Some Amazing Stories written in Hindu Shastra in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত কিছু অত্যাশ্চর্ষ সরস কাহিনি

Featured Books
Categories
Share

হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত কিছু অত্যাশ্চর্ষ সরস কাহিনি

 হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত কিছু অত্যাশ্চর্ষ কাহিনি

সনাতনীদের জ্ঞাতার্থে এবং পালনার্থে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত কিছু অত্যাশ্চর্ষ সরস কাহিনির সংক্ষিপ্ত সংকলন

 

পৃথিবীতে অদ্যাবধি যতগুলি ধর্ম প্রবর্তিত হইয়াছে, সেইসকল ধর্মের অনুসারীগণ বিশ্বাস করিয়া থাকেন যে, তাহাদের  ধর্মপুস্তকে বর্ণিত সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্বের স্থাবর-জঙ্গমাদি সকল কিছুই সৃষ্টি করিয়াছেন। মনুষ্য কর্তৃক গৃহীত ও আচরিত বিভিন্ন ধর্মগুলির মধ্যে সনাতন নামক একটি ধর্ম বহুল প্রচলিত। এই ধর্মের আনুসারীগণ মূলতঃ হিন্দু নামে পরিচিত। অধুনা হিন্দুগণের মধ্যে আবার একাংশ নিজেদেরকে সনাতনী বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন।

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হিন্দু কিংবা সনাতনীদের পূর্বজগণের মধ্য হইতে কিছু পণ্ডিত রামায়ণ, মহাভারত্, বেদ, উপনিষদ, পুরাণ নামক বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন যাহা হিন্দুশাস্ত্র নামে প্রচলিত। ওই সকল গ্রন্হাদিতে বিভিন্ন দেবতা, দৈবিক শক্তি ও মহিমা, মুনি-ঋষি এবং তাহাদের তপস্যালব্ধ তেজ ও ক্ষমতা, দানব-যক্ষ-রাক্ষস এবং তাহাদের অপশক্তি, বিভিন্ন কালে মহা তেজস্বী বহু রাজাদের কাহিনি বর্ণিত আছে। হিন্দুশাস্ত্র বর্ণিত আছে যে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারিটি যুগের অন্তে মহাপ্রলয় সংঘটিত হইয়া সমস্ত সৃষ্টি বিনষ্ট হইবে। বর্তমান কালকে কলিযুগ নামে অভিহিত করা হইয়াছে। কলিযুগে বিভিন্ন পণ্ডিত ভূমণ্ডলে প্রচলিত নানান ভাষায় মূল হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত ঘটনাবলীতে স্বীয় স্বীয় কপোলকল্পনাসম্ভূত পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করিয়া নূতন আঙ্গিকে উপস্থাপন করিয়াছেন, যাহার ফলে মূল ও পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত-সংযোজিত-বিয়োজিত হিন্দুশাস্ত্র পঠনে সনাতনীগণ এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী পণ্ডিতবর্গ যত্পরোনাস্তি সংশয়াপন্ন।

হিন্দুশাস্ত্র পঠনে জানিতে পারা যায় যে, বিভিন্ন দেবতা, মুনি-ঋষি, রাজা সত্যনিষ্ঠ, ধার্মিক, সকলের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন, জিতেন্দ্রিয় ইত্যাদি সকল প্রকার গুণে গুণান্বিত ছিলেন। 

বর্তমানকালে সনাতনীগণ হিন্দুশাস্ত্রকে যেরূপ ভক্তিশ্রদ্ধা করিয়া থাকেন তাহাতে হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত বিভিন্ন দেবতা, মুনি-ঋষি, ক্ষত্রিয় রাজাগণ দ্বারা পুরাকালে আচরিত বিভিন্ন কার্যাবলি সনাতনীগণের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হওয়া উচিৎ। হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত দেবতা, মুনি-ঋষি, ক্ষত্রিয় রাজাগণ দ্বারা আচরিত বিভিন্ন কার্যাবলি এবং ভীষ্ম কর্তৃক যুধিষ্ঠিরকে দেওয়া উপদেশাবলী হইতে কিছু কাহিনি নিম্নে উপস্থাপিত হইল –

 

বিভিন্ন জিতেন্দ্রিয় দেবতা এবং মুনি-ঋষিগণের ইন্দ্রিয়াসক্তির কাহিনিঃ

নারায়ণ এবং তুলসীর কাহিনি

দানবগণের রাজা শঙ্খচূড়ের স্ত্রী ছিলেন তুলসী। তুলসী ছিলেন পতিগতপ্রাণা এবং নারায়ণের একনিষ্ঠ ভক্ত। শঙ্খচূড় তপস্যা কোরে বর পেয়েছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী যতদিন সতী থাকিবেন ততদিন তিনি অবধ্য থাকিবেন। যাহার অর্থ শঙ্খচূড়ের স্ত্রীর সতীত্ব যতদিন বজায় থাকিবে, ততদিন তাহাকে কেহই বধ করিতে পারিবে না। বরপ্রাপ্তির ফলে বলীয়ান শঙ্খচূড়ের উৎপীড়নে সকল দেবগণ অতিষ্ঠ হইয়া ব্রহ্মাকে অগ্রবর্তী করিয়া শিবের সন্নিকটে উপস্থিত হইলেন। দেবাদিদেব মহাদেব তখন শঙ্খচূড়ের উৎপীড়নে উদ্ভূত সমস্যা সমাধান করিবার উদ্দেশ্যে নারায়ণের নিকট উপস্থিত হইলেন। সকল বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া নারায়ণ তখন এই সমস্যার সমাধান করিয়া কহিলেন যে, একদিকে ত্রিশূল দ্বারা মহাদেব শঙ্খচূড়ের সহিত যুদ্ধ করিবেন অপরদিকে আমি স্বয়ং শঙ্খচূড়ের স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট করিবো।

নারায়ণের উপদেশে শঙ্খচূড় যে সময় যুদ্ধক্ষেত্রে মহাদেবের সহিত সংগ্রামরত অবস্থায় ছিলেন সেই সময়ে শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করিয়া স্বয়ং নারায়ণ তুলসী দেবীর নিকট উপস্থিত হইলেন। তুলসী দেবী নারায়ণকে তাহার স্বামী শঙ্খচূড় ভাবিয়া ভুল করিলে নারায়ণ তুলসীর সহিত সম্ভোগ করিয়া তাহার সতীত্ব নষ্ট করেন। অপরদিকে স্ত্রী তুলসীর সতীত্ব নষ্ট হইয়া যাওয়ায় মহাদেবের হস্তে শঙ্খচূড় নিহত হইলেন। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পাইয়া তুলসী দেবী বুঝিতে পারেন যে, নারায়ণ তাহার সহিত ছলনা করিয়াছেন। ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় তুলসী দেবী নারায়ণকে অভিশাপ দিলেন যে, নারায়ণ পাষাণে পরিণত হইবেন ও দেবী তুলসী তৎক্ষণাৎ দেহত্যাগ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন। নারায়ণ তুলসী দেবীর এই অভিশাপ হাসিমুখে গ্রহণ করিলেন যার ফলে তুলসীর অভিশাপে নারায়ণ শালগ্রাম শিলায় পরিণত হইয়াছিলেন।

অভিশাপ দেওয়ার পরমুহূর্তে দেবী তুলসী আপনার ভুল বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি নারায়ণকে অভিশাপ দিয়াছেন। তুলসী দেবী কর্তৃক অভিশপ্ত হইবার পর নারায়ণ তখন দেবী তুলসীকে বরদান করিলেন যে, পবিত্র তুলসী বৃক্ষ রূপে তিনি মর্ত্যলোকে পূজিতা হইবেন এবং নারায়ণ শিলার পুজা তুলসীর পত্র ভিন্ন সম্পূর্ণ হইবে না। নারায়ণের বরদানের ফলে দেবী তুলসীর শরীর গণ্ডকী নদীতে পরিণত হইয়াছিল এবং তুলসী দেবীর কেশ হইতে পবিত্র তুলসী বৃক্ষের সৃষ্টি হইল। তদবধি তুলসী দেবী প্রতি ঘরের আঙিনায় বৃক্ষ রূপে অবস্থান করিয়া পুজিতা হইয়া থাকেন।

নারায়ণ এবং বৃন্দা

স্কন্দপুরাণে বর্ণিত আছে যে ভগবান নারায়ণ বৃন্দা নামক এক নারীকে ধর্ষণ করেন। অসুরদের রাজা জলন্ধর ক্রুদ্ধ হইয়া দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিল। জলন্ধরের পরাক্রমে দেবতারা তাহার নিকট পরাভূত হইয়াছিল।

