১
বিয়েবাড়ির সাজসজ্জা, আলো, আর মানুষের কোলাহলে মুখরিত ছিল গোটা বাড়িটা। উর্মীমালা একটু চুপচাপ, আত্মস্থ মেয়েই বলা চলে। সে আজ তার মামার মেয়ের বিয়েতে এসেছে। ঝলমলে শাড়ি পরে, কপালে ছোট্ট টিপ, চোখে হালকা কাজল—সব মিলিয়ে যেন এক নিঃশব্দ সৌন্দর্য।
এদিকে সুপ্তদীপ, সদ্য চাকরি পেয়েছে কলকাতার এক নামকরা কোম্পানিতে। মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে এসেছে সে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প, হাসি—সবই চলছে। হঠাৎই তার চোখ পড়ল উর্মীমালার দিকে। মেয়েটির চোখে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ, এক গভীরতা। সে চুপচাপ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
উর্মীমালা টের পেল, কেউ তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে দেখল সুপ্তদীপকে। চোখাচোখি হতেই দুজনেই একটু লজ্জা পেল। দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই যেন এক অদৃশ্য সেতু গড়ে উঠল তাদের মধ্যে।
২
বিয়ের অনুষ্ঠানে নানা কাজকর্ম চলছিল। সুপ্তদীপ আর উর্মীমালার মধ্যে প্রথম কথা হয় পানীয়ের টেবিলের পাশে। সুপ্তদীপ বলল,
— "আপনি কি একটু জল দেবেন? আমার হাতটা একটু ব্যস্ত ছিল।"
উর্মীমালা হেসে জল এগিয়ে দিল।
— "নিন।"
— "ধন্যবাদ। আপনার নামটা জানতে পারি?"
— "উর্মীমালা। আর আপনি?"
— "আমি সুপ্তদীপ।"
এরপর কিছু ছোটখাটো কথা—কোথায় থাকেন, কী করেন, পড়াশোনা শেষ হয়েছে কিনা—এসব নিয়েই। কেউই কিছু বাড়তি বলে না। অথচ, দুজনের মধ্যেই যেন এক অদ্ভুত টান অনুভূত হয়। তারা বুঝতে পারে, এই অল্প কথার মধ্যেই অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে।
৩
বিয়ের পরের দিন, বাড়ির ছাদে সন্ধ্যায় হালকা হাওয়া বইছে। সুপ্তদীপ ছাদে উঠে আসে। দেখে, উর্মীমালা একা দাঁড়িয়ে আছে।
— "একা একা কী ভাবছেন?"
উর্মীমালা একটু চমকে ওঠে।
— "কিছু না, এমনিই।"
সুপ্তদীপ পাশে এসে দাঁড়ায়।
— "এই শহরটা আমার খুব ভালো লাগে। তবে, এবার চাকরির জন্য অন্য শহরে চলে যেতে হবে।"
উর্মীমালা চুপ করে থাকে। তার চোখে একটু বিষণ্ণতা।
— "কোথায় যাচ্ছেন?"
— "বেঙ্গালুরু। আগামী সপ্তাহেই।"
এই কথার পর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। যেন কিছু বলার ছিল, কিন্তু কেউই বলতে পারছে না। হঠাৎ বিয়ের বাড়ির ছোট্ট মেয়ে এসে ডাক দেয়,
— "দাদা, দিদি, নিচে চলুন, সবাই খেতে বসেছে।"
৪
বিয়েবাড়ি শেষ। সবাই বাড়ি ফিরছে। সুপ্তদীপেরও ফেরার পালা। বিদায়ের সময় উর্মীমালা আর সুপ্তদীপের চোখে চোখ পড়ে। কেউ কিছু বলে না, শুধু একটানা তাকিয়ে থাকে। যেন হাজার কথা জমে আছে, অথচ ঠোঁটের আগায় এসে আটকে যাচ্ছে।
উর্মীমালা বাড়ি ফিরে আসে। মনটা কেমন খালি খালি লাগে। সে বুঝতে পারে, সুপ্তদীপের জন্য তার মনে কিছু একটা জন্মেছে। কিন্তু সে কিছুই বলেনি। সুপ্তদীপও কিছু বলেনি। হয়তো আর দেখা হবে না—এই ভেবে মনটা আরও ভারী হয়ে ওঠে।
৫
এরপর কেটে যায় কয়েকটা দিন। উর্মীমালা চেষ্টা করে মন থেকে সুপ্তদীপকে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু বারবার তার মুখ, তার হাসি, তার কথাগুলো মনে পড়ে যায়। একদিন সে সাহস করে সুপ্তদীপকে একটা মেসেজ করে—
— "ভালো আছেন তো?"
