ঝরাপাতা
পর্ব - ৩০
❤💕❤💕❤💕❤
রনিকে গ্রেপ্তার করে বনি আর পিউ ঘরে এনে ঢোকায়। প্রথমে না না করলেও, দাদা আর বৌদির উৎপাতে আস্তে আস্তে রনির মুখ খোলে, হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে থাকে। ফোনে যে মিষ্টি মিষ্টি প্রেমালাপ চলছিল, লজ্জায় মাথা চুলকে সেটা স্বীকার করে।
পিউ বলে, "তুমি নাহয় মিষ্টি করে বৌ পটাচ্ছিলে, তোমার বৌ কি বলে? কিছু মনে পড়েছে?"
- "নাহ, কিছু মনে পড়েনি। আর ভাগ্যিস এখনও মনে পড়েনি। তাই আমার সঙ্গে কথা বলে।"
- "কথা বলে মানে কি? ঠাট্টা নয়, তোরা কি বাইরে দেখা টেখা করছিস? মানে তুই ওকে কিছু বলেছিস? প্রোপোজ করেছিস?" বনি সরাসরি তদন্তে নামে।
- "শুধু আজকে, আর নাহলে কোনোদিন আমরা কোথাও কথা বলিনি রে। কোথাও যাইনি। ও কলেজ গেছে, আমি ইউনিভার্সিটি গেছি। আজ ওদের ট্রাস্টি বডির একজন মারা যেতে ছুটি হয়ে গেছিল, শুনেছিস বোধহয় তুই। ওর বন্ধুরা সিনেমায় গেল, আমি একটু ওকে নিয়ে গেছিলাম। একটু কথা বললাম। ওর মনের কথা তো কিছুই জানতে পারছি না।" রনিও খুলে বলে।
- "কোথায় গেলে? কি কথা হল? সব বলো বলো। এ্যাই, কিচ্ছু বাদ দেবে না, সব বলবে।" পিউ ঘনিয়ে আসে।
কিছু বাদসাদ দিয়েই, নিজের রাগ অভিমান, মিলির মানভঞ্জন বাদ দিয়ে, মিলিকে যে ও নিজের ভালোবাসার কথা বলেছে, মিলিও যে সেকথা স্বীকার করেছে, সেগুলো সব বলে রনি। পিউ আর বনির জন্য সেটাই যথেষ্টরও বেশি। মিলি যখন রনিকে ভালোবাসে, তখন আর চিন্তা নেই।
পিউ বলে, "আমি খুব খুশি হয়েছি ভাই। তোমাকে কত বকেছি, কত ছোটবড় কথা শুনিয়েছি, তুমি সব ঠিক করে দিলে।"
- "এভাবে বললে আর কথা বলতে হবে না। তুমি আমাকে বকবে না? আমার ভুল ধরিয়ে দেবে না? তুমি চোখে আঙ্গুল দিয়ে সবটা দেখালে বলেই না আমি এগোতে সাহস পেলাম।" রনি বৌদির কাছে ওর আবদার ফিরে পেয়েছে।
বনি উঠে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে, "সত্যিই খুব খুশি হয়েছি রে। খুব চিন্তায় ছিলাম। এতদিন বলিনি, আজ তোকে বলছি। কি হবে, মিলি কি করবে, সারাক্ষণ ভাবতাম। যদি মিলি বিয়ে ভেঙে দেয়, আবার সেই বিয়ের দিনের মতো...... তোর যে মন ভেঙে যেত আমি বুঝেছি। এর চেয়ে ভালো কিছু হয় না। তোদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে নতুন করে, তোরা একসঙ্গে থাকতে পারবি, খুব আনন্দ হচ্ছে ভাবলেই।" রনিও প্রবল আবেগে দাদাকে জড়িয়ে ধরেছে। সবাই ওকে কাছে টেনে নিয়েছে আবার, আর কিছুই চাই না ওর।
মিলি নিজের ঘরে বসে ভাবছে, "এটা নিশ্চিত, রনিদা আমাকে তুই বলেই ডাকত। যদি সেটা সত্যি না হয়, তাহলে এমন কথা মনে হচ্ছেই বা কেন? আমার অসুখের জন্য এমন উলটো পালটা ভাবনা আসছে? আচ্ছা, আমার অসুখটাই বা আসলে কি হয়েছিল? সবাই বলেছে, প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল, সেটা থেকে মস্তিষ্কে চাপ পড়েছে। কিছু কিছু স্মৃতি নষ্ট হয়েছে। যেগুলো ডাক্তার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।"
বিছানা থেকে উঠে ঘরে পায়চারি করতে থাকে ও, "এত বড় একটা অসুখ হলই বা কিভাবে? দিদির বিয়ে ভণ্ডুল হয়েছে, বুঝলাম। আমার অসুখটা সেদিনই হল? দিদি চলে যাওয়ার শক? এত শক লাগতে পারে?"