একদা শিবপত্নী পার্বতীর প্রতি মোহিত হইয়া শিবের নিকট হইতে পার্বতীকে লইয়া আসিবার নিমিত্ত জলন্ধর দূত প্রেরণ করিয়াছিল। জলন্ধরের সেই অভিলাষ পূরিত না হইলে জলন্ধর বিশাল সৈন্য লইযা শিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলে যুদ্ধ চলাকালীন মায়ার প্রভাবে শিবকে জলন্ধর বশীভূত করিলে, সকল অস্ত্র শিবের হস্ত হইতে পতিত হওয়ায় জলন্ধর কামার্ত হইয়া, শিবের রূপ ধারণ করিয়া শিবপত্নী গৌরি নিকট উপস্থিত হইলেন। দূর হইতে পার্বতীকে দর্শন মাত্র জলন্ধরের বীর্য স্খলিত হয়। পার্বতীও শিবরূপী জলন্ধরকে চিনিতে পারিয়া সেইস্থান হইতে পলায়ন করেন। জলন্ধরও শিবের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য ফিরিয়া আসেন। এমতাবস্থায়, পার্বতী নারায়ণকে স্মরণ করায় নারায়ণ উপস্থিত হইলে পার্বতী তাহাকে বলেন,  “হে নারায়ণ, দৈত্য জলন্ধর আজ এক অদ্ভুত কর্ম করিয়াছে, তুমি কি সেই দুর্মতি দৈত্যের ব্যবহার বিদিত নহ?” নারায়ণ উত্তর দিলেন, ” হে দেবী, জলন্ধরই পথ দেখাইয়াছে, আমরাও সেই পথের অনুসরণ করিব, ইহা না করিলে জলন্ধরও বধ হইবে না এবং আপনারও পতিব্রাত্য রক্ষিত হইবে না।”

জলন্ধর যখন শিবের সহিত যুদ্ধে রত, তখন নারায়ণ দানবরাজ জলন্ধরের পত্নী বৃন্দার পতিব্রাত্য নষ্ট করিবার অভিলাষে জলন্ধরের রূপ ধারণ করিয়া যেথায় বৃন্দা অবস্থান করিতেছিলেন, সেই পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন।”

সেইসময়ে জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা এক দুঃস্বপ্ন দর্শনে তাহার স্বামীর জন্য চিন্তিত হইয়া পড়েন এবং এক ঋষির দর্শন পান। বৃন্দা সেই ঋষির নিকট জলন্ধরের সংবাদ জানিতে চাহিলে, মুনির আদেশে দুইটি বানর জলন্ধরের মস্তক ও শরীর লইয়া উপস্থিত হইল। তদ্দর্শনে বৃন্দা মূর্ছিত হইয়া ভূপতিত হইলেন। সংজ্ঞা ফিরিলে জলন্ধরের স্ত্রী সেই ঋষির কাছে তার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করিলে ঋষি সেই স্থান হইতে অদৃশ্য হইলে বৃন্দা জীবিত জলন্ধরকে সেই স্থানে দেখিতে পান।

জলন্ধর জীবিত হইয়া বৃন্দাকে আলিঙ্গন করিয়া তাহার গলদেশে চুম্বন করিল”। “অনন্তর বৃন্দাও স্বামীকে জীবিত দেখিতে পাইয়া সেই কাননমধ্যে তাহার সহিত রতিক্রিয়া করিলেন।” একসময় বৃন্দা জলন্ধররূপী নারায়ণকে চিনিতে পারিয়া ক্রোধপরবশ বৃন্দা কহিলেন, “হে নারায়ণ, তুমি পরদারগামি তোমার চরিত্রে ধিক!” নারায়ণকে তীরস্কার করিয়া, অভিশাপ প্রদানান্তে, আত্মহত্যা করিবার জন্য বৃন্দা আগুনে প্রবেশ করিলেন। নারায়ণ তাঁহাকে বারণ করিলেও তিনি তাহা শুনিলেন না। অনন্তর নারায়ণ বারংবার তাঁহাকে স্মরণপূর্বক দগ্ধদেহ বৃন্দার ভস্ম-রজো দ্বারা শরীর আবৃত করিয়া সেই স্থানেই অবস্থান করিলেন, দেবতা ও সিদ্ধগণ তাঁহাকে সান্ত্বনা দান করিলেও তিনি শান্তি লাভ করিলেন না।

ব্রহ্মা ও সরস্বতী

দেবতাগণের মধ্যে অগ্রগণ্য এবং সৃষ্টিকর্তা হওয়া সত্ত্বেও ব্রহ্মা মর্ত্যলোকে পূজিত হন না। পুরাণে বর্ণিত কাহিনি অনুসারে ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্য সম্পাদন করিবার কালে এক অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীকে সৃষ্টি করিলেন। তিনি সরস্বতী, শতরূপা, গায়ত্রী, সাবিত্রী বা ব্রহ্মাণী নামে পরিচিতা। সেই অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীর রূপদর্শনে ব্রহ্মা কামাসক্ত হইলেন। ব্রহ্মার চক্ষে ঘোর কামদৃষ্টি দর্শন করিয়া সরস্বতী ব্রহ্মার দৃষ্টির অন্তরালে যাইবার চেষ্টা করিতে থাকিলেন। সরস্বতী যাহাতে দৃষ্টির অন্তরালে যাইতে না পারেন তাহার জন্য ব্রহ্মার স্কন্ধের উপর পাঁচদিকে পাঁচটি মস্তক উৎপন্ন হইল। সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ হইতে আত্মরক্ষা ও সম্ভ্রম রক্ষার নিমিত্ত বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধারণ করিয়া পলায়ন করিতে থাকিলেন। ব্রহ্মাও ক্রমান্বয়ে সেইসকল প্রাণীর পুরুষ রূপ ধারণ করিয়া সরস্বতীর সহিত সঙ্গমে লিপ্ত হইলেন যাহার ফলে বিভিন্ন প্রাণীর সৃষ্টি হইল। অবশেষে সরস্বতী ব্রহ্মার কামলালসা হইতে নিস্কৃতি পাইবার জন্য এক গুহার ভিতরে আশ্রয় লইলেন। ব্রহ্মা সেই গুহাতেই সরস্বতীর সহিত মিলিত হইলেন। সরস্বতী ছিলেন ব্রহ্মার কন্যা। কিন্তু তাঁহার সহিত অবৈধ যৌনাচারের অপরাধে মহাদেব ব্রহ্মার একটি মস্তক কর্তন করিলেন এব‌ং অভিশাপ দিলেন যে, ধরাধামে কেহ কখনও ব্রহ্মার পূজা করিবে না।

ব্রহ্মা ও অমোঘা

শান্তনু নামে একজন ঋষি ছিলেন, তাহার রূপবতী পত্নীর নাম অমোঘা। একদিন শান্তনু ফলমূল সংগ্রহ করিবার জন্য বনে গমন করিলে ব্রহ্মা অমোঘার নিকট উপস্থিত হইলেন। কামপীড়িত ব্রহ্মা ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া মহাসতী অমোঘাকে সম্ভোগ করিবার উদ্দেশ্যে ধাবিত হইলে অমোঘা ব্রহ্মাকে নিষেধ করিয়া তাহার পর্ণশালায় প্রবেশ করিলেন। অমোঘার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া সেই পর্ণশালায় প্রবেশ করিলেন। পর্ণশালায় প্রবেশমাত্র অমোঘা ব্রহ্মাকে কহিলেন “আমি পতিব্রতা মুনিপত্নী, কখনো নিন্দনীয় কাজ করিব না, যদি জোরপূর্বক তুমি আমাতে উপগত হও, তাহা হইলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিব।”

অমোঘা এইপ্রকার কহিতে থাকিলে শান্তনু মুনির আশ্রমেই ব্রহ্মার বীর্য পতিত হয়। বীর্যপাত হইবামাত্র ব্রহ্মা তাহার হংসযানে আরোহন করিয়া শান্তনু মুনির আশ্রম ত্যাগ করিলেন।

