মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬৩
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত রাজা ধুন্ধুমারের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত রাজা ধুন্ধুমারের কাহিনি
মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র কাছে পাণ্ডবগণ ক্ষত্রিয়মাহাত্ম্যের বিভিন্ন কাহিনি শোনার পরে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা কুবলাশ্ব কি কারণে ধুন্ধুমার নাম পেয়েছিলেন? মার্কণ্ডেয় বললেন, উতঙ্ক নামে খ্যাত এক মহর্ষি ছিলেন, তিনি মরুভূমির নিকটে এক মনোরম প্রদেশে বাস করতেন। তাঁর কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাকে বর দিতে চাইলে তিনি বললেন, জগতের প্রভু বিষ্ণুকে দেখলাম, এই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ বর। বিষ্ণু তথাপি অনুরোধ করলে উতঙ্ক বললেন, আমার যেন ধর্মে, সত্যে ও ইন্দ্রিয়সংযমে মতি থাকে এবং আপনার সঙ্গ লাভ হয়। বিষ্ণু বললেন, এ সমস্তই তোমার হবে, তা ছাড়াও তুমি যোগসিদ্ধ হয়ে মহৎ কাজ করবে। তোমার যোগবলের সহায়তায় রাজা কুবলাশ্ব ধুন্ধু নামক মহাসুরকে বধ করবেন।
ইক্ষ্বাকুর পর যথাক্রমে শশাদ, কুকুৎস্য, অনেশ, পৃথু, বিগশ্ব, অদ্রি, যুবনাশ্ব, মান্ধাতা, শ্রাবন্তক (যিনি শ্রাবন্তী নগরী নির্মাণ করেছিলেন) ও বৃহদশ্ব অযোধ্যার রাজা হন। রাজা বৃহদশ্বের পুত্র কুবলাশ্ব। বৃহদশ্ব বনে যেতে চাইলে মহর্যি উতঙ্ক তাকে বারণ করে বললেন, আপনি রাজ্যরক্ষা ও প্রজাপালন করুন, তার তুল্য ধর্মকার্য অরণ্যে হতে পারে না। আমার আশ্রমের নিকটে মরুপ্রদেশে উজ্জ্বালক নামে এক বালুময় সমুদ্র আছে, সেখানে মধু-কৈটভের পুত্র ধুন্ধু নামে এক মহাবল দানব ভূমির ভিতরে বাস করে। আপনি তাকে বধ করে অক্ষয় কীর্তি লাভ করুন, তার পর বনে যাবেন। বালুর মধ্যে নিদ্রিত এই দানব যখন বছর শেষে নিঃশ্বাস ফেলে তখন সপ্তাহকাল ভূমিকম্প হয়, সূর্য পর্যন্ত ধূলির ঝড় ওঠে, ভয়ঙ্কর আগুন, আগুনের ফুলকি ও ধোঁয়া নির্গত হয়। রাজর্ষি বৃহদশ্ব হাত জোড় কোরে বললেন, আমার পুত্র কুবলাশ্ব তার বীর পুত্রদের সঙ্গে আপনার প্রিয়কার্য করবে, আমাকে বনে যেতে দিন। উতঙ্ক তথাস্তু বলে তপোবনে চলে গেলেন।
প্রলয়কালে ক্ষীরোদসমুদ্রে বিষ্ণু যখন অনন্ত নাগের দেহের উপর যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন, তখন তার নাভি থেকে উৎপন্ন পদ্মে ব্রহ্মা আবির্ভূত হয়েছিলেন। মধু ও কৈটভ নামে দুই দানব ব্রহ্মাকে আক্রমণ করলে ব্রহ্মা স্তব কোরে বিষ্ণুকে জাগিয়ে তুললেন। বিষ্ণু তখন দুই দানবকে আহ্বান করলে, তারা বিষ্ণুকে বললো, তুমি আমাদের নিকট বর চাও। বিষ্ণু বললেন, লোকহিতের জন্য আমি চাই তোমরা আমার বধ্য হও। মধু ও কৈটভ বললো, আমরা কখনও মিথ্যা বলি না, রূপ, শৌর্য, ধর্ম, তপস্যা, দান, সদাচার প্রভৃতিতে আমাদের তুল্য কেউ নেই। তুমি আচ্ছাদিত নয় এমন কোনো স্থানে আমাদের বধ করো এবং এই বর দাও যেন আমরা তোমার পুত্র হই। বিষ্ণু বললেন, তাই হবে। পৃথিবী ও স্বর্গে কোথাও অনাচ্ছাদিত স্থান না দেখে বিষ্ণু তার উন্মুক্ত উরুর উপরে মধু ও কৈটভের মস্তক রেখে সুদর্শন চক্রে কেটে ফেললেন।
মধু ও কৈটভের পুত্র ধুন্ধু তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে দেব, দানব, যক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ ও রাক্ষসের অবধ্য হয়েছিল। সে বালুর মধ্যে লুকিয়ে থেকে উতঙ্কের আশ্রমে উপদ্রব করতো। উতঙ্কের অনুরোধে বিষ্ণু রাজা কুবলাশ্বের দেহে প্রবেশ করলেন। কুবলাশ্ব তার একুশ হাজার পুত্র ও সৈন্য নিয়ে ধুন্ধুকে বধের জন্য যাত্রা করলেন। সপ্তাহকাল বালুময় সমুদ্রের সমস্ত দিক খনন করার পর নিদ্রিত ধুন্ধুকে দেখা গেল। সে ঘুম থেকে উঠে তার মুখ থেকে নিৰ্গত আগুন দিয়ে কুবলাশ্বের পুত্রদের পুড়িয়ে ফেললো। কুবলাশ্ব যোগশক্তির প্রভাবে ধুন্ধুর মুখ থেকে নির্গত আগুন নিভিয়ে ফেললেন এবং ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে তাকে বধ করলেন। তার পর থেকে তিনি ধুন্ধুমার নামে খ্যাত হলেন।
______________
(ক্রমশ)