কোথাও একটা ফাঁক, একটা গোলমাল, না মেলা হিসেবের চালচিত্র ফুটে উঠেছে ওর সামনে। যত এ নিয়ে ভাবছে, মিলির মাথায় আরও একটা অন্য ভাবনা জেগে উঠছে। ও এখনও অসুস্থ। ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছেন, সকলেই ওকে ভরসা দিয়েছে। তবুও সম্পূর্ণ সেরে উঠবেই ও, কে বলতে পারে? যদি ও এমনই থেকে যায়? স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝখানে? তার সঙ্গে পড়াশোনা, চাকরি বা সংসার জীবন, কোনো একটা বা সবগুলোর সংঘাতে খেই হারিয়ে ফেলে? আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে?
- "রনিদা আমাকে ভালোবাসে বলেছে। শুধু মুখের কথা নয়, কাউকে ভালোবাসলে যেমন তার ভালো করতে চেষ্টা করে মানুষ, তাকে ভালো রাখতে চেষ্টা করে, সেটা করে যাচ্ছে। তবুও এই চেষ্টাগুলো সফল নাও হতে পারে। আমি পুরো সুস্থ না দেখলে যদি রনিদা মুখ ফিরিয়ে নেয়, সেটাও সহ্য করতে পারব না। আবার আমার অসুখের জের রনিদার জীবনে টেনে নিয়ে যেতেও পারব না। আমিও ওকে ভালোবাসি। ওর ক্ষতি করতে পারব না।"
মিলি একটা ডায়রি নিয়ে লিখতে থাকে, "অনেক কথাই আমি জানি না। মনে নেই, অথবা আমার অসুখের সময় হয়েছে। সেগুলো আমাকে জানতে হবে। মনে করতে হবে, বা যারা জানে, তাদের থেকে জানতে হবে। বাড়ির কেউ বলবে না। দিদির বিয়ের দিনের কোনো কথাই বলে না। রনিদাও বলবে না। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমি যেমন ও পাশে বসায় ছুতো করে ওয়াশরুমে চলে গেছিলাম, ও ও সেরকম তুই বলে ডাকত স্বীকার করবে না, পুরনো কথা বললে আমার সমস্যা হয় কিনা, তাই ওয়াশরুমে চলে গেছিল।"
পেনটা দু আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে মিলি ভাবছে, এমন কে আছে, যে ওকে সত্যি কথা বলবে? সবাইকে কি ডাক্তার বারণ করেছে? তক্ষুণি মনে হয়, ডঃ গিরির সঙ্গেই কথা বলা দরকার। ওনার জানা উচিত, অর্ধেক কথা মনে পড়লে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। সেই অস্বস্তি ও কিভাবে সামলাবে?
মনে পড়ে ডঃ গিরির এ্যাসিস্টেন্ট মধুমিতা ব্যানার্জীর ফোন নম্বর দেওয়া আছে ওকে। প্রথমে বাবা মায়ের কাছেই কেবল ছিল। ওর কোনও সমস্যা হলে সেশনের ডেট ছাড়াও যোগাযোগ করতে। যেদিন রনিদাদের সঙ্গে দেখা হল চেম্বারে, সেদিন ওকেও নম্বর রাখতে দিয়েছেন, কোনো প্রশ্ন, কোনো সমস্যায় জানাতে বলেছেন।
নিজের ফোন থেকে নম্বরটা বের করতে করতে মিলি ভাবে, রনিদারা সবাই সেদিন ডাক্তারের চেম্বারে কি করছিল?
ডঃ মধুমিতা ব্যানার্জীর ফোন এনগেজড। দশ মিনিট পর আবার ফোন করবে ভেবে মিলি ডায়রিটা টেনে নেয়। কিছু লেখার আগেই মধুমিতার ফোন।
- "হ্যালো, অদ্রিজা, কেমন আছ?" মিষ্টি, আন্তরিক গলার স্বরে প্রত্যেকবারের মতোই ভরসা পায় মিলি।
- "ভালোই আছি। শুধু একটা খটকা লাগছে। তাই আপনাকে বিরক্ত করছি।"
- "তোমার কিছু নিয়ে খটকা লাগলে সবচেয়ে ভালো। তার মানে তোমার মেমোরি কাজ করছে, জাজমেন্টাল পাওয়ার ফিরছে আর বেসিক এ্যানালিসিস করতে পারছে তোমার ব্রেইন। তাই একটুও লজ্জা পাবে না, ঘাবড়াবে না। সবসময় আমাকে ফোন করবে। খুব ভালো হয়েছে, তুমিই ফোন করেছ, বাড়ির কাউকে করতে হয়নি। ওকে? সব হেজিটেশন সরিয়ে রেখে আমরা একটু দুই বন্ধু নিজেরা কথা বলি? তোমার যা মনে হচ্ছে, বলো।"
মিলি আবার স্বস্তি বোধ করছে, নিজের প্রিয় বন্ধুর সান্নিধ্যে আছে মনে হচ্ছে, "ডঃ ব্যানার্জী, আমার অসুখের পর আমাদের পাড়ায় একজন আমাকে তুমি করে কথা বলছে। খুবই গল্প হয়। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে, আগে ও তুই বলত। এটা কি এ্যাবনর্মাল কিছু? আমার কি নতুন কোনো প্রবলেম হচ্ছে, নাকি আমার নার্ভ দুর্বল বলে এসব মনে হচ্ছে?"