ব্রহ্মা চলিয়া যাইবার পর শান্তনু মুনি আশ্রমে ফিরিয়া আসিয়া আশ্রমের বাহিরে হংসের পদচিহ্ন দেখিতে পাইলেন । তাহার আশ্রমে ঠিক কি ঘটিয়াছিল, তাহা শান্তনু অমোঘার নিকট জানিতে চাহিলে, অমোঘা শান্তনুকে কহিলেন “একজন কমণ্ডলুধারী চারিটি মস্তকবিশিষ্ট ব্যক্তি হংসবিমানে আরোহন করিয়া আশ্রমে  আসিয়া আমার সহিত সহবাস করিতে চাহেন। আমি শঙ্কিত হইয়া পর্ণশালায় প্রবেশপূর্বক তাহাকে ভর্ৎসনা করিলে তখন সেই ব্যক্তি বীর্যপাত করিয়া আমার অভিশাপের ভয়ে পলায়ন করিয়াছে।” অমোঘার নিকট বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া শান্তনু বুঝিলেন, পিতামহ ব্রহ্মাই তাহার আশ্রমে আসিয়াছিলেন।

 বৃহস্পতি ও মমতা

পুরাণে বর্ণিত বেদজ্ঞ মহামুনি উতথ্যের স্ত্রী অনিন্দ্যসুন্দরী মমতা আর তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন দেবপুরোহিত বৃহস্পতি। একদিন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উতথ্যের অনুপস্থিতিতে বৃহস্পতি কামাবিষ্ট হইয়া গর্ভবতী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পত্নী মমতার সহিত সম্ভোগ করিতে উদ্যত হইলে মমতা তাঁহার দেবরকে যথাসাধ্য নিবৃত্ত করিতে প্রয়াস করিলেন। মমতা বৃহস্পতিকে ইহাও জানাইলেন যে তিনি তাঁহার স্বামী উতথ্য ঋষির ঔরসে গর্ভবতী হইয়াছেন। অতএব, একই গর্ভে দুই সন্তানের স্থান অসম্ভব হওয়ায় এবং বৃহস্পতিও অমোঘরেতাঃ হওয়ার কারণে বৃহস্পতির সাথে মিলিত হওয়া অধর্ম ও অসম্ভব। মমতা বৃহস্পতিকে আরও কহিলেন, “হে মহাভাগ! আমি তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দ্বারা গর্ভবতী হইয়াছি, অতএব তুমি আমার সহিত সঙ্গম করিবার ইচ্ছা সংবরণ করো। আমার গর্ভের মধ্যে উতথ্যের পুত্র ষড়ঙ্গবেদ অধ্যয়ণ করিতেছে। তুমি এই দুষ্কর্ম হইতে নিবৃত্ত হও।

কিন্তু বৃহস্পতির কামোন্মাদনা তখন উত্তুঙ্গে। মমতা বৃহস্পতিকে বিভিন্ন ভাবে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিয়াও বিফল হইলেন। পরিশেষে বৃহস্পতি সবলে মমতার সহিত সংগমে লিপ্ত হইলেন। মমতা যখন বিধ্বস্ত এবং বৃহস্পতির চরম মূহুর্ত সমাগত, তখন মমতার গর্ভস্থ পুত্র তাহাকে বাধা প্রদান করিয়া কহিল, ”হে পিতৃব্য, আপনি ক্ষমতাবান হইতে পারেন, কিন্তু এই মাতৃজঠরে আমি পূর্ব হইতেই উপস্থিত। অতএব, আপনার বীর্য সংবরণ করুন।“ বৃহস্পতিকে এবম্প্রকারে নিষেধ করিয়া মমতার গর্ভস্থ পুত্র স্বীয় পদদ্বারা বীর্য প্রবেশের পথ রুদ্ধ করিয়া দেওয়ার ফলে বৃহস্পতির স্খলিত বীর্য বাহিরে ভূমিতে এবং সেই পতিত বীর্য হইতে ভরদ্বাজের জন্ম হইল। মমতার গর্ভস্থ পুত্রের দ্বারা এইরূপে বাধাপ্রাপ্ত হইলে বৃহস্পতি ক্ষিপ্ত হইয়া মমতার অনাগত সন্তানকে অভিশাপ দিলেন, “আমাকে বাধা দেওয়ার জন্য তুই দীর্ঘ তমোরাশির মধ্যে প্রবেশ করিবি।” যথাসময়ে ভূমিষ্ঠ হইবার পরে বৃহষ্পতি প্রদত্ত ‘দীর্ঘ তমোরাশি’ অর্থাৎ চির অন্ধকারের অভিশাপের কারণে সেই সন্তান জন্মান্ধ হইল। তাহার নামকরণ হইল দীর্ঘতমা। কালক্রমে দীর্ঘতমা একজন বেদজ্ঞ ঋষি হইয়া উঠিয়াছিলেন।

অপরদিকে ভরদ্বাজের জন্মের পরে, স্বামীর ঔরসজাত পুত্র নহে এবং স্বীয় গর্ভজাতও নহে বলিয়া মমতা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন। তখন বৃহস্পতি ভরদ্বাজেকে উতথ্যের ক্ষেত্রজ পুত্র হিসাবে প্রতিপালনের পরামর্শ দিলে মমতা বৃহস্পতির পরামর্শ গ্রহণ না করিয়া ভরদ্বাজকে পরিত্যাগ করিলে বৃহস্পতিও ভরদ্বাজকে ত্যাগ করিলেন। তারপর মরুৎগণ এই পুত্রটিকে পালন করিয়াছিলেন। মরুৎগণের ভুত বা ভর হইয়াছিলেন এবং দ্বাজ বা সঙ্কর পুত্র বলিয়া তাহার নামকরণ হয় ভরদ্বাজ।

চন্দ্র ও বৃহস্পতিপত্নী তারা

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত আছে যে চন্দ্রমা ভাদ্রমাসে শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে বৃহস্পতিপত্নী তারাকে হরণ করিয়া কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথিতে পরিত্যাগ করিলে গুরু বৃহস্পতি তারাকে গ্রহণ করিয়া গর্ভবতী তারাকে ভর্ৎসনা করিলে তারা লজ্জিত হইয়া সক্রোধে কামাতুর চন্দ্রকে এই বলিয়া অভিশাপ প্রদান করেন যে, তুমি আমার অভিশাপে কলঙ্কী হও এবং যে দেহী তোমাকে দর্শন করিবে সেও কলঙ্কী হইবে।”

অশ্বীনিকুমার ও ব্রাহ্মণপত্নী-গোদাবরী

একদা শান্তপ্রকৃতি বলবান  সূর্যপুত্র অশ্বীনিকুমার এক পরমাসুন্দরী ব্রাহ্মণীকে তীর্থযাত্রায় গমন করিতে দেখিয়া তাহার প্রতি সাতিশয় কামাসক্ত হইলেন এবং বারংবার ব্রাহ্মণী কর্তৃক নিবারিত হইয়াও বলপূর্বক নিকটস্থ এক পুষ্পোদ্যানে আনয়ন করিয়া ব্রাহ্মণীতে উপগত হইয়া তাহার গর্ভাধান করিলেন। অনন্তর ব্রাহ্মণপত্নী লজ্জিত এবং ভীত হইয়া সেই গর্ভ মোচন করিবামাত্র সেই রমণীয় পুষ্পোদ্যানে এক মনোহর পুত্র জন্মিল। তখন সেই ব্রাহ্মণী পুত্রস্নেহবশতঃ নবজাতককে ক্রোড়ে লইয়া সলজ্জে স্বামীর নিকটে উপস্থিত হইয়া পথিমধ্যে যে ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহা সবিশেষ কহিলে ব্রাহ্মণ অতি ক্রুদ্ধ হইয়া সেই পুত্রের সহিত ব্রাহ্মণীকে পরিত্যাগ করিলেন। এইরূপে পরিত্যাক্ত হইবার পরে ব্রাহ্মণপত্নী সাতিশয় লজ্জিতা ও দুঃখিতা হইয়া যোগাবলম্বনপূর্বক দেহত্যাগ করিয়া গোদাবরী নামে স্রোতস্বতী হইলেন। এদিকে অশ্বীনিকুমার স্বীয় পুত্রকে মাতৃহীন দেখিয়া স্বয়ং তাহাকে সযত্নে রক্ষা করতঃ চিকিৎসা শাস্ত্র ও নানাবিধ শিল্প এবং মন্ত্রবিষয়ে সবিশেষ শিক্ষা দান করিলেন। পরবর্তীকালে সেই অশ্বিনীকুমার বংশোদ্ভব কোনো ব্যক্তি ক্রমশ বৈদিক ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া নিরন্তর জ্যোতিঃশাস্ত্র গণনা দ্বারা বেতন গ্রহণ করায় এই ভূমণ্ডলে গণক নামে প্রসিদ্ধ হন। তদ্বংশীয় অন্য ব্রাহ্মণ লোভপ্রযুক্ত শূদ্রদিগের অগ্রে দান গ্রহণ ও প্রেতশ্রাদ্ধাদির সামগ্রী স্বীকার করায় অগ্রদানী নামে পরিচিতি লাভ করিয়াছেন।

