Storey of Mahabharat Part 32 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 32

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 32

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩২

পাণ্ডবগণের দিগ্বিজয় ও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

পাণ্ডবগণের দিগ্বিজয় ও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন

ভীম কর্তৃক জরাসন্ধ বধের কিছুদিন পরে ভাইদের সঙ্গে আলোচনা কোরে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করবেন বলে স্থির করলেন। আলোচনা করার সময় অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, ধনু, অস্ত্র, সহায়, যশ সবই আমরা পেয়েছি, এখন রাজকোষে ধনবৃদ্ধি করা উচিৎ বলে মনে করি। অতএব, আমরা সকল রাজার কাছ থেকে কর আদায় করবো। যুধিষ্ঠির সম্মতি দিলে অর্জুন, ভীম, সহদেব, নকুল বিভিন্ন দিকে দিগ্বিজয়ে যাত্রা করলেন। যুধিষ্ঠির আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে রইলেন।

অর্জুন উত্তর দিকে গিয়ে কুলিন্দ, আনৰ্ত, শালদ্বীপ প্রভৃতি জয় করে প্ৰাগজ্যোতিষপুরে গেলেন। সেখানকার রাজা ভগদত্ত তার কিরাত, চীন, এবং সাগরতীরবাসী অন্যান্য সৈন্য নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধ করলেন। আট দিন পরেও অর্জুনকে অক্লান্ত দেখে ভগদত্ত সহাস্যে বললেন, অর্জুন, তোমার শক্তি ইন্দ্রপুত্রেরই উপযুক্ত। আমি ইন্দ্রের সখা, তথাপি যুদ্ধে তোমার সঙ্গে পারছি না। পুত্র, তুমি কি চাও বল। অর্জুন বললেন, ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির সম্রাট হোতে ইচ্ছা করেন, আপনি প্রীতিপূর্বক তাকে কর দিন। ভগদত্ত সম্মত হোলে অর্জুন কুবের শাসিত উত্তর পর্বতের রাজ্যসমূহ, কাশ্মীর, লোহিত দেশ, ত্রিগর্ত, সিংহপুর, সুহ্ম, চোল, বাহ্বীক, কম্বোজ, দরদ প্রভৃতি দেশ জয় করলেন। তারপর তিনি শ্বেতপর্বত অতিক্রম করে কিশুরুষ, হাটক ও গন্ধর্ব দেশ জয় করে হরিবর্ষে এলেন। সেখানকার বিশালদেহী মহা শক্তিশালী দ্বারপালরা মিষ্টবাক্যে বললো, অর্জুন, ফিরে যাও, এখানে প্রবেশ করলে কেউ জীবিত থাকে না। এই উত্তরকুরু দেশে যুদ্ধ হয় না, মানবদেহধারী এখানে এলে কিছুই দেখতে পায় না। যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কিছু চাও তো বলো। অর্জুন সহাস্যে বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সম্রাট হবেন এই আমার ইচ্ছা। যদি এই দেশ মানুষের অগম্য হয় তবে আমি যেতে চাই না, তোমরা কিঞ্চিৎ কর দাও। দ্বারপালরা অর্জুনকে দিব্য বস্ত্র, আভরণ, মৃগচর্ম প্রভৃতি কর স্বরূপ দিলে দিগ্বিজয় শেষ করে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে এলেন।

ভীম বিশাল সৈন্যদল নিয়ে পূর্বদিকে গিয়েছিলেন। তিনি পাঞ্চাল, গণ্ডক, বিদেহ, দশর্ণ, পুলিন্দনগর প্রভৃতি জয় করে চেদি দেশে উপস্থিত হলেন। চেদিরাজ শিশুপাল ভীমের কাছে এসে কুশলপ্রশ্ন করে সহাস্যে বললেন, ব্যাপার কি? ভীম ধর্মরাজের ইচ্ছা জানালে শিশুপাল তখনই কর দিলেন। তের দিন শিশুপালের আতিথ্য উপভোগ করে ভীম কুমার দেশের রাজা শ্রেণীমান ও কোশলপতি বৃহদ্বলকে পরাজিত করলেন। তার পর অযোধ্যা, গোপালকচ্ছ, উত্তর সোমক, মল্ল, মৎস্য, বৎস, প্রভৃতি দেশ জয় করে গিরিব্রজপুরে গেলেন এবং জরাসন্ধপুত্র সহদেবের নিকট কর নিয়ে তার সঙ্গে কর্ণের রাজ্যে উপস্থিত হলেন। কর্ণ বশ্যতা স্বীকার করলেন। তার পর পুণ্ড্রদেশের রাজা মহাবল বাসুদেব এবং কৌশিকী নদীর তীরবাসী রাজাকে পরাস্ত করে বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কট, সুহ্ম, এবং ব্রহ্মপুত্র নদ ও পূর্বসাগরের তীরবর্তী ম্লেচ্ছ দেশ জয় করে বহু ধনরত্ন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।