- "এর অনেক উত্তর হয় অদ্রিজা। উত্তর দেওয়ার জন্য উত্তর নয়। আসল কারণটা কি, সেটা জানতে হবে। নাহলে বৃথাই টেনশন করবে। টেনশন আর ঘটনা এ্যানালিসিস করা কিন্তু এক নয়। তুমি উত্তর খুঁজছ, ভেরি গুড। আগেই ভেবে নিও না, এটা সমস্যা। হয়ত সমস্যা মিটছে। যার ডাক নিয়ে ভাবছ, তাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত। সেটা কি সম্ভব? ইউ নো দ্য পারসন বেটার।"
- "আমি জিজ্ঞেস করেছি মনে হতেই। কেমন যেন এড়িয়ে গেল। আচ্ছা, আপনারা কি ওকে বারণ করেছেন, আমাকে পাস্ট জানাতে?"
- "তোমাকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে বারণ করা হয়েছিল প্রথমে। কারণ যে কোনো গল্পই স্টোরি টেলার তার মতো করে বলে। সেটা তোমার ক্ষেত্রে আমরা চাইনি। তুমি ধীরে ধীরে সব দেখো, জানো, বোঝো, এটাই চাই। তবে বারণ তো খালি তোমার বাড়ির লোককে করেছি।''
- "এও তো ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করেছিল। সেটাও আমার একটা খটকা, রনিদা, আই মিন, যার সঙ্গে আমার দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সে ম্যাডামের সঙ্গে কেন দেখা করতে গেছিল?"
- "আচ্ছা, তোমার খটকা ঐ ছেলেটিকে নিয়ে। ওর সঙ্গে তোমার কথাবার্তা হয়েছে? কেমন ব্যবহার করছে সে?"
- "এমনিতে খুব ভালো। ও আমাকে খুব হেল্প করছে পড়াশোনায়। ওকে নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই। প্রবলেম হল, আমার নিজের অনেক কিছু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। আচ্ছা, আমার এমন অসুখ কিভাবে হল? মানে, এটা কি কোনো ভাইরাল এ্যাটাক?"
- "না অদ্রিজা, এটা ভাইরাল এ্যাটাক নয়। বাইরে থেকে তুমি অসুস্থ হওনি। তোমার কিছু ইন্টারনাল প্রবলেম, মেইনলি নার্ভাস সিস্টেমের উপর প্রেশার পড়ায় এটা হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি, তোমার সঙ্গে ডিটেলস আলোচনা দরকার। তোমার প্রশ্ন আসলে অনেক। তোমার নেক্সট সেশন কবে? আমার নোট করা আছে, কিন্তু সেটা দেখতে হবে।"
- "দেখার দরকার নেই ম্যাম। পরশু শনিবার আমার সেশন, আমার মনে আছে।"
- "ভেরি গুড। তুমি খুব ভালো নিজের সব দিকে নজর রাখছ। শোনো, কাল ম্যাডামের খুব চাপ আছে, পরশুও। কাল নতুন এ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া যাবে না। পরশু তোমার নিজের টাইম আছে। একটা দিন অপেক্ষা করো। খুব দুশ্চিন্তা কোরো না। তুমি একটুও বেশি অসুস্থ হচ্ছ না। বরং এই প্রশ্নগুলো মনে আসা ভীষণ পজিটিভ সাইন। পরশু আমরা সবকটা প্রশ্ন নিয়ে ডিসকাস করব। ক্যান ইউ ওয়েট ফর আ ডে লঙ, অদ্রিজা?"
- "পারব, ম্যাম। আমি আপনাদের দেওয়া গান শুনব, দরকার হয় একটু আধটু নাচ প্র্যাকটিস করব। আর আমার পড়াশোনা করব। আমি পরশুই আসব।"
- "ভেরি গুড অদ্রিজা। এভাবে যখন নিজের ভাবনা সামলাতে পারছ, তুমি প্রায় সুস্থ হয়ে গেছে ধরে নাও।"
চলবে