 বরুণ ও উতথ্যের স্ত্রী ভদ্রা

চন্দ্রদেবের ভদ্রা নাম্নী এক সর্বাঙ্গসুন্দরী কন্যা ছিলো। চন্দ্র অনেক অনুসন্ধানের পর মহর্ষি উতথ্যকে ঐ কন্যার উপযুক্ত পাত্র বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। ঐ কন্যাও উতথ্যকে আপনার উপযুক্ত পতিরূপে পাইবার অভিলাষে অতি কঠোর তপস্যায় প্রবৃত্ত হইলেন। কিয়দ্দিন পরে মহর্ষি অত্রি উতথ্যকে আহ্বানপূর্বক ভদ্রাকে তাহার হস্তে সম্প্রদান করিলেন। জলাধিপতি বরুণের মনে ভদ্রার পাণিগ্রহণের অভিলাষ ছিলো। সেই ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়াতে বরুণ নিতান্ত দুঃখিত হইলেন। অনন্তর একদিন ভদ্রাকে যমুনাজলে অবগাহন করিতে দেখিয়া বরুণ বলপূর্বক তাহাকে হরণ করিয়া স্বীয় পুরমধ্যে আনিলেন। ঐ পুরী ছয়লক্ষ হ্রদে সুশোভিত, বিবিধ সুরম্য প্রাসাদ সমাকীর্ণ ও সর্বকামসম্পন্ন। জলেশ্বর বরুণ ভদ্রাকে সেই পুরীর মধ্যে আনিয়া তাহার সহিত পরমসুখে বিহার করিতে লাগিলেন।

এদিকে দেবর্ষি নারদ এই বৃত্তান্ত উতথ্যকে জানাইলেন। উতথ্য নারদের মুখে স্বীয় পত্নীহরণসংবাদ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, নারদ! তুমি অবিলম্বে বরুণের নিকট গমন করিয়া বল যে, তুমি লোকপালক, চন্দ্রদেব উতথ্যকে যে কন্যা সম্প্রদান করিয়াছেন তুমি কেন সেই কন্যা অপহরণ করিলে? বরুণ নারদের মুখে উতথ্যের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, নারদ! তুমি উতথ্যকে কহিও যে, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী আমার নিতান্ত কাম্য। আমি ইহাকে কদাচ পরিত্যাগ করিব না। বরুণ এই কথা কহিলে মহর্ষি নারদ অচিরাৎ উতথ্যের নিকট যাইয়া কহিলেন, বরুণের নিকট যাইয়া তোমার পত্নীকে প্রত্যর্পণ করিতে সবিশেষ অনুরোধ করিয়াছিলাম, তাহাতে সে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আমাকে অপমানিত করিয়া বিতাড়িত করিয়াছে। সে কিছুতেই তোমার পত্নীকে প্রত্যর্পণ করিবে না। অতঃপর তোমার যাহা কর্তব্য হয় করো । দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিবামাত্র মহর্ষি উতথ্য বরুণের প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া অচিরাৎ সমুদায় সলিল স্তম্ভন পূর্বক পান করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় জলাধিপতি বরুণ উতথ্যকে সমুদায় সলিল পীয়মান দেখিয়া এবং সুহৃদগণ কর্তৃক বারংবার তিরস্কৃত হইয়াও উতথ্যের পত্নীকে পরিত্যাগ করিলেন না।

অনন্তর মহর্ষি উতথ্য ক্রোধভরে ভূমিকে আহ্বান পূর্বক কহিলেন, তোমার সেই ছয় লক্ষ হ্রদযুক্ত স্থান কোথায়? মহর্ষি উতথ্য এইরূপ কহিবামাত্র সমুদ্র তৎক্ষণাৎ বরুণের পুরী হইতে অপসৃত হইল এবং সেই স্থান উষর ক্ষেত্রের ন্যায় দৃশ্যমান হইল। তখন মহর্ষি উতথ্য সরস্বতীকে সম্বোধন পূর্বক কহিলেন, ভদ্রে! তুমি অবিলম্বে এই স্থান হইতে অপসৃত হইয়া মরুদেশে প্রবাহিত হও। এই স্থানটি তোমা কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া অপবিত্র হউক। স্রোতস্বতী সরস্বতী উতথ্যের এইরূপ আদেশ প্রাপ্ত হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইলেন। তখন বরুণ স্বীয় পুরী জলশূণ্য দেখিয়া ভীতচিত্তে উতথ্যের পত্নীকে উতথ্যকে প্রদান করিয়া তাহার শরণাপন্ন হইলেন। মহর্ষি উতথ্য পত্নীকে পুনরায় প্রাপ্ত হইয়া প্রসন্নভাব ধারণপূর্বক সমুদায় জগতকে জলকষ্ট হইতে ও বরুণকে এই বিপদজাল হইতে মুক্ত করিয়া দিলেন।

সূর্য ও কুন্তী

রাজা কুন্তিভোজ শূরসেন কন্যা কুন্তীকে বাল্যাবস্থায় নিজ কন্যারূপে লালন পালন করেন। কুন্তীর কিঞ্চিৎ বোধের উদয় হইলে তাহাকে অগ্নিহোত্রীয় অনলের পরিচর্যায় নিয়োজিত করিলেন। পরে এক দিবস চাতুর্মাস্য ব্রতাবলম্বী দুর্বাসা ঋষি সেই স্থানে উপস্থিত হইলে, কুন্তী তাহার সেবা করায় তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে একটি মন্ত্র প্রদান করেন। এই মন্ত্র পাঠ করিয়া যে কোনো দেবতাকে আহ্বান করিলে তিনি সমাগত হইয়া আহ্বানকারীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকেন। অনন্তর, দুর্বাসা প্রস্থান করিলে কুন্তী মন্ত্রের পরীক্ষার্থে কোন দেবতাকে আহ্বান করিবেন ইহা ভাবিতে লাগিলেন। হেনকালে সূর্যকে উদিত দেখিয়া কুন্তী সেই মন্ত্র পাঠ করিয়া তাহাকে আহ্বান করিলে সূর্যদেব মন্ত্রপ্রভাবে নিজ মন্ডল হইতে অতিসুন্দর মনুষ্য মূর্তি ধারণ করিয়া কুন্তীর সম্মুখে অবতরণ করিলেন। কুন্তী সূর্যদেবকে সমাগত দেখিয়া অতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তৎক্ষণাৎ রজঃস্বলা হইয়া পড়িলেন এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া বলিলেন, দেব! আপনার দর্শনেই আমি কৃতার্থ হইয়াছি এক্ষণে আপনি প্রস্থান করুন।

এই কথা শ্রবণ করিয়া সূর্য কহিলেন, কুন্তী! তুমি মন্ত্রদ্বারা কিজন্য আমাকে আহ্বান করিলে এবং আহ্বান করিয়া কিহেতু আমাকে ভজনা করিতেছ না? হে চারুলোচনে, আমি এক্ষণে কামার্ত হইয়াছি, তোমার প্রতি আমার প্রেমাসক্তি হইয়াছে, অতএব আমার কামনা পূর্ণ করো। আমি মন্ত্রবলে তোমার অধীন হইয়াছি, অতএব রতিক্রিড়ার জন্য আমাকে গ্রহণ করো। সূর্যদেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া কুন্তী কহিল, হে ধর্মজ্ঞ! এক্ষণে আমি অনূঢ়া কুলকন্যা বলিয়া জানিবেন, অতএব কোনোরূপ দুর্বাক্য বলিবেন না।

সূর্যদেব ইহা শুনিয়া কুন্তীকে কহিলেন, যদি আমি অদ্য বৃথা ফিরিয়া যাই তাহা হইলে সমস্ত দেবগণের নিকট নিন্দাভাজন হইব এবং ইহা আমার অতিশয় লজ্জার বিষয় তাহাতে সন্দেহ নাই। কুন্তি! অদ্য তুমি যদি আমার অভিলাষ পূর্ণ না করো তাহা হইলে তোমাকে এবং যে ব্রাহ্মণ তোমাকে এই মন্ত্র প্রদান করিয়াছে তাহাকে অতি কঠোর অভিশাপ প্রদান করিব। আর যদি তুমি আমায় অভিলাষ পূর্ণ করো তাহা হইলে আমার বরে তোমার কন্যারূপ ও ধর্ম অপরিবর্তিত থাকিবে, কেহই এই বিষয় জানিতে পারিবে না এবং আমার সদৃশ তোমার একটি তেজোদীপ্ত সন্তান হইবে।

