Story of Mahabharat Part 46 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 45

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 45

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪৬

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত ঋষ্যশৃঙ্গের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত ঋষ্যশৃঙ্গের কাহিনি

লোমশ মুনি বর্ণিত ভগীরথ কর্তৃক মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের কাহিনি শোনার পর পাণ্ডবগণ নন্দা ও অপরনন্দা নদী এবং ঋষভকূট পর্বত পার হোয়ে কৌশিকী নদীর তীরে এলেন। লোমশ মুনি পাণ্ডবদেরকে বললেন, ওই যে বিশ্বামিত্রের আশ্রম দেখা যাচ্ছে, কশ্যপ গোত্রের মহাত্মা বিভাণ্ডক মুনির আশ্রমও এইখানে ছিল। তাঁর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের তপস্যার প্রভাবে ‘ইন্দ্র অনাবৃষ্টির কালেও জলবর্ষণ করেছিলেন। তাঁর আখ্যান বলছি শোন -

একদিন বিভান্ডক মুনি দীর্ঘকাল তপস্যায় শ্রান্ত হয়ে স্নান করছিলেন, এমন সময় উর্বশী অপ্সরাকে দেখে তিনি কামার্ত হওয়ায় তার শুক্রপাত হয়ে গেলো। সেই সময় এক তৃষিতা হরিণী বিভান্ডক মুনির স্নানের পর সেই জায়গা থেকে জলপান করলে সঙ্গে বিভান্ডকের শুক্র পান করে গর্ভবতী হোলো এবং যথাকালে একটি মানবশিশু প্রসব করলো। এই মানবশিশুর মাথায় হরিণের মতো একটি শৃঙ্গ ছিল, তিনি সর্বদা ব্রহ্মচর্যে নিরত থাকতেন এবং পিতা বিভাণ্ডক ভিন্ন অন্য কোনো মানুষও দেখেন নি। এই সময়ে অঙ্গদেশে লোমপাদ নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি দশরথের বন্ধু ছিলেন। রাজা লোমপাদ ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতের প্রতি অসদাচরণ করেছিলেন সেজন্য ব্রাহ্মণগণ তাকে ত্যাগ করেন এবং ইন্দ্রও তার রাজ্যে বৃষ্টিপাত বন্ধ কোরে দেন, তার ফলে প্রজারা কষ্টে পড়ে। একজন মুনি রাজাকে বললেন, আপনি প্রায়শ্চিত্ত করে ব্রাহ্মণদের ক্রোধ শান্ত করুন এবং মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে আনান, তিনি আপনার রাজ্যে এলে তখন বৃষ্টিপাত হবে।

রাজা লোমপাদ প্রায়শ্চিত্ত করে ব্রাহ্মণদের প্রসন্ন করলেন এবং ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে আসার জন্য শাস্ত্রজ্ঞ মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তিনি প্রধান প্রধান বেশ্যাদের ডেকে এনে বললেন, তোমরা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে প্রলোভিত করে আমার রাজ্যে নিয়ে এসো। বেশ্যারা ভয় পেয়ে জানালো যে তা অসাধ্য। তখন এক বয়স্কা বেশ্যা বললো, মহারাজ, আমি সেই মুনিকে নিয়ে আসবো, কিন্তু আমার যা যা আবশ্যক তা আমাকে দিন। রাজার নিকট সমস্ত প্রয়োজনীয় বস্তু ও ধনরত্নাদি পেয়ে সেই বয়স্কা বেশ্যা একটি নৌকায় কৃত্রিম গাছ, লতা, ফুল ও ফল দিয়ে সাজিয়ে মনোরম আশ্রম নির্মাণ করলো এবং কয়েকজন রূপযৌবনবতী রমণীকে সঙ্গে নিয়ে বিভাণ্ডকের আশ্রমের কাছে এসে নৌকা বাঁধলো।

বিভাণ্ডক মুনি তার আশ্রমে নেই জেনে নিয়ে সেই বয়স্কা বেশ্যা তার বুদ্ধিমতী কন্যাকে কিছু উপদেশ দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে পাঠিয়ে দিলো। বেশ্যাকন্যা ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে বললে, আপনারা এই আশ্রমে সুখে আছেন তো? ফলমূলের অভাব নেই তো? আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আপনার আশ্রম কোথায়? আপনি কি দেবতার আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য কোনো ব্রত পালন করছেন?

বেশ্যাকন্যা বললে, এই বিশাল পর্বতের অপর দিকে আমার রমণীয় আশ্রম আছে। আমার ধর্ম এই, যে আমি অভিবাদন বা জল গ্রহণ করতে পারি না। আপনি আমাকে অভিবাদন করবেন না, আমার ব্রত অনুসারে আমি আপনাকে অভিবাদন ও আলিঙ্গন করবো। বেশ্যাকন্যা ঋষ্যশৃঙ্গকে মহামূল্য সুন্দর সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য, সুগন্ধ মালা, উজ্জ্বল বস্ত্র এবং উত্তম পানীয় দিয়ে তার সঙ্গে নানা প্রকার খেলা ও হাস্যপরিহাসে রত হল। তারপর সে আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি কোরে ঋষ্যশৃঙ্গকে বার বার আলিঙ্গন করলো। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে এইরূপে প্রলোভিত কোরে এবং তাকে মোহগ্রস্ত দেখে সে ধীরে ধীরে চলে গেলো।

