ঝরাপাতা
পর্ব - ৩১
❤💕❤💕❤💕❤
আজ সকাল থেকে একটানা বনি আর পিউ রনির দুপাশে চিপকে আছে। ওরা এতবার রনিকে কখন বেরোবে প্রশ্ন করেছে, রনি ইউনিভার্সিটির প্রশ্ন সেট করতে বসে গেছে। ব্যালকনির দিকেও যায়নি। সেই কাজটাও বনি আর পিউ মাথায় তুলে নিয়েছে। পালা করে দেখে আসছে, মিলি দেখা দিল কিনা।
যখন ন টা বাজে, তখন ওরা দুজনেও বুঝল, বনির হাতে ধরা পড়ে মিলি লুকিয়ে পড়েছে। হতাশ হয়ে দুজন সরে পড়ল। টুকাইকে তার ঠামের ঘাড়ে চাপিয়ে রেখেছে। এক মাঝবয়সী মহিলা রান্না করে দেন। তবে মণিকা আর পিউ পালা করে সঙ্গে থাকে, চা হয় বারবার, কিংবা বাড়ির সবার পছন্দের কোনো রান্না করে। আজ সব শিকের উঠেছে।
এখন রনির তাড়াতেই পিউ গেল চা করতে আর বনি ছেলের সঙ্গে বেরোনোর আগে একটু খেলাধুলো করবে। দুজন চোখের আড়াল হতেই রনি ফোন করে মিলিকে। সে বেচারা ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। রনি চটপট সারাংশ শুনিয়ে দেয়, দাদা বৌদি ছিনে জোঁকের মতো ওর পিছনে পড়ে আছে। আগে আগে বেরোনো দূর অস্ত, কলেজের সময়েই কি ঠাট্টাই না করবে !
অবশ্য চা নিয়ে ফিরে এসে পিউ বলে, "তোমার গিন্নী তো আমাদের বাঘ ভাল্লুক ভেবে সরে সরে আছে। মাঝখান থেকে তোমার সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। এক কাজ করি, রবিবার সবাই সিনেমায় যাই। ওকে আজ নিয়ে বেরোলে বলে দাও, আমাদের নিয়ে টেনশন নেই। আমরা তোমাদের সাপোর্টার।"
- "সিনেমায় যাবে, বললেই হল? বাড়িতে কি বলবে মিলি?" রনি আঁতকে ওঠে।
- "আরে মিলি সব ভুলে গেছে, বাড়ির বাকিরা তো ভোলেনি। ওরা আমাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই যেতে দেবে। তাও তুমি একা নিয়ে যাচ্ছ না। আমি নিজে গিয়ে পারমিশন নেব, আমরা সবাই যাব বলব। কাকু কাকিমা ঠিক রাজি হবে।"
দাদা বৌদির জন্য মিলিকে গায়েব হয়ে থাকতে হচ্ছে বলে যেটুকু রাগ হয়েছিল, এই কথায় জল হয়ে যায়। রনি স্নান করতে দৌড়ল।
কলেজের গেটে মিলিকে নামিয়ে বলল, "যা বললাম মনে রেখো। বৌদি অনেক খোঁচাবে, কিচ্ছু বলবে না। তোমার থেকে সব গল্প শুনে আমাদেরই খ্যাপাবে।" ফিক করে হেসে ফেলে মিলি কলেজে ঢুকে পড়ল।
পলাশ অপেক্ষা করছিল, এগিয়ে এসে মিলির সঙ্গ ধরল, "কি রে আর ফোন করলি না যে কাল?"
- "না রে, কাল আমার ডাক্তারকে একটু ফোন করতে হল। অনেকক্ষণ সেখানে কথা বললাম। আর কত ফোন নিয়ে বসে থাকব? বাবা রাগ করবে। একেই তো কাল সারাদিন পড়াশোনা করিনি।"
- "কাল পড়াশোনা করিসনি মানে?" পলাশ দাঁড়িয়ে পড়েছে, "তুই তো পড়াশোনার জন্য আমাদের সঙ্গে গেলি না?"
ইসস, কি ভুল হয়ে গেছে, মিলি মনে মনে এ্যাত্তবড় জিভ কাটে। তার সঙ্গেই ভাবে, আর হবে নাই বা কেন? একদিন মাত্র প্রেম করছে, এত লোক, এত প্রশ্ন, মাথা ঠিক রাখা দায়। কোনোমতে ম্যানেজ করতে নামে, "পড়াশোনা মানে কি বলত, বই নিয়ে বসে পড়ার কথা বলছি। সেটা হয়নি কাল। আর ম্যাডাম বলেছেন, আমার যা পড়া তৈরি আছে, তাতে দুটো সেমিস্টারে বসার রেকমেন্ড করবেন না উনি। সেখানে আমার তো পারলে খাওয়া ঘুম ছেড়ে পড়ার কথা। পরীক্ষার ডেট দেওয়ার আগে যদি ম্যাডামকে দেখাতে পারি।"
- "কেন? ম্যাডাম রেকমেন্ড করছেন না কেন? তোর রনিদার চেনা, সেও হেল্প করছে না?"
- "হেল্প তো করছেন ম্যাডাম। পড়াচ্ছেন, টেস্ট নিচ্ছেন। এখন রেজাল্ট খারাপ করতে পারি বুঝলে দুটো সেমিস্টারে বসতে দেবেন কেন?"
- "তোর রনিদা নিজে কি বলছে?"