সূর্যদেব এই কথা বলিয়া একাগ্রচিত্তা এবং অতিলজ্জিতা কুন্তীকে সম্ভোগান্তে অভিলষিত বর প্রদান করিয়া প্রস্থান করিলেন। অনন্তর কুন্তী গৃহে থাকিয়া গর্ভধারণ গোপন রাখিয়া গৃহমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিল। ইহা কেবল তাহার প্রিয় ধাত্রী ভিন্ন অন্য কেহ এমন কি তাহার মাতা পর্যন্ত জানিতে পারেন নাই। এইরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হইলে অতি গোপনে সেই গৃহে একটি মনোহর পুত্র জন্মিল। পুত্রটি সুরম্য কবচ ও কুণ্ডলশোভিত এবং সূর্যের ন্যায় তেজঃপুঞ্জসম্ভূত কলেবরবিশিষ্ট হইল। তদ্দর্শনে কুন্তী অতিশয় লজ্জিতা হইলে ধাত্রী তাহার হস্ত ধারণপূর্বক কহিল, সুন্দরি! যখন আমি রহিয়াছি তখন তোমার চিন্তা কি? অনন্তর সন্তানটিকে পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছুক হইয়া মঞ্জূষামধ্যে তাহাকে রক্ষা করিয়া কুন্তী বলিল, পুত্র! আমি দুঃখিতা হইলেও প্রাণাধিকস্বরূপ তোমাকে পরিত্যাগ করিতেছি, কি করি এক্ষণে আমি এমনই মন্দভাগ্য হইয়াছি যে সর্বসুলক্ষণান্বিত তোমাকে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেছি। পুত্র, আশীর্বাদ করিতেছি, সেই গুণাতীতা ও গুণময়ী সর্বেশ্বরী বিশ্বজননী কাত্যায়নী অম্বিকা আমার অভিলাষ পূর্ণ করিবার জন্য তোমাকে স্তন্যদুগ্ধ প্রদান করিয়া রক্ষা করুন। হায়! আমি এক্ষণে দুষ্টা স্বৈরিনীর ন্যায় তোমাকে নির্জন বনে পরিত্যাগ করিয়া জানিনা কবে আবার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় তোমার এই মুখপদ্ম দর্শন করিব। পুত্র! নিশ্চয়ই আমি পূর্বজন্মে ত্রিজগতের মাতা জগদম্বিকার আরাধনা করি নাই, সেই জন্যই আমি ভাগ্যহীনা হইয়াছি। প্রিয় পুত্র এক্ষণে তোমাকে বনে পরিত্যাগ করিয়া স্বকৃত এই পাপ স্মরণ করিয়া নিরন্তর সন্তাপে দগ্ধ হইব।

ইন্দ্র ও অহল্যা

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অহল্যা নাম্নী এক অপরূপা রমণীকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। ‘অহল্যা’ শব্দের অর্থ ‘অনিন্দনীয়া’। ‘যাহার অবয়বে কোনো বিরূপতা নাই তিনিই অহল্যা’। ‘অহল্যা কাহার পত্নী হইবেন - এই বিষয়ে ব্রহ্মা চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। দেবতাদের রাজা হইবার কারণে ইন্দ্র ভাবিয়াছিলেন, অহল্যা তাহারই পত্নী হইবেন, কিন্তু ব্রহ্মা অহল্যাকে গৌতম মুনির নিকট রাখিবার সিদ্ধান্ত লইলেন এবং বহুকাল অতিক্রান্ত হইবার পরে গৌতম অহল্যাকে ব্রহ্মার হস্তে প্রত্যার্পণ করেন। গৌতমের সংযম দর্শনে ব্রহ্মা অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া অহল্যাকে গৌতমের সহিত বিবাহ দিলেন। অহল্যাকে গৌতমের পত্নীরূপে দেখিয়া দেবতারা হতাশ হইলেন। ইহাতে দেবরাজ ইন্দ্র ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া গৌতমের আশ্রমে উপস্থিত অহল্যাকে দেখিতে পাইলেন এবং কামপীড়িত হইয়া অহল্যাকে বলাৎকার করিলেন।

অহল্যাকে বলাৎকারান্তে পলায়নকালে গৌতম ইন্দ্রকে দেখিতে পাইয়া ক্রোধপরবশ ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন, “ ইন্দ্র! তুমি পরিণাম না ভাবিয়া নির্ভয় চিত্তে আমার পত্নীকে বলাৎকার করিয়াছ। সুতরাং দেবরাজ, আমার অভিশাপে তুমি সমরে শত্রু কবলিত হইবে এবং তোমার শরীরে যোনীর ন্যায় ক্ষত সৃষ্টি হইয়া গাত্রবেদনায় অশেষ যাতনা ভোগ করিবে। মর্ত্যবাসী ও মুনি ঋষিগণ তোমার সেই রূপ দর্শন করিয়া উপহাস করিবে। এরপর গৌতম তার পত্নী অহল্যাকে অতীব তিরস্কার করিয়া কহিলেন, “আমার আশ্রমে তুমি সৌন্দর্যহীনা পাষাণ হইয়া থাকো। এই কথা শুনিয়া অহল্যা সরোদনে কহিলেন,“বিপ্রশ্রেষ্ঠ! স্বর্গবাসী ইন্দ্র তোমার রূপ ধারণ করিয়া আমাকে বলাৎকার করিয়াছে, ইহাতে আমার কোনোরূপ প্ররোচনা ছিলোনা”। গৌতম কর্তৃক অভিশপ্ত হইবার পর ইন্দ্র সহস্র বর্ষ সূর্যের আরাধনা করিয়া তাহার বরে গাত্রের সহস্র যোনিচিহ্ন সহস্র নেত্ররূপে পরিণত হওয়ায় সহস্রাক্ষ নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন।

ইন্দ্র ও ঋষি দেবশর্মার পত্নী রুচি

ঋষি দেবশর্মার পত্নী অতুলনীয়া সুন্দরী রুচির প্রতি ইন্দ্রের লালসা ছিলো। দেবশর্মা স্ত্রীচরিত্র ও ইন্দ্রের পরস্ত্রীলালসার বিষয়ে অবহিত থাকিবার জন্য রুচিকে সাবধানে রক্ষা করিতেন। একদা তিনি তাঁহার প্রিয় শিষ্য বিপুলকে কহিলেন, আমি যজ্ঞ করিতে যাইতেছি, আমার অনুপস্থিতিতে তুমি তোমার গুরুপত্নীকে সাবধানে রক্ষা করিবে। সুরেশ্বর ইন্দ্র রুচিকে সর্বদা কামনা করেন, তিনি বহুপ্রকার মায়া জানেন, বজ্রধারী কিরীটী, চণ্ডাল, জটাচীরধারী, কুরূপ, রূপবান, যুবা, বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ বা অন্য বর্ণ, পশুপক্ষী বা মক্ষিকামশকাদির রূপও ধারণ করিতে পারেন। দুষ্ট কুকুর যেরূপ যজ্ঞের ঘৃত লেহন করে, সেইরূপ দেবরাজ যেন রুচিকে উচ্ছিষ্ট করিতে না পারেন।

দেবশর্মা চলিয়া যাইবার পরে বিপুল ভাবিলেন, মায়াবী ইন্দ্রকে নিবারণ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য, আমি পৌরুষ দ্বারা গুরুপত্নীকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইব না। অতএব আমি যোগবলে গুরুপত্নীর শরীরে প্রবেশপূর্বক পদ্মপত্রে জলবিন্দুর ন্যায় নির্লিপ্তভাবে অবস্থান করিব, তাহাতে আমার অপরাধ হইবে না। এইরূপ ভাবিয়া মহাতপা বিপুল রুচির নিকটে উপবেশন করিয়া স্বীয় নেত্ররশ্মি রুচির নেত্রে সংযোজিত করিয়া গুরুপত্নীর দেহে নির্লিপ্তচিত্তে প্রবেশ করিলেন। রুচি স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন, তাহার দেহমধ্যে বিপুল ছায়ার ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন।

