মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬৪
যুধিষ্ঠিরের দুর্যোধনকে যুদ্ধের আহ্বান
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
যুধিষ্ঠিরের দুর্যোধনকে যুদ্ধের আহ্বান
পাণ্ডবগণ অনেক খোঁজ করেও দুর্যোধনকে কোথাও দেখতে পেলেন না। তাঁদের বাহনসকল পরিশ্রান্ত হওয়ায় তারা সৈন্য সহ শিবিরে চলে গেলেন। তখন কৃপ অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা ধীরে ধীরে হ্রদের কাছে গিয়ে দুর্যোধনকে বললেন, রাজা ওঠো, আমাদের সাথে মিলিত হয়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ করো। জয়ী হয়ে পৃথিবী ভোগ করো অথবা নিহত হয়ে স্বর্গলাভ করো। দুর্যোধন বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনাদের জীবিত দেখছি। আপনারা পরিশ্রান্ত হয়েছেন, আমিও ক্ষতবিক্ষত হয়েছি, এখন যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না, বিশ্রাম কোরে ক্লান্তিহীন হয়ে শত্রুজয় করবো। বীরগণ, আপনাদের মহৎ অন্তঃকরণ এবং আমার প্রতি পরম অনুরাগ আশ্চর্য নয়। আজ রাত্রে বিশ্রাম কোরে কাল আমি নিশ্চয় আপনাদের সহিত মিলিত হয়ে যুদ্ধ করবো। অশ্বত্থামা বললেন, আমি শপথ করছি আজই সোমক ও পাঞ্চালগণকে বধ করবো।
এই সময়ে কয়েকজন ব্যাধ শ্রান্ত হয়ে জলপানের জন্য হ্রদের নিকটে উপস্থিত হোলো। এরা প্রত্যেক দিন ভীমকে মাংস এনে দিত। ব্যাধরা আড়াল থেকে দুর্যোধন অশ্বত্থামা প্রভৃতির সমস্ত কথা শুনল। আগে যুধিষ্ঠির এদের কাছে দুর্যোধন সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলেন। দুর্যোধন হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন জানতে পেরে তারা পাণ্ডবশিবিরে গেল। দ্বাররক্ষীরা তাদের বাধা দিলো, কিন্তু ভীমের আদেশে তারা শিবিরে প্রবেশ কোরে তাকে সব কথা বললো। ভীম তাদের প্রচুর অর্থ দিলেন এবং যুধিষ্ঠির প্রভৃতিকে দুর্যোধনের সংবাদ জানালেন। তখন পাণ্ডবগণ রথে চড়ে সদলে বিশাল দ্বৈপায়ন হ্রদের নিকট উপস্থিত হলেন। শঙ্খের আওয়াজ, রথের ঘর্ঘর শব্দ ও সৈন্যদের কোলাহল শুনে কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা দুর্যোধনকে বললেন, পাণ্ডবরা আসছে, অনুমতি দাও আমরা এখন চলে যাই। তারা বিদায় নিয়ে দূরে গিয়ে এক বটবৃক্ষের নীচে বসে দুর্যোধনের বিষয় ভাবতে লাগলেন।
হ্রদের তীরে এসে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, দেখ, দুর্যোধন দৈবী মায়ায় জল স্তম্ভিত কোরে ভিতরে রয়েছে, এখন মানুষের থেকে তার ভয় নেই। কিন্তু এই শঠ আমার কাছ থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি পাবে না। কৃষ্ণ বললেন, ভরতনন্দন, মায়ার দ্বারাই মায়াবীকে নষ্ট করতে হয়। আপনি কূট উপায়ে দুর্যোধনকে বধ করুন, এইরূপ উপায়েই দানবরাজ বলি বধ হয়েছিলেন এবং হিরণ্যকশিপু বৃত্র রাবণ তারকাসুর সুন্দ-উপসুন্দ প্রভৃতি নিহত হয়েছিলেন।
