Story of Mahabharat Part 99 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 99

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 99

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৯

কুন্তী এবং কর্ণের মধ্যে কথপোকথনের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কুন্তী এবং কর্ণের মধ্যে কথপোকথনের কাহিনি

কুন্তীর কাছ থেকে বিদায় নিযে কৃষ্ণ চলে যাওয়ার পর বিদুর কুন্তীকে বললেন, আপনি জানেন, যুদ্ধ নিবারণের জন্য আমি সর্বদা চেষ্টা করেছি, কিন্তু দুর্যোধন আমার কথা শোনেনি। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে অধর্মের পথে চলেছেন। কৃষ্ণ অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেলেন, এখন পাণ্ডবগণ যুদ্ধের উদ্যোগ করবেন। কৌরবদের দুর্নীতির ফলে বীরগণের বিনাশ হবে, এই চিন্তায় আমি ঘুমাতে পারছি না।

কুন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, যুদ্ধ হলেও দোষ, না হলেও দোষ। দুর্যোধনাদির পক্ষে ভীষ্ম দ্রোণ আর কর্ণ থাকবেন, এজন্যই আমার ভয়। হয়তো দ্রোণ তার শিষ্যের সঙ্গে যুদ্ধ চান না, পিতামহ ভীষ্ম হয়তো পাণ্ডবগণের প্রতি স্নেহশীল হবেন। অবিবেচক দুর্মতি দুর্যোধনের আশ্রয়ে থাকার জন্য তারা পাণ্ডবদের বিদ্বেষ করেন, তার জন্যই আমার ভয়। বিবাহের আগে যাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি সেই কর্ণ কি আমার হিতকর বাক্য শুনবে না?

বিদুরকে এই কথা বলে কুন্তী গঙ্গাতীরে গেলেন। দয়ালু সত্যনিষ্ঠ কর্ণ সেখানে পূর্বমুখ ও ঊর্ধবাহু হয়ে জপ করছিলেন। প্রখর সূর্যের তাপে কুন্তী কর্ণের উত্তরীয় বস্ত্রের পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কর্ণ দুপুরবেলা পর্যন্ত জপ করলেন, তার পর পিছনে ফিরে কুন্তীকে দেখতে পেলেন। তিনি সবিস্ময়ে প্রণাম করে হাত জোড় কোরে কুন্তীকে বললেন, আমি অধিরথ-রাধার পুত্ৰ কৰ্ণ, আদেশ করুন আমাকে কি করতে হবে।

কুন্তী কর্ণকে বললেন, তুমি কৌন্তেয়, রাধার গর্ভজাত নও, অধিরথ তোমার পিতা নন, সূতকুলেও তোমার জন্ম হয়নি। বৎস, রাজা কুন্তিভোজের গৃহে আমার কন্যা অবস্থায় তুমি আমার প্রথম পুত্ররূপে জন্মেছিলে। যিনি জগৎকে আলোকিত করেন সেই সূর্যদেব তোমার পিতা। তুমি কবচকুণ্ডল ধারণ করে দেবশিশুর মতো আমার পিতার গৃহে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলে। পুত্র, তুমি নিজের ভাইদের না চিনে মোহের বশে দুর্যোধনাদির সেবা করেছ, তা উচিত নয়। তুমি তোমার পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজলক্ষ্মী ভোগ করো। কৌরবগণ আজ দেখুক যে কর্ণ তার নিজের ভাইদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। কৃষ্ণ ও বলরামের মতো তোমরা মিলিত হোলে তোমাদের অসাধ্য কি থাকতে পারে? তুমি সর্বগুণসম্পন্ন, আমার পুত্রদের মধ্যে সবার জ্যেষ্ঠ, তুমি কৌন্তেয়, তোমাকে যেন কেউ সূতপুত্র না বলে।

তখন কর্ণ তার পিতা সূর্যের স্নেহবাক্য শুনতে পেলেন - তোমার জননী কুন্তী সত্য বলেছেন, তার কথা শোনো, তোমার মঙ্গল হবে। মাতা ও পিতার অনুরোধেও কর্ণ বিচলিত হলেন না। তিনি কুন্তীকে বললেন, আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই, আপনার অনুরোধও আমি ধর্মসংগত মনে করি না। আপনি আমাকে ত্যাগ করে ঘোর অন্যায় করেছেন, তাতে আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট হয়েছে। জন্মে ক্ষত্রিয় হলেও আপনার জন্য আমি ক্ষত্রিয়োচিত সংস্কার পাইনি, কোনো শত্রু এর চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে না। আপনি আমার প্রতি কোনো দয়া করেননি, আজ কেবল নিজের স্বার্থের জন্যই আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন। কৃষ্ণের সাথে মিলিত অর্জুনকে কে না ভয় করে? এখন যদি আমি পাণ্ডবপক্ষে যাই তবে সকলেই বলবে আমি ভয় পেয়ে এমন করেছি। কেউ জানে না যে আমি পাণ্ডবদের ভাই। এখন যুদ্ধের সময়ে যদি আমি পাণ্ডবপক্ষে যাই তবে ক্ষত্রিয়রা আমাকে কি বলবেন? দুর্যোধন আমার সমস্ত কামনা পূর্ণ করেছেন, আমাকে সম্মানিত করেছেন, এখন আমি কি করে তার বিরুদ্ধে যেতে পারি? যাঁরা আমাকে শ্রদ্ধা করেন, যাঁরা আমার ভরসাতেই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আমি কি করে ছিন্ন করবো? যে সব পাপাত্মা রাজার অনুগ্রহে পুষ্ট হয়ে প্রয়োজনের সময়ে রাজার প্রতি কর্তব্য পালন করে না, সেই কৃতঘ্নদের ইহলোক নেই পরলোকও নেই। আমি সততার সঙ্গে পুরুষোচিত হয়ে কোনো নৃশংসতা না কোরে ও চরিত্র রক্ষা কোরে আপনার পুত্রদের সঙ্গে যথাশক্তি যুদ্ধ করবো, আপনার কথা হিতকর হলেও তা পালন করতে পারি না। কিন্তু আপনার আগমন ব্যর্থ হবে না, আমি যদি সমর্থ হই তবুও আমি আপনার সকল পুত্রকে বধ করবো না। কেবল অর্জুনকে নিহত করবো অথবা তার হাতে নিহত হয়ে যশোলাভ করবো। যুদ্ধে যারই মৃত্যু হোক না কেন, অর্জুন অথবা আমাকে নিয়ে আপনার পাঁচ পুত্রই থাকবে।

শোকে কাতর কুন্তী কম্পিতদেহে পুত্রকে আলিঙ্গন করে বললেন, কর্ণ, তুমি যা বললে তাই হবে, কুরুকুলের ক্ষয় হবে, দৈবই প্রবল। অর্জুন ভিন্ন অন্য চার ভ্রাতাকে তুমি অভয় দিয়েছ এই প্রতিজ্ঞা মনে রেখো। মা কুন্তী কর্ণকে আশীর্বাদ করলেন, কর্ণও তাকে প্রণাম করলেন, তারপর দুজনে দুʼদিকে চলে গেলেন।

 ______________

(ক্রমশ)