ঋষি দেবশর্মার শঙ্কা সত্য প্রমাণ করিয়া ইন্দ্র আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করিয়া উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, আলেখ্যে চিত্রিত মূর্তির ন্যায় বিপুল স্তব্ধনেত্রে বসিয়া আছেন আর তাহার সন্নিকটে পূর্ণচন্দ্রনিভাননা পদ্মপলাশাক্ষী রুচিও উপবেশন করিয়া আছেন। ইন্দ্রের রূপদর্শনে বিস্মিতা রুচি বলিবার চেষ্টা করিলেন “তুমি কে? কিন্তু সমর্থ হইলেন না। ইন্দ্র মধুরবাক্যে কহিলেন, সুন্দরী, আমি ইন্দ্র, কামার্ত হইয়া তোমার নিকট আসিয়াছি, আমার অভিলাষ পূর্ণ করো। রুচিকে নিশ্চেষ্ট ও নির্বিকার দেখিয়া ইন্দ্র পুনরায় তাহাকে আহ্বান করিলেন, রুচিও উত্তর দিবার চেষ্টা করিলে বিপুল গুরুপত্নীর মুখ দিয়া কহিলেন, কিহেতু আসিয়াছ? এইরূপ বাক্য নির্গত হইলে রুচি লজ্জিত হইলেন, ইন্দ্রও উদ্বিগ্ন হইলেন এবং দেবরাজ দিব্যদৃষ্টি দ্বারা দেখিলেন, মহাতপা বিপুল দর্পণস্থ প্রতিবিম্বের ন্যায় রুচির দেহমধ্যে অবস্থান করিতেছেন। ইন্দ্র অভিশাপের শঙ্কায় ত্রস্ত হইয়া কাঁপিতে লাগিলেন। ইন্দ্রের অবস্থা দর্শনে বিপুল নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, অজিতেন্দ্রিয় দুর্বুদ্ধি পাপাত্মা পুরন্দর, তুমি দেবতা আর মনুষ্যের পূজা অধিক দিন ভোগ করিবে না। গৌতমের অভিশাপে তোমার সর্বদেহে যোনিচিহ্ন হইয়াছিল তাহা কি বিস্মৃত হইযাছ? আমি গুরুপত্নীকে রক্ষা করিতেছি, তুমি দূর হও, আমার গুরু তোমাকে দেখিলে এখনই দগ্ধ করিবেন। তুমি নিজেকে অমর ভাবিয়া আমাকে অবজ্ঞা করিও না। তপস্যার অসাধ্য কিছুই নাই জানিয়া ইন্দ্র নিরুত্তর থাকিয়া মূহুর্তমধ্যে অন্তর্হিত হইলেন।

শিব ও বিষ্ণুর মোহিনী রূপ

শিব বিষ্ণুর মোহিনী রূপ দর্শনেচ্ছুক হইলে বিষ্ণু শিবকে কহিলেন, “সমুদ্র মন্থনকালে অসুরেরা যখন অমৃতভাণ্ড অপহরণ করিয়াছিল তখন আমি এক সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণপূর্বক তাহাদের মোহিত করিয়া দেবতাদের কার্যোদ্ধার করিয়াছিলাম। হে মহেশ্বর, যেহেতু আপনি ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন, সেইজন্য আমি আপনাকে কামার্ত ব্যক্তিদের অত্যন্ত অভিলষিত আমার সেই রূপ দেখাইব।” এইরূপ কহিয়া বিষ্ণু তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হইলেন এবং মহাদেব ও উমা চতুর্দিকে চক্ষু সঞ্চালন করিয়া তাহাকে খুঁজিতে লাগিলেন। অকস্মাৎ নানাবিধ ফুল এবং অরুণবর্ণ পল্লবযুক্ত বৃক্ষশোভিত নিকটবর্তী এক উপবনে মহাদেব অপূর্ব সুন্দরী এক রমণীকে কন্দুক লইয়া ক্রীড়ারত দেখিতে পাইলেন। তাহার নিতম্বদেশ উজ্জ্বল বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং মেখলা শোভিত। সেই কন্দুকের অবক্ষেপণ এবং উৎক্ষেপণ করিয়া সেই রমণী যখন খেলিতেছিলেন, তখন তাহার স্তনদ্বয় কম্পিত হইতেছিল এবং তাহার সেই স্তনভারে বোধ হইতেছিল তাহার সুকোমল তনুর মধ্যভাগ প্রতি পদক্ষেপে ভগ্ন হইয়া যাইবে, এইরূপে তিনি তাহার কুসুমতুল্য কোমল চরণ ইতস্ততঃ সঞ্চালন করতেছিলেন। সেই রমণীর মুখমণ্ডল আয়ত, সুন্দর, চঞ্চল চক্ষুর দ্বারা সুশোভিত এবং তাহার নয়নযুগল কন্দুকের উৎক্ষেপণ এবং অবক্ষেপণের সহিত ঘুরিতেছিল। অতি উজ্জ্বল কর্ণকুণ্ডল তাহার উজ্জ্বল গণ্ডদেশ নীলাভ প্রতিবিম্বে সুশোভিত করিয়াছিল এবং আলুলায়িত কেশরাশি তাহার মুখমণ্ডলকে আরও আকর্ষনীয় করিয়া তুলিয়াছিল। কন্দুক লইয়া খেলিতে খেলিতে তাহার বস্ত্র শিথিল হইয়াছিল এবং কেশ স্খলিত হইয়াছিল। তিনি সুন্দর বাম হস্তদ্বারা তাহার কেশ বন্ধনের প্রয়াস করিতেছিলেন এবং দক্ষিণ হস্তদ্ব্বারা সেই কন্দুক লইয়া খেলিতেছিলেন। এইরূপে বিষ্ণু আত্মমায়ার দ্বারা সমগ্র জগৎ বিমোহিত করিয়াছিলেন।

মহাদেব যখন সেই সুন্দরী রমণীকে কন্দুক লইয়া খেলা করিতে দেখিতেছিলেন, তখন সেই রমণীও তাহার প্রতি ক্ষণে ক্ষণে দৃষ্টিপাত করিয়া সলজ্জে ঈষৎ হাস্য করিতেছিলেন। সেই সুন্দরী রমণীকে নিরীক্ষণ করিয়া এবং সেই রমণীকে প্রতিনিরীক্ষণ করিতে দেখিয়া মহাদেব তাহার পরমা সুন্দরী পত্নী উমা এবং নিকটস্থ পার্ষদগণকে বিস্মৃত হইলেন। রমণীর হস্ত হইতে অকস্মাৎ কন্দুকটি দূরে পতিত হইলে তিনি কন্দুকটির পশ্চাদ্ধাবন করিবার ফলে মহাদেবের সমক্ষেই বায়ু তাহার কটিদেশের সূক্ষ্ম বস্ত্র উড়াইয়া লইলে মহাদেব দেখিলেন, সেই রমণীর প্রতিটি অঙ্গ অনিন্দ্যসুন্দর এবং সেই রমণীও মহাদেবকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই রমণী তাহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছেন ভাবিয়া মহাদেব তাহার প্রতি কামাসক্ত হইয়া পড়েন। সেই রমণীর সহিত রমণ করিবার বাসনায় শিব এমনই উন্মত্ত হইলেন যে, ভবানীর সমক্ষেই তিনি নির্লজ্জভাবে সেই সুন্দরীর পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। প্রবল বায়ুপ্রভাবে সেই সুন্দরী রমণী ইতিমধ্যে বিবসনা হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং তিনি শিবকে তাঁহার প্রতি ধাবিত দেখিয়া সাতিশয় লজ্জিত হইয়া হাসিতে হাসিতে বৃক্ষের অন্তরালে লুকাইলেন এবং দ্রুত স্থান পরিবর্তন করিতে থাকিলেন। মহাদেবের কামতাড়না নিয়ন্ত্রণহীন হইবার ফলে কামান্ধ হস্তী যেমন হস্তিনীর প্রতি ধাবিত হয়, মহাদেবও সেইরূপে সুন্দরীর প্রতি ধাবিত হইলেন। দ্রুতবেগে রমণীর পশ্চাতে ধাবিত হইয়া মহাদেব সেই সুন্দরীর বেণী আকর্ষণপূর্বক তাহাকে আলিঙ্গন করিলেন। হস্তির দ্বারা আলিঙ্গিতা হস্তিনীর ন্যায় বিষ্ণুর যোগমায়া নির্মিতা নিতম্বিনী সুন্দরী মহাদেবের দ্বারা আলিঙ্গিতা হইবার পর আলুলায়িত কেশে মহাদেবের বাহুপাশ হইতে মুক্ত হইয়া দ্রুতবেগে পলায়ন করিলেন। মত্ত হস্তী যেরূপ ঋতুমতী হস্তিনীর অনুগমন করে, অমোঘবীর্য মহাদেবও সেইরূপে সেই সুন্দরীর পশ্চাদ্ধাবন করিতে লাগিলেন এবং তখন তাঁহার বীর্য স্খলিত হইয়াছিল। পৃথিবীর যে সকল স্থানে মহাদেবের বীর্য পতিত হইয়াছিল, সেই সেই স্থান স্বর্ণ ও রৌপ্যের খনিতে পরিণত হইয়াছিল। মোহিনীকে অনুসরণকালে মহাদেব নদী, সরোবর , পর্বত, বন ও উপবনে এবং যে সকল স্থানে ঋষিগণ অবস্থান করিতেন, সেই সকল স্থানে গিয়াছিলেন। মহাদেবের বীর্য সম্পূর্ণরূপে স্খলিত হইলে তিনি উপলব্ধি করিলেন কিপ্রকারে তিনি বিষ্ণুর মায়ায় বশীভূত হইয়াছেন এবং তখন তিনি সেই মোহ হইতে নিবৃত্ত হইলেন।”

