Love Unlocked : 4
Pritha 🎀:
আজকে সারাটাদিন আরিয়া ক্যাফেই কাটিয়েছে। কাজের প্রথম দিনেই নিজের সবটা দিয়ে কাজগুলো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।সোনালী ছাড়াও আরো কিছু নতুন বন্ধু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। তারা তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছে। কিছু গেস্টও অ্যাটেন্ড করেছে। ওকে কাজ বলতে এটাই দেওয়া হয়েছে। ওর কথাবলার স্পিড আর খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে কথা বলার ভঙ্গিমার জন্য এই কাজের জন্যই ওকে ধার্য করা হয়েছে। ও সেটাই করেছে। এবার ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সময়টা দেখে নিয়ে গায়ের অ্যাপ্রনটা খুলে যথাস্থানে রেখে বেরোনোর জন্য উদ্যত হলো।
"আরিয়া কোথাও যাচ্ছ তুমি?" বলে উঠলো মেঘা নামের মেয়েটি। ইনিই আপাতত এখানের স্টাফদের লিডার।সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দেন।
"হ্যাঁ ম্যাম আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।আসলে প্রায় ছ-টা তো বাজতে যায়। তাই পারমিশন নিতে গেছিলাম, আমি কি বাড়ি যেতে পারি ?" একটু আমতা আমতা করে বলল আরিয়া। কাজের প্রথম দিনেই এমন ভাবে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হওয়াটা যে ঠিক দেখায়না ও জানে। কিন্তু একটু পরেই সাতটা নাগাদ হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেলে ও আর দাদার সাথে দেখা করতে পারবে না। সারাদিনে এই কিছুটা সময় দাদার সাথে দেখা করতে পারলেই ওর মনটা আনন্দে ভরে যায়। শত ব্যস্ততার মাঝেও ও চেষ্টা করে এই সময়টুকু বার করার।
"বাবাহ তোমার দেখছি বেশ তাড়া আছে ! তা বয়ফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে নাকি ?"
বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে এলো আরিয়ার। এই স্বভাবটাই ওর পছন্দ না। মেঘা মেয়েটা এমনিতে ভালোই। তবে অন্যের লাইফ নিয়ে বেশি কিউরিওসিটি। আর এই ব্যাপারটাই ওর পছন্দ না যে কেউ ওর লাইফ নিয়ে বেশি নাক গলাক। এমনকি এই কারণে ওর অনাথ হওয়া, দাদার হাসপাতালে ভর্তি কোনো কিছুই ও এখানের কাউকে জানায়নি। পার্সোনাল আর প্রোফেশনাল লাইফটা আলাদা রাখতেই বেশি পছন্দ করে ও।
আবার একটু ঠেলা মেরে মেঘা প্রশ্ন করে উঠলো "কিগো বললে না যে ! অপেক্ষা করছে নাকি ?"
"আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। তাছাড়া আমি তো জবটা পার্টটাইম করব বলে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। আমি তো কলেজ স্টুডেন্ট আমি প্রত্যেকদিন কলেজ করে সাতটা নাগাদ আসবো এরপর নয়টায় বাড়ি যাবো। আমার ডিমান্ড এর মধ্যে এই টুকুই ছিল যেটা আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম স্যারকে। আজ প্রথম দিন কাজ শিখবো বলেই এই সময় থেকে গেছি।কিন্তু এবার আমায় যেতে হবে।"
"আবার ডিমান্ড ? বাবাহ ! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে জবটা তোমায় দেওয়া হয়নি বরং তুমি আমাদের জবটা দিয়ে উদ্ধার করেছো !"
"আমার কথা যদি খারাপ লেগে থাকে আমায় ক্ষমা করবেন। তাছাড়া আমি আজকের জন্য তিন ঘণ্টা সময় দিয়ে দিয়েছি। আমায় কোনো ওভারটাইমের কথা বলেননি বস !"