সহদেব দক্ষিণ দিকে শূরসেন ও মৎস্য দেশের রাজা, কুন্তিভোজ, অবন্তি ও ভোজকট দেশের রাজা ভীষ্মক ও পাণ্ড্যরাজ প্রভৃতিকে পরাস্ত করে কিষ্কিন্ধ্যায় গেলেন এবং বানররাজ মৈন্দ ও দ্বিবিদকে পরাজিত করলেন। তার পর তিনি মাহিষ্মতী পুরীতে গেলেন। সেখানকার রাজা নীলকে স্বয়ং অগ্নিদেব সাহায্য করতেন সেজন্য যুদ্ধে সহদেবের প্রচুর সৈন্যক্ষয় এবং প্রাণসংশয় হল। মাহিষ্মতী-বাসীরা অগ্নিকে পারদারিক বলত। একদিন ব্রাহ্মণের বেশে অগ্নি নীল রাজার সুন্দরী কন্যার সহিত বিহার করছিলেন, রাজা তা জানতে পেরে অগ্নিকে শাসন করলেন। অগ্নির তেজে রাজভবন জ্বলে উঠলে রাজা অগ্নিকে প্রসন্ন করে কন্যাদান করলেন। সেই অবধি অগ্নিদেব রাজার সহায় হলেন। অগ্নির বরে মাহিষ্মতীর নারীরা স্বৈরিণী ছিল, তাদের বারণ করা যেত না। সহদেব বহু স্তুতি করলে অগ্নি তুষ্ট হলেন, তখন অগ্নির আদেশে নীল রাজা সহদেবকে কর দিলেন। সহদেব ত্রিপুর, পৌরব, সুরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ জয় করে ভোজকট নগরে গিয়ে কৃষ্ণের শ্বশুর ভীষ্মক রাজার নিকট কর আদায় করলেন। তার পর তিনি কর্ণপ্রাবরক, কালমুখ নামক নররাক্ষসগণ প্রভৃতিকে জয় করে এবং দূত পাঠিয়ে পাণ্ড্য, দ্রাবিড়, উড্র, কেরল, অন্ধ্র, কলিঙ্গ প্রভৃতি দেশ থেকে কর আদায় করলেন। লঙ্কার রাজা বিভীষণও বশ্যতা স্বীকার করে বিবিধ রত্ন ও মহার্ঘ বস্ত্র উপহার পাঠালেন। এইরূপে সকল রাজার থেকে কর আদায় করে সহদেব ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এসে ধর্মরাজকে সমস্ত ধন নিবেদন করলেন।

নকুল পশ্চিম দিকে গিয়ে শৈরীষক, মহোথ, মালব, পঞ্চনদ প্রদেশ, দ্বারপালপুর প্রভৃতি জয় করলেন। তিনি দূত পাঠালে যাদবগণসহ কৃষ্ণ বশ্যতা স্বীকার করলেন। তার পর নকুল মদ্ররাজপুর গিয়ে মামা শল্যের নিকট থেকে প্রচুর ধনরত্ন আদায় করলেন এবং সাগরতীরবর্তী ম্লেচ্ছ পহুব ও বর্বরগণকে জয় করে প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।