পরাশর ও সত্যবতী এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের জন্মকাহিনি

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারতের রচয়িতা এবং অন্যতম প্রধান চরিত্র। বেদব্যাসের পিতা মহামুনি পরাশর এবং মাতা সত্যবতী। একদা পরাশর যমুনা নদী পার হইবার নিমিত্ত একখানি নৌকায় উঠিলেন যাহার চালিকা  ছিলেন পরমাসুন্দরী ধীবরকন্যা সত্যবতী। সত্যবতীর রূপদর্শনে পরাশর কামার্ত হইয়া সত্যবতীকে সম্ভোগ করিতে চাহিলে সত্যবতী কহিলেন, কুমারী অবস্থায় আপনার সহিত আমার মিলিত হইবার কথা কেহ জানিতে পারিলে বা প্রকাশ পাইলে আমার বিবাহ হইবে না। সত্যবতীর কথা শ্রবণ করিয়া পরাশর ঘন কুজ্ঝ্বটিকা সৃষ্টি করিয়া কহিলেন তোমার সহিত আমার মিলন কাহারো দৃষ্টিগোচর হইবে না এবং আমার বরে তোমার শরীরে কুমারীর লক্ষণ অটুট থাকিবে। পরাশর ও সত্যবতীর মিলনে সত্যবতী গর্ভবতী হইলেন এবং যথাসময়ে একটি  দ্বীপে এক পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই পুত্রের গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ এবং জন্ম দ্বীপে হইবার হেতু তাহার নামকরণ হইল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস।

 

অযোনীজ, শুক্রোৎপন্ন, নিয়োগপদ্ধতি এবং যজ্ঞোৎপন্ন বিভিন্ন মুনি-ঋষি, রাজপুত্র ও রাজকন্যার কাহিনিঃ

যুবনাশ্ব এবং মান্ধাতার কাহিনি

ইক্ষাকুবংশে যুবনাশ্ব নামক এক রাজা ছিলেন। তিনি মন্ত্রীদের উপর রাজ্যভার অর্পণ করিয়া বনমধ্যে যাইয়া সন্তানকামনায় যোগসাধনা করিতে লাগলেন। একদিন তিনি ক্লান্ত ও পিপাসার্ত হইয়া চ্যবন মুনির আশ্রমে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যজ্ঞবেদীর উপর এক কলস জল রক্ষিত আছে। যুবনাশ্ব জল চাহিলেন, কিন্তু তাহার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর কেহই শুনিতে পাইলেন না। তখন তিনি সেই কলস হইতে জলপান করিয়া অবশিষ্ট জল ফেলিয়া দিলেন। চ্যবন ও অন্যান্য মুনিরা জাগরিত হইয়া দেখিলেন, কলস জলশূন্য। যুবনাশ্বের স্বীকারোক্তি শ্রবণে চ্যবন কহিলেন, রাজা, আপনি অনুচিত কার্য করিয়াছেন, আপনার পুত্রোৎপত্তির নিমিত্ত এই তপঃসিদ্ধ জল রাখিয়াছিলাম। জলপান করিবার ফলে আপনিই গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবেন কিন্তু গর্ভধারণের ক্লেশ অনুভব করিবেন না। শতবর্ষ পূর্ণ হইলে যুবনাশ্বের বাম পার্শ্ব ভেদ করিয়া এক সূর্যতুল্য তেজস্বী পুত্র নির্গত হইল। দেবতারা শিশুটিকে দর্শন করিতে আসিলেন। তাহারা কহিলেন, এই শিশু কি পান করিবে? ‘মাং স্যতি’ (আমাকে পান করিবে) — এই বাক্য বলিয়া ইন্দ্র তাহার মুখমধ্যে স্বীয় তর্জনী প্রবেশ করাইলে পুরে দিলেন, শিশুটি তাহা স্তন্যবৎ চুষিতে লাগিল। এইজন্য তাহার নামকরণ হইল মান্ধাতা। এই মান্ধাতা রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন।

বিভাণ্ডক মুনি, ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি এবং রামচন্দ্রাদি চার ভ্রাতার জন্মকাহিনি

একদা বিভান্ডক মুনি দীর্ঘকাল তপস্যায় শ্রান্ত হইয়া নদীতে অবগাহন করিতেছিলেন, এমন সময় অপ্সরা উর্বশীকে দর্শনমাত্র তিনি কামার্ত হওয়ায় জলমধ্যে তাহার শুক্রপাত হইয়া গেলো। সেই সময় এক তৃষিতা হরিণী বিভান্ডক মুনির স্নানান্তে সেই স্থান হইতে বিভান্ডকের শুক্রমিশ্রিত জলপান করিয়া গর্ভবতী হইলো এবং যথাকালে এক মানবশিশু প্রসব করিলো। এই মানবশিশুর মস্তকের উপর হরিণের মতো শৃঙ্গ ছিলো। সেই শিশুর ঋষ্যশৃঙ্গ নামকরণ করা হইলো। ঋষ্যশৃঙ্গ বালকাবস্থা হইতেই সর্বদা ব্রহ্মচর্যে নিরত থাকিতেন এবং পিতা বিভাণ্ডক ভিন্ন অন্য কোনো মানুষও দেখেন নাই। সেই সময়ে অঙ্গদেশে রাজা ছিলেন লোমপাদ, তিনি অযোধ্যার রাজা দশরথের বন্ধু ছিলেন। রাজা লোমপাদের কন্যা শান্তার সহিত ঋষ্যশৃঙ্গের বিবাহ হয়। এই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি রাজা দশরথের  দ্বারা আয়োজিত পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ সম্পাদন করিলে, দশরথের তিন পত্নী কৌশল্যার গর্ভে রাম, কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত এবং সুমিত্রার গর্ভে  লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন নামে চার পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিল।

(প্রথমতঃ সত্যই কি হরিণী বীর্যমিশ্রিত জলপান করিয়া গর্ভবতী হইয়াছিল, না কি বিভাণ্ডক  হরিণীর সহিত মিলিত হইবার কারণে গর্ভবতী হইয়াছিল – ইহা সন্দেহের ঊর্দ্ধে নহে। দ্বিতীয়তঃ রাম, ভরত লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নকে কি দশরথের পুত্র বলিয়া অভিহিত করা যৌক্তিক?)।

মৎস্যগন্ধা বা সত্যবতীর জন্মকাহিনি

শুক্তিমতী নদীর সন্নিকটে রাজা উপরিচরের রাজধানী ছিলো। কোলাহল নামক পর্বত শুক্তিমতী নদীর গর্ভে এক পুত্র এবং এক কন্যা উৎপাদন করিয়াছিল। রাজা উপরিচর সেই পুত্রকে সেনাপতি এবং কন্যাকে মহিষী করিলেন। একদিন মৃগয়া করিতে গিয়ে রাজা উপরিচর তাহার ঋতুস্নাতা রূপবতী মহিষী গিরিকাকে স্মরণ করিয়া কামাবিষ্ট হইলে তাহার শুক্রস্খলন হইয়া যাওয়ায় সেই শুক্র এক শ্যেনপক্ষীকে সমর্পণ করিয়া কহিলেন, তুমি শীঘ্র যাইয়া গিরিকাকে এই শুক্র অর্পণ করিবে। পথিমধ্যে অন্য এক শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে  সেই শুক্র যমুনার জলে পতিত হইলে অদ্রিকা নামক ব্রহ্মশাপে মৎস্যরূপী এক অপ্সরা সেই শুক্রমিশ্রিত জল পান করিয়া গর্ভিণী হইবার পর দশম মাসে ধীবরের জালে ধৃত হইল। ধীবর সেই মৎসীর উদরে একটি সুদর্শন পুরুষ এবং একটি সুদর্শনা কন্যা সন্তান পাইয়া রাজা উপরিচরের নিকট লইয়া যাওয়ার মূহুর্তে অপ্সরা শাপমুক্ত হইয়া গেলো। উপরিচর পুরুষ সন্তানটিকে রাখিয়া ধীবরকে কহিলেন, এই কন্যা তোমারই হোক। সেই সুদর্শনা কন্যার নামকরণ করা হইল সত্যবতী এবং তাহারই অপর নাম মৎস্যগন্ধা।