"বস ? কে বস ? বাই এনি চান্স যিনি ইন্টারভিউ নিলেন তাকে তুমি বস ভাবছো না তো ?তিনি কিন্তু বস নন। তিনি হচ্ছেন ম্যানেজার, অখিলেশ গুপ্ত।"
"ওহ হ্যাঁ ভুলে গেছিলাম। আমায় সোনালী বলেছিল অবশ্য।"
"নতুন এসেছো নিজের জায়গা আগে তৈরি করো তারপর ডিমান্ড রাখবে। তাছাড়া তোমায় একটা কথা বলি শোনো পাঁচ কান করো না।এখানের বস ন- মাসে ছ- মাসে একবারও আসে কিনা সন্দেহ।আমি এত বছর কাজ করছি কেবল দুই বার মাত্র দেখেছি তাকে।তোমার কপাল ভালো তুমি আজ বসকে দেখার সৌভাগ্য করেছো।আজ কোনো কারণে আসছেন তিনি। ইউ নো বস একেবারে সেই দেখতে। বাইসেপ্স, ট্রাইসেপ্স ওহো আমি একেবারে ফিদা...।"
আবার বিরক্তি ধরে গেলো আরিয়ার। এটা ওর সিনিয়র না হয়ে কলেজের কেউ হলে দিত কষিয়ে দুটো থাপ্পড় যেমন আগের দিন আকাশ নামের লম্পট ছেলেটাকে দিয়েছিল।ইশ একটা ছেলেকে কিভাবে বর্ণনা করছে যেন লাইফ এ ছেলে দেখেনি। যাই হোক ও আবার নিজের টপিকে ফিরে এসে বলল "আমি কি বাড়ি যাবো?"
বসকে নিয়ে ভাবনার জগৎ এ ভাসতে ভাসতে মেঘা যেন টুপ করে মাটিতে আছার খেলো। এই মেয়েটা এখনো বাড়ি যাওয়া নিয়ে পরে আছে ! নাহ একে এর মতনই অর্ডার দিয়েই বোঝাতে হবে নাহলে বাগে আনা যাবে না। মেঘা গলা খাকারি দিয়ে একটু গম্ভীর ভাবে বলল "আজ ওভারটাইম করতে হবে।এতদিন পর বস এখানে আসছে। আমরা এই জন্যই সকাল থেকে সবকিছু পারফেক্ট ভাবে আরেঞ্জ করার চেষ্টা করছি। উনি মিটিংয়ের জন্য আমাদের এই ব্রাঞ্চটা চুস করেছেন এই আমাদের ভাগ্য ভালো। যাও বাইরে গিয়ে নো এন্ট্রি বোর্ডটা ঝুলিয়ে দাও।আজ আর কেউ আসতে পারবে না। পুরো হলটাই স্যারের জন্য রেডি করা হচ্ছে। ওরা সাজাচ্ছে ওদের হাতে হাতে সাহায্য করো। আর নিজেকে রেডি করো ঠিক ভাবে।সব কিছু ঠিকঠাক হওয়া চাই উনি কিন্তু খুব রাগী। আর আজ স্যারকে তুমি রিসিভ করবে।" বেশ লম্বা একটা বক্তৃতা দিয়ে অবশেষে থামলো মেঘা। পাশ থেকে জলের বোতলটা নিয়ে একটু জলও খেয়ে নিলো। হাপিয়ে গেছে ! "আমি যাই লিপস্টিকটা আরেকটু ডিপ করে আসি। আফটার অল মেইন ফোকাসে আমাকেই তো থাকতে হবে কিনা !" আরিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করেই গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেলো মেঘা।
এদিকে আরিয়ার মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। আজকে দাদার সাথে দেখা করা হবে না ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছু করার নেই। নতুন কাজ পেয়েছে তাছাড়া কিছু পাওয়ার জন্য কিছু তো ছাড়তেই হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অ্যাপ্রনটা আবার গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।