যুধিষ্ঠির সহাস্যে জলের মধ্যে বসে থাকা দুর্যোধনকে বললেন, দুর্যোধন ওঠো, আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো। তোমার দর্প আর মান কোথায় গেল? যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা বীর ও সজ্জনের ধর্ম নয়। তুমি পুত্র ভাই ও পিতৃগণকে নিপাতিত দেখেও যুদ্ধ শেষ না কোরে নিজে বাঁচতে চাও কেন? বৎস, তুমি আত্মীয় বন্ধু ও বান্ধবগণকে বিনষ্ট করিয়ে হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে আছ কেন? তুমি বীর নও তথাপি মিথ্যা বীরত্বের অভিমান করো। বেরিয়ে এস, ভয় ত্যাগ কোরে যুদ্ধ করো। আমাদের পরাজিত কোরে পৃথিবী শাসন করো অথবা নিহত হয়ে ভূমিতে শয়ন করো।
দুর্যোধন জলের মধ্যে থেকে উত্তর দিলেন, মহারাজ, প্রাণীগণ ভয়ে অভিভূত হয় তা বিচিত্র নয়, কিন্তু আমি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসিনি। আমার রথ নেই, তৃণ নেই, আমার পার্শ্বরক্ষী সারথি নিহত হয়েছে, আমি সহায়হীন একা, অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য জলমধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। কুন্তীপুত্র, আপনারা আশ্বস্ত হোন, আমি উঠে আপনাদের সকলের সঙ্গেই যুদ্ধ করবো।
যুধিষ্ঠির বললেন, দুর্যোধন, আমরা আশ্বস্তই আছি। বহুক্ষণ তোমার খোঁজ করেছি, এখন জল থেকে উঠে যুদ্ধ করো। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, যাঁদের জন্য কুরুরাজ্য আমার কাম্য, আমার সেই ভাইয়েরা সকলেই পরলোকে গেছেন। আমাদের ধনরত্নের ক্ষয় হয়েছে, ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠগণ নিহত হয়েছেন, আমি বিধবা নারীর তুল্য এই পৃথিবী ভোগ করতে ইচ্ছা করি না। তথাপি আমি পাণ্ডব ও পাঞ্চালদের উৎসাহ ভঙ্গ কোরে আপনাকে জয় করবার আশা করি। কিন্তু পিতামহ ভীষ্মের পতন, ও দ্রোণ ও কর্ণের নিধনের পর আর যুদ্ধের প্রয়োজন দেখি না। আমার পক্ষের সকলেই বিনষ্ট হয়েছে, আমার আর রাজ্যের স্পৃহা নেই, আমি দুই খণ্ড মৃগচর্ম পরে বনে যাবো। মহারাজ, আপনি এই পৃথিবী যথাসুখে ভোগ করুন।
দুর্যোধনের করুণ বাক্য শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস, তোমার এই আর্তপ্রলাপ আমার ভালো লাগছে না। তুমি সমস্ত পৃথিবী দান করলেও আমি নিতে চাই না, তোমাকে যুদ্ধে পরাজিত করেই আমি এই বসুধা ভোগ করতে ইচ্ছা করি। তুমি এখন রাজ্যের অধীশ্বর নও, তবে দান করতে চাইছ কেন? যখন আমরা ধর্মানুসারে শান্তিকামনায় রাজ্য চেয়েছিলাম তখন দাওনি কেন? মহাবল কৃষ্ণ যখন সন্ধির প্রার্থনা করেছিলেন তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে, এখন তোমার চিত্তবিভ্রম হোলো কেন? সূচীর অগ্রে যেটুকু ভূমি ধরে তাও তুমি দিতে চাওনি, এখন সমস্ত পৃথিবী ছেড়ে দিচ্ছ কেন? পাপী, তোমার জীবন এখন আমার হাতে। তুমি আমাদের বহু অনিষ্ট করেছ, তুমি জীবনধারণের যোগ্য নও, এখন উঠে যুদ্ধ করো।
______________
(ক্রমশ)