরস্পর ঝগড়া শুরু করলো, তার পর তারা গদা নিয়ে যুদ্ধ করে পরস্পরকে আঘাত করতে থাকায় এক সময় দুজনেই মারা গেলো।

কাহিনি শেষ কোরে নারদ বললেন, সমস্ত বিষয়ে একমত হয়েও তিলোত্তমার জন্য দুই অসুর পরস্পরকে বধ করেছিল, অতএব তোমরা এমন উপায় কর যাতে দ্রৌপদীর জন্য তোমাদের বিচ্ছেদ না হয়। তখন পাণ্ডবগণ এই নিয়ম করলেন যে দ্রৌপদী এক একজনের গৃহে এক এক বৎসর বাস করবেন, সেই সময়ে অন্য কোনও ভাই যদি তাঁদের দেখেন তবে তাকে বারো বৎসর বনবাসে যেতে হবে।

______________

(ক্রমশ)