বেড়িয়েই অবাক হয়ে গেলো। হলঘরটা খুব সুন্দর ভাবে ডেকোরেট করা হচ্ছে। কতরকম ফেইরি লাইটস এ রুমটা একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে। সাথে তাজা গোলাপের একটা মিষ্টি গন্ধ। কেউ উপর থেকে বড় হলুদ লাইটস গুলো ঝোলাতে ব্যস্ত আবার কেউ গোলাপ গুলো নিয়ে এক একটা জায়গায় রাখতে ব্যস্ত। মাঝে সোনালিকেও ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। ও ছুটে ছুটে বেশ কয়েকবার এদিক ওদিক গেছে ! হয়তো খুব কাজ করছে। কেউ আবার নিজের সাজগোজ ঠিক করছে। কেউ এমন সুন্দর একটা পরিবেশে নিজের ছবি ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত। এদের মাঝে নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর লাগলো আরিয়ার। এদেরও হয়তো পরিবার আছে। হয়তো আবার কি ! সত্যিই তো আছে ! কজন আর ওর মতো অভাগা হয় ! তারাও অনেক অপেক্ষা করে থাকে কিন্তু এরাও তো বিরামহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে ও কি স্বার্থপরের মতো বেরিয়ে যেতে চাইছিল। এখানে সবাই সকাল থেকে কাজ করছে। কিছুজন যারা সন্ধেবেলা আসার কথা তারা সন্ধ্যে বেলা এসেছে তাছাড়া বাকিরা সকাল থেকেই রয়েছে। আরিয়াও পরের দিন থেকে সন্ধ্যে বেলাই আসবে। আজকে শুধু ঐ হুকোমুখো বাইসেপ্স ওয়ালা বসের জন্য সবাইকে এমন হেনস্থা হতে হচ্ছে। বিরবিরিয়ে বলে উঠলো "হুহ কে না কে হোম মিনিস্টার আসছে রে ! আবার শুনলাম নাকের ডগায় নাকি রাগ। মাঝখান থেকে এই বেচারা দের কষ্ট ভুগতে হচ্ছে ! যত্তসব আপদ!" কথাটা শেষ করেই পেছন ফিরতে উদ্যত হলো ও। ওকে তো আর দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না ওকে হাতে হাতে কাজ করতে হবে তো নাকি !
"আহ বাবাগো মা গো ! আমার পিচ্চিপারা কোমর টা দিলো রে ! ভেঙে দিলো পুরো ! রাস্তার মাঝে কোন গাম্বাট এমন পিলার রেখেছিস রে হতচ্ছাড়া।"
হঠাৎই আরিয়ার চিৎকারে সবাই একেবারে হতবাক। মেয়েটা এসব বলছে কি !পরে গিয়ে কি বোধ বুদ্ধিও লোভ পেলো। ও কি বুঝতে পারছে না সামনে ওর যম দাঁড়িয়ে।সবার কপালে হাত।
শেষে সোনালী এগিয়ে এলো "চুপ কর বাজে বকছিস! আয় উঠে আয়।" বলে হাতটা বাড়িয়ে দিলো।
"নাহ আমার কারোর সাহায্য লাগবে না। আমি আরিয়া মজুমদার আমি একাই দুশো।কোন খাটাশের বেটা শালা আমায় ফেললি। চোখদুটো কি শশুরবাড়ি রেখে এসেছিস নাকি রে !" বলতে বলতে কোনরকমে উঠে দাঁড়ালো আরিয়া।
সকলের একেবারে দম বন্ধ অবস্থা। এটা আরিয়া কি করছে ! ডাইরেক্ট তুই তোকারি করছে ! তাও আবার বসকে ? আর তাদের রাগী আরোগেন্ট বস সেটা চুপচাপ দুই হাত ভাঁজ করে শুনছেন ! এটা কি ঝড় আসার আগের শান্ত রূপটা নয়তো ! নাহ আজ ভয়ংকর কিছু ঘটবে। এই অভাগী মেয়ে বোধহয় আজই জবটা খোয়াবে।
"এই আপনি কে হে! সোজা এসেই ঠুকে দিলেন ! ফিফথ গিয়ারে গাড়ি চালাবেন আর গাড়িতে ব্রেক এর ব্যবস্থা করেননি ?! বাহ বাহ ! শুনুন আজকে ক্যাফে বন্ধ আছে। আমি সবে বাইরে যাচ্ছিলাম নো এন্ট্রি বোর্ডটা ঝোলাতে। তার আগেই আপনার গাড়ি ব্রেকফেল করে আমার গায়ে উঠে গেছে। সরুন সরুন।" কথাটা শেষ করে আরিয়া লোকটিকে ঠেলতে উদ্যত হলে কি সর্বনাশ ঘটতে চলেছে বুঝে সোনালী একবার ডাক দেয় "আরিয়া উনি...."