রাজা যুধিষ্ঠির ধনাগারে ও শস্যাগারে সঞ্চিত ধন ও শস্যের পরিমাণ জেনে রাজসূয় যজ্ঞে উদ্যোগী হলেন। সেই সময়ে কৃষ্ণ ইন্দ্রপ্রস্থে আসায় যুধিষ্ঠির তাকে সংবর্ধনা করে বললেন, কৃষ্ণ তোমার কৃপায় এই পৃথিবী আমার বশে এসেছে এবং আমি বহু ধনের অধিকারী হয়েছি। এখন আমি তোমার ও ভাইদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যজ্ঞ করতে ইচ্ছা করি, তুমি অনুমতি দাও। কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনিই সম্রাট হবার যোগ্য, অতএব নিজেই এই মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন, তাতেই আমরা কৃতার্থ হব। যজ্ঞের জন্য আপনি আমাকে যে কাজে নিযুক্ত করবেন আমি তাই করবো।

যুধিষ্ঠির তার ভাইদের সঙ্গে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলেন। ব্যাসদেব ঋত্বিকদের নিয়ে এলেন। সুসাম্য উদ্গাতা হলেন, যাজ্ঞবল্ক্য অধ্বর্য হলেন, ধৌম্য ও পৈল হোতা হলেন এবং বেদব্যাস স্বয়ং ঋত্বিক হলেন। শিল্পিগণ বিশাল গৃহসমূহ নির্মাণ করলেন। সহদেব নিমন্ত্রণের জন্য সর্বদিকে দূত পাঠালেন। তার পর যথা সময়ে বিপ্রগণ যুধিষ্ঠিরকে যজ্ঞে দীক্ষিত করলেন। নানা দেশ থেকে আগত ব্রাহ্মণরা তাদের জন্য নির্মিত আবাসে রাজার অতিথি হয়ে রইলেন। তারা বহুপ্রকার কাহিনি বলে এবং নৃত্যগীত উপভোগ করে কালযাপন করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তাদের শতসহস্ৰ গাভী, শয্যা, সোনা ও দাসী দান করলেন।

ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, দুর্যোধনাদি, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, গান্ধার রাজ সুবল ও তার পুত্র শকুনি, কর্ণ, শল্য, সোমদত্ত, ভুরিশ্রবা, জয়দ্ৰথ, সপুত্র দ্রুপদ, শাম্ব, সাগরতীরবাসী ম্লেচ্ছগণের সাথে প্রাগজ্যোতিষরাজ ভগদত্ত, বৃহম্বল রাজা, পৌণ্ড্রক বাসুদেব, বঙ্গ কলিঙ্গ মালব অন্ধ্র দ্রবিড় সিংহল কাশ্মীর প্রভৃতি দেশের রাজা, কুন্তিভোজ, সপুত্র বিরাট রাজা, চেদিরাজ শিশুপাল, বলরাম, অনিরুদ্ধ, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ, সকলেই রাজসূয় যজ্ঞ দেখতে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন এবং তাদের জন্য নির্দিষ্ট গৃহে সুখে বাস করতে লাগলেন।

ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি গুরুজনকে অভিবাদন করে যুধিষ্ঠির বললেন, এই যজ্ঞে আপনারা আমাকে অনুগ্রহ কোরে সহযোগিতা করুন। তার পর তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে এইপ্রকারে কাজ ভাগ কোরে দিলেন - দুঃশাসনকে খাদ্যদ্রব্যের দায়িত্ব, অশ্বত্থামাকে ব্রাহ্মণগণকে সংবর্ধনার দায়িত্ব, সঞ্জয়কে রাজাদের সেবার দায়িত্ব, কোনও কাজ করা হবে কি হবে না তা স্থির করার দায়িত্ব ভীষ্ম ও দ্রোণের, কৃপের ধনরত্ন এবং দক্ষিণা দেওয়ার দায়িত্ব, ধর্মপ্রাণ বিদুরকে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয়ের দায়িত্ব নিলেন, দুর্যোধনকে উপহার দ্রব্য গ্রহণ করার দায়িত্ব এবং উত্তম ফললাভের ইচ্ছায় কৃষ্ণ স্বয়ং ব্রাহ্মণদের চরণ ধোয়ার কাজে নিলেন। যাঁরা যুধিষ্ঠিরের সভায় এসেছিলেন, তাঁদের কেউ সহস্র মুদ্রার কম উপহার আনেন নি। নিমন্ত্রিত রাজারা প্রতিযোগিতা কোরে ধনদান করতে লাগলেন যাতে তাদের প্রদত্ত অর্থেই যজ্ঞের ব্যয় নিৰ্বাহ হয়।

______________

(ক্রমশ)