- "এভাবে চিমটি কেটে কথা বলছিস কেন? রনিদা এখানে কি বলবে? প্রিন্সিপাল স্যার প্রথম দিনই না করে দিয়েছেন। রনিদা একটা ব্যবস্থা করেছিল, আমার যাতে মনে না হয়, চেষ্টা করে দেখতেও পারলাম না। চেষ্টা করেছি। এখনও রনিদা বলছে, আর মাত্র কটাদিন সব ভুলে পড়তে।"
পলাশের মুখের গোড়ায় এসে গেছিল, "তোর এত ভরসা তো ঐ রনিদার উপর? কবে যে তোর সব কথা মনে পড়বে আর রনিদাকে তুই গলাধাক্কা দিয়ে নিজের পাশ থেকে তাড়াবি, আমি সেদিনের আশায় বসে আছি। ভালো এক ডাক্তার জুটেছে, সব কথা চেপে রেখেছে। অঙ্কুর আবার গদগদ সেই ডাক্তারকে নিয়ে। আমি চান্স পেলে কবে সব কথা বলে দিতাম। আর সব জানলে, রনিকে সবার সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তুই আবার বিয়ে করলে, তোর সব দুঃখ চলে যেত, তুই সুস্থ হয়ে যেতিস।"
- "কি রে, তুই কি রাগ করলি? আমি খারাপ করে বলিনি। পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে রনিদার কিছু করার নেই, এটাই বললাম।"
মিলির কথায় পলাশ দাঁত কিড়মিড় করে, ঐ মনে মনেই, "রনিদাই তোর পড়াশোনা, কেরিয়ার, সবকিছুর সর্বনাশ করেছে। আর আমার হাত পা বাঁধা, তাই কিছুই বলতে পারছি না। তবে ভাবিসনা অদ্রিজা, তোর পরীক্ষা দেওয়া হবে।"
মিলির দিকে ফিরে বলে, "তুই কি দুটো সেমিস্টার দিতে চাস এবার?"
- "ইচ্ছে তো ছিল। এখন পড়া তৈরি না হলে...."
- "তুই তোর মতো পড়তে থাক। পরীক্ষার কথা ভুলে যা। সেটা যা হওয়ার হবে।"
- "আমিও তাই ভেবেছি। আর তুইও এই নিয়ে বেকার ঝামেলা করিস না। তুই রাগ করলে আমার খুব খারাপ লাগবে।"
- "আরে না না রাগ কিসের? আমি সব জেনে নিচ্ছিলাম। বরং কাল যেটা বললাম, চল একদিন সিনেমা দেখে আসি।"
- "কটাদিন অপেক্ষা কর। পরীক্ষার পর যাব। আমি মাকে বলেছি। মা পরীক্ষার আগে আর কোথাও যাওয়া পছন্দ করবে না রে।"
- "ঠিক আছে।" পলাশ চুপ করে যায়।
আসলে এই ঠিক আছে মানে পলাশ নিজেই ভেবে নেয়, দুটো সেমিস্টারের পরীক্ষা তো অদ্রিজা দেবেই। তার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা ওর আছে। রনির সামনে দিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা ও করবে। তখন রনিই বা কি করে আর এই যে অদ্রিজার বাড়ির সবাই রনিকে জামাই বানিয়ে নাচানাচি করছে, তারাই বা আর কত খাতির করে রনিকে, দেখা আছে।
- "অদ্রিজাকে প্রথম থেকে আমি ভালোবাসি। ওকে সেটা বলব বলে, ওকে ভালো দেখাতে ওর আর অঙ্কুরের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে ভাব করেছি আমি। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল কোথাকার শ্রেয়ান সরকার। বিয়ের কথায় আমি অবাক হয়েছিলাম, মন ভেঙে গেছিল আমার। সব ছেড়ে দিয়ে চলেও যেতাম। কিন্তু একবার যখন তুমি নিজে চলে গেছ শ্রেয়ান সরকার, আর তো আমি তোমাকে জিততে দেব না। অঙ্কুরের পাহারায় তোমার কাহিনী বলতে পারছি না। কিন্তু আজ থেকে আমিও তোমার বিরুদ্ধে নামলাম। অদ্রিজাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে না, নিজের বৌয়ের পরিচয় দেবে না। শুধু অদ্রিজাকে হাত করার চেষ্টা চালাচ্ছ, যাতে তোমাকে সবাই ভালো ছেলে বলে। অদ্রিজাকে দিয়েই তোমাকে উপড়ে ফেলব, দেখে থাক।"
পলাশ যে মিলিকে পছন্দ করে সেটা বন্ধুদের একটু আধটু সন্দেহ হওয়ার আগেই হঠাৎ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ওর, লিলির বিয়ের নিমন্ত্রণে গিয়ে দেখল, মিলির বিয়ে হয়ে গেল। তারপর মন থেকে মিলির কথা বাদ দিতে চেয়েছিল পলাশ।
হয়ত ভুলেও যেত লেখাপড়া, বন্ধুবান্ধব, অন্য কাউকে ভালো লাগলে। মিলির দুর্ভাগ্য, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পলাশকেও অঙ্কুর রনির গল্প বলল, বলতে বাধ্য হল, বন্ধুরা যাতে মিলির সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে জানতে পারে। আর সেই গল্প শুনেই, তার পরেও রনি সবার সমর্থন পাচ্ছে দেখে পলাশের দ্বিগুণ হিংসে হচ্ছে। এই হিংসে আর নিজের মনোভাব লুকিয়ে রনির সঙ্গে লড়াই, মিলির জন্য নতুন খাদ তৈরি করছে প্রতিদিন।
চলবে