কিন্তু আর বলা হয়ে ওঠে না। সামনের ব্যক্তির কটমটে দৃষ্টিতে জারি করা নিষেধাজ্ঞা মানতে ও বাধ্য হলো চুপ করতে।
" কি উনি কি ! কানা তো ? হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।কি ? আপনি আবার তাকিয়ে কেন! শুনুন আজ আমাদের বস আসবে। আমি বাবা বেশি ঝামেলায় জড়াতে চাইছি না আপনি বেরোন তো দেখি।" আরিয়া সাবলীল ভাবে কোমরে হাত রেখে বলে।
"Do you know who I am ?"
"ওমা অমন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলছেন কেন ! অকালে দাঁতগুলোর তো মৃত্যু ঘটবে। তখন লোক ফেকলু বলবে ! বাই দা রাস্তা ,আপনি কি স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন ! মনে পড়ছে না কিছু ? ও বুঝেছি ভুল করে এখানে এসে পড়েছেন রাইট ?"
"What!"
"হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি আপনি স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন কিন্তু ইংরেজিটা ভোলেননি। এতবার মনে না করালেও চলবে। কিন্তু আপনার কি সত্যিই মনে পড়ছে না যে আপনি কে !"
"আমার কেন মনে পড়বে না ! Are you mad !"
"উফ বাবা কথার আগে ইংলিশ পরে ইংলিশ ! তা মশাই নিজের পরিচয় যখন মনে পড়েছে তো খামোখা আমায় কেন জিজ্ঞেস করছেন যে do you know who I am !! আজব মানুষ তো আপনি !"
"তুমি বোধহয় জানো না আমি কে ! anyway, who are you !!"
"আরেহ এতো আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লাম ! এ একবার নিজে কে সেটা ভুলে যায় একবার আমি কে সেটা জানতে চায় ! আপনাকে কেন বলবো শুনি আমি কে ! আপনি নিজে কে সেটা আগে বাইরে দাঁড়িয়ে মনে করুন। যান যান বেরোন দেখি।উফ কি খাম্বার মতো লম্বা দেখো ঘাড় উঁচু করতে করতে ব্যথা হয়ে গেলো !" ঘাড় ডলতে ডলতে আরিয়া সামনের মানুষটার অগ্নিদৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাকে বার করতে উদ্যত হলো।
"আরেহ স্যার আপনি এসে গেছেন ! আসুন আসুন। আমাকে আগে বলবেন তো আমরা কখন ধরে অপেক্ষা করে আছি" বলতে বলতে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো মধ্যবয়স্ক একটা লোক। আরিয়া দেখে চিনতে পেরে গেছে ইনিই ওর ইন্টারভিউ নিয়েছেন, অখিলেশবাবু।
"আরেহ আরিয়া দাঁড়িয়ে আছো কেন! সব কিছু অ্যারেঞ্জ করা হয়ে গেছে তোমাদের ! ভালো ভাবে ওয়েলকাম করেছো তোমরা স্যারের ?! ইনিই আমাদের ক্যাফের বর্তমান ওনার মিঃ দেবর্ষি সিংহ রায়।" সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে অখিলেশবাবু দেবর্ষিকে নিয়ে ভিতরে গেলো।
আরিয়া তখনও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ।বিরবিড়িয়ে বলে উঠলো "ওনার !"
দেবর্ষি যাওয়ার আগে একবার আরিয়ার দিকে তাকিয়ে একপেশে একটা হাসি হেসে দিল। ডান হাতের আঙ্গুল দুটো নিজের চোখে দেখিয়ে আবার আরিয়ার দিকে ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিলো "নজরে থাকবে!"
.
.
.
.
চলবে.....