সুপ্তদীপ উত্তর দেয়—
— "ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?"
এরপর দু-একটা সাধারণ কথাবার্তা। কেউই কিছু স্পষ্টভাবে বলে না। কিন্তু প্রতিটা কথার মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকে না বলা ভালোবাসা।
৬
হঠাৎ একদিন উর্মীমালার বাবা-মা তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। তারা বলে,
— "তোর জন্য একটা ভালো ছেলে দেখেছি। চাকরি করে, ভালো পরিবার।"
উর্মীমালা চুপ করে থাকে। সে জানে, তার মনের ভেতর অন্য কেউ জায়গা করে নিয়েছে। সে নিজের মনকে শক্ত করে, মাকে সব খুলে বলে—
— "মা, আমি সুপ্তদীপকে পছন্দ করি।"
মা একটু অবাক হয়, তবে মেয়ের চোখে সত্যতা দেখে। বাবা-মা দুজনেই প্রথমে একটু চিন্তিত হয়, কারণ তারা জানে না ছেলেটির পরিবার কেমন, ছেলেটি কী ভাবে। কিন্তু উর্মীমালার দৃঢ়তা দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, সুপ্তদীপের পরিবারে কথা বলবে।
৭
এদিকে সুপ্তদীপও বাড়িতে জানায়,
— "আমি উর্মীমালাকে পছন্দ করি।"
তার বাড়ির লোকজনও প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু পরে রাজি হয়ে যায়।
৮
সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, ঠিক সেই সময়ে ছোট্ট একটা টুইস্ট—উর্মীমালার আত্মীয়দের মধ্যে একজন হঠাৎ বলে,
— "ওদের তো বিয়েবাড়িতে খুব বেশি কথা হয়নি, ওরা একে অপরকে চেনে তো ঠিকঠাক?"
উর্মীমালার বাবা একটু চিন্তায় পড়ে যায়। তখন উর্মীমালা বলে,
— "বাবা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য হাজারটা কথা বলার দরকার হয় না। কিছু অনুভূতি চোখে চোখে, চুপচাপ থেকেও বোঝা যায়।"
বাবা মেয়ের মনের জোর দেখে মুগ্ধ হয়। তিনি আর কোনো বাধা দেন না।
৯
সবশেষে বিয়ের দিন ঠিক হয়। সুপ্তদীপ বেঙ্গালুরু থেকে এসে বিয়েতে হাজির হয়। বিয়ের মঞ্চে দুজন মুখোমুখি বসে থাকে। কেউই এখনো বলেনি—"আমি তোমাকে ভালোবাসি"। কিন্তু চোখে চোখে, হাসিতে, স্পর্শে—সবকিছুতেই যেন ভালোবাসার ছোঁয়া।
বিয়ের পর, সবাই চলে গেলে, সুপ্তদীপ ধীরে ধীরে উর্মীমালার কানে ফিসফিসিয়ে বলে—
— "তুমি জানো, আমি তোমাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।"
উর্মীমালা মুচকি হেসে বলে—
— "আমি-ও।"
১০
তাদের ভালোবাসা ছিল নিঃশব্দ, গভীর, আর অমলিন। তারা জানত, ভালোবাসা শুধু মুখে বলার জন্য নয়—অনুভব করার জন্য। আর সেই অনুভবেই তারা খুঁজে পেয়েছিল জীবনের আসল সুখ।