ঋষ্যশৃঙ্গ কামার্ত হয়ে অচেতনের মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ক্ষণকাল পরে বিভান্ডক মুনি আশ্রমে ফিরে এলেন। পুত্রের এইরূপ চেহারার দেখে তিনি বললেন, তুমি চিন্তামগ্ন, অচেতন ও কাতর হয়ে আছ কেন? কে এখানে এসেছিল? ঋষ্যশৃঙ্গ উত্তর দিলেন, একজন জটাধারী ব্রহ্মচারী এসেছিলেন, তার গাত্রবর্ণ সোনার মতো উজ্জ্বল, তিনি দেবপুত্রের মতো সুন্দর। তার জটা সুদীর্ঘ, নির্মল কৃষ্ণবর্ণ, সুগন্ধ এবং সোনার সুতো দিয়ে গাঁথা। তাঁর গলায় বহুমূল্য রত্নমালা, তার নীচে দুটি রোমহীন অতি মনোহর মাংসপিণ্ড আছে। তাঁর কোমর পিপীলিকার কোমরের মতো ক্ষীণ। আমার এই জপমালার মতো তার পায়ে ও হাতে আশ্চর্য মালা আছে, যা থেকে সুন্দর ধ্বনি শোনা যায়। তার পরিধেয় অতি মনোহর। তার মুখ সুন্দর, কণ্ঠস্বর কোকিলের তুল্য, তার কথা শুনলে আনন্দ হয়। সেই দেবপুত্রের উপর আমার অত্যন্ত অনুরাগ হয়েছে, তিনি আমাকে আলিঙ্গন করে আমার জটা ধরে মুখে ঠেকিয়ে একপ্রকার শব্দ করলেন, তাতে আমার অত্যন্ত আনন্দ হোলো। তিনি যেসব ফল আমাকে খেতে দিয়েছিলেন, আমাদের আশ্রমের ফল তেমন নয়। তার দেওয়া জল উত্তম ও সুস্বাদু। এইসকল বিচিত্র সুগন্ধ মালা তিনি ফেলে গেছেন, তার চলে যাওয়ায় আমি অত্যন্ত অসুখী হয়েছি। পিতা, আমি তার কাছে যেতে চাই। আমি তার সঙ্গেই তপস্যা করবো।

বিভান্ডক বললেন, ওরা রাক্ষস, অদ্ভুত রূপ ধারণ করে তপস্যার বিঘ্ন ঘটায়, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও তপস্বীদের উচিত নয়। পুত্র, অসৎ লোকেই সুরাপান করে, মুনিদের তা পান করা অনুচিত, আর এই সকল মালাও আমাদের ব্যবহার করা উচিৎ নয়।

ওরা রাক্ষস, এই বলে পুত্রকে নিবারণ কোরে বিভাণ্ডক মুনি সেই বেশ্যাকে খুঁজতে গেলেন, কিন্তু তিন দিনেও তাকে খুঁজে না পেয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। তারপর যখন তিনি ফল আহরণ করতে গেলেন তখন বেশ্যাকন্যা আবার আশ্রমে এলো। ঋষ্যশৃঙ্গ অত্যন্ত খুশি ও ব্যস্ত হয়ে তাকে বললেন, আমার পিতা ফিরে আসবার আগেই আমরা আপনার আশ্রমে যাই চলুন। বেশ্যা তাকে নৌকায় নিয়ে গেলো এবং নানা উপায়ে তাকে প্রলোভিত করে অঙ্গদেশের অভিমুখে যাত্রা করলো। নৌকা যেখানে উপস্থিত হোলো, তার কাছেই রাজা লোমপাদ এক সুন্দর মনোরম আশ্রম নির্মাণ করলেন। রাজা ঋষ্যশৃঙ্গকে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেবরাজ প্রচুর বৃষ্টিপাত করলেন। লোমপাদের কামনা পূর্ণ হোলে, তিনি তাঁর কন্যা শান্তাকে ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে বিবাহ দিলেন।

বিভান্ডক আশ্রমে ফিরে এসে পুত্রকে দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। লোমপাদের আদেশে তার পুত্রকে অঙ্গরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এইরূপ অনুমান করে তিনি অঙ্গরাজধানী চম্পার অভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে তিনি এক গোপপল্লীতে এলে গোপগণ তাকে যথোচিত আপ্যায়ণ করলে, বিভাণ্ডক সেখানে রাজার মতো সুখে রাত্রিবাস করলেন। তিনি তুষ্ট হয়ে প্রশ্ন করলেন, গোপগণ, তোমরা কার প্রজা? লোমপাদের শিক্ষা অনুসারে তারা উত্তর দিলো, মহর্ষি, এইসব পশু ও কৃষিক্ষেত্র আপনার পুত্রের অধিকারভুক্ত। এইরূপে সম্মান পেয়ে এবং মিষ্ট বাক্য শুনে বিভাণ্ডকের ক্রোধ দূর হোলো এবং তিনি রাজধানীতে এসে লোমপাদ কর্তৃক সম্মানিত হয়ে এবং পুত্র-পুত্রবধূকে দেখে তুষ্ট হলেন। বিভাণ্ডকের অনুমতিতে ঋষ্যশৃঙ্গ কিছুকাল অঙ্গরাজ্যে রইলেন এবং এক পুত্রের জন্মের পর আবার পিতার আশ্রমে ফিরে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)