দ্রোণাচার্যের জন্মকাহিনি

দেবগুরু বৃহষ্পতির পুত্র মহর্ষি ভরদ্বাজ গঙ্গায় স্নান করিতে গিয়াছিলেন। সেইস্থানে অনিন্দ্যরূপযৌবনসম্পন্না মদদৃপ্তা অপ্সরা ঘৃতাচি তখন স্নান করিতেছিল। নদীর খরস্রোতে ঘৃতাচির অঙ্গবস্ত্র ভাসিয়া যাওয়ায় জলমধ্যে নগ্নিকা সুন্দরী ঘৃতাচিকে দর্শন করিয়া ভরদ্বাজ কামোন্মাত্ত হইয়া পড়িলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁহার বীর্যপাত হইয়া গেলো। ভরদ্বাজ সেই স্খলিত বীর্য সংগ্রহপূর্বক একটি 'দ্রোণ' বা কলস নামক পাত্রে সংরক্ষণ করিলেন। সেই সংগৃহীত বীর্য হইতে এক পুত্রের জন্ম হইল। দ্রোণে রক্ষিত বীর্য হইতে জন্ম লইবার জন্য সেই পুত্রের নাম দ্রোণাচার্য। 

কৃপাচার্য ও কৃপীর জন্মকাহিনি

মহর্ষি গৌতমের পুত্র শরদ্বান অজেয় ধনুর্বিদ ছিলেন এবং তাহার পরাক্রম ও ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শিতা দেবরাজ ইন্দ্রকে শঙ্কিত করিয়াছিল। একদা মহর্ষি গৌতমের পুত্র শরদ্বান যখন বনমধ্যে তপস্যা করিতেছিলেন, তখন ইন্দ্রপ্রেরিত অতি সূক্ষ্ম বস্ত্রপরিহিতা উদ্ভিন্নযৌবনা এক অপ্সরা তথায় আগমন করিয়া মনোহর ভঙ্গিমায় শরদ্বানকে আকৃষ্ট করিতে থাকিলেন। সেই অপ্সরার মনোহর অঙ্গভঙ্গিমায় শরদ্বান কামার্ত হইয়া পড়ায় তাহার বীর্যস্খলন হইয়া একটি শর-এর অগ্র্ভাগে পতিত হইলে স্খলিত বীর্য দ্বিধাবিভক্ত হইয়া ভূমিতে পড়িবামাত্র একটি শিশুপুত্র এবং একটি শিশুকন্যার জন্ম হইয়াছিল। সেই শিশুদ্বয়কে দেখিতে পাইয়া রাজা শান্তনু রাজপ্রাসাদে আনয়ন করিয়া শিশুপুত্রের নাম কৃপ এবং শিশুকন্যার নাম কৃপী রাখিলেন।

বিচিত্রবীর্য, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম বৃত্তান্ত

শান্তনুর সহিত সত্যবতীর বিবাহ হইলে সত্যবতীর গর্ভে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে শান্তনুর দুই পুত্রের জন্ম হইয়াছিল। কনিষ্ঠ পুত্র যৌবনলাভ করিবার পূর্বেই শান্তনুর মৃত্যু হওয়ায় ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজপদে অভিষিক্ত করিলেন। চিত্রাঙ্গদ বলদর্পে মনুষ্য দেবতা অসুর গন্ধর্ব সকলকেই নিকৃষ্ট ভাবিতেন। একদিন গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ তাহাকে কহিলেন, তোমার আর আমার একই নাম, আমার সহিত যুদ্ধ করো নতুবা অন্য নাম গ্রহণ করো। তখন কুরুক্ষেত্রে হিরন্মতী নদীতীরে দুজনের ঘোর যুদ্ধে শান্তনুনন্দন চিত্রাঙ্গদ নিহত হইলে ভীষ্ম নাবালক বিচিত্রবীর্যকে রাজপদে অধিষ্টিত করিলেন। বিচিত্রবীর্য যৌবনলাভ করিলে ভীষ্ম তাহার বিবাহ দেওয়ার নিমিত্ত বিমাতার অনুমতি লইয়া অম্বা অম্বিকা ও অম্বালিকা নাম্নী কাশীরাজের তিন কন্যাকে বলপূর্বক হস্তিনাপুরে লইযা আসিলেন।

বিবাহের পূর্বে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা ভীষ্মকে বলিলেন, আমি স্বয়ংবরে শাল্বরাজকে পতিরূপে বরণ করিতাম, তিনিও আমাকে পত্নীরূপে চাহেন, আমার পিতারও তাহাতে সম্মতি আছে। অম্বার মনোবাসনা শ্রবণ করিয়া ভীষ্ম অম্বাকে শাল্বরাজের নিকট প্রেরণ করিলেন এবং অন্য দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সহিত বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলেন। বিচিত্রবীর্য দুই সুন্দরী পত্নীকে পাইয়া অতিশয় কামাসক্তির হেতু ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুবরণ করিলেন। পুত্রশোকে কাতর সত্যবতী তাহার দুই পুবধূকে সান্ত্বনা দিয়ে ভীষ্মকে কহিলেন, রাজা শান্তনুর বংশরক্ষার ভার এখন তোমার। তুমি ধর্মের তত্ত্ব এবং কুলাচার সবিশেষ অবহিত, অতএব আমার আদেশে বংশরক্ষার নিমিত্ত দুই ভ্রাতৃবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করো অথবা স্বয়ং রাজ্যে অভিষিক্ত হও এবং বিবাহ করো।

ভীষ্ম কহিলেন, মাতা, আমি ত্রিলোকের সমস্তই ত্যাগ করিতে পারি কিন্তু যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি তাহা ভঙ্গ করিতে পারি না। মহারাজা শান্তনুর বংশ যাহাতে রক্ষা হয় তাহার নিমিত্ত ক্ষাত্রধর্মসম্মত উপায় বলিতেছি, শ্রবণ করুন - “পুরাকালে পরশুরাম কর্তৃক পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হইলে ক্ষত্রিয়নারীগণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সহবাসে সন্তান উৎপাদন করিয়াছিলেন, বেদে বর্ণিত আছে যে, ক্ষেত্রজ পুত্র বিবাহকারীর পুত্ররূপে গণ্য হয়। ধর্মাত্মা বলি এই ধর্মসম্মত উপায় অবলম্বন করিয়া মহর্ষি দীর্ঘতমার দ্বারা তাহার স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, ও সুহ্ম নামে পঞ্চ তেজস্বী পুত্র লাভ করিয়াছিলেন”।

ভীষ্মের নিকট এইরূপ শ্রবণ করিয়া সত্যবতী কিঞ্চিৎ লজ্জিতভাবে নিজের পূর্ব ইতিহাস প্রকাশ করিয়া বলিলেন, কন্যাবস্থায় মহামুনি পরাশরের ঔরসে আমার একটি পুত্র হইয়াছিল তাহার নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ভীষ্ম, তুমি আর আমি অনুরোধ করিলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন তাহার ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করিবেন।

অতঃপর সত্যবতী স্মরণ করিলে বেদব্যাস হস্তিনাপুরে আগমনপূর্বক অম্বিকার সহিত মিলনে তাহার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রকে, অম্বালিকার সহিত মিলনে তাহার গর্ভে পাণ্ডুকে এবং এক দাসীর সহিত মিলিত হইয়া তাহার গর্ভে বিদুরকে উৎপন্ন করিলেন।

গান্ধারীর দুর্যোধনাদি শত পুত্র ও এক কন্যার জন্মবৃত্তান্ত

মহর্ষি বেদব্যাস গান্ধারীকে বর দিয়াছিলেন যে তাহার একশত পুত্র হইবে। যথাকালে গান্ধারী গর্ভবতী হইলেন, কিন্তু দুই বৎসর অতিক্রান্ত হইবার পরও তাহার কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হইল না। অপরদিকে কুন্তীর একটি পুত্র যুধিষ্ঠিরের জন্ম হইয়াছে জানিয়া তিনি অধীর ও ঈর্ষান্বিত হইয়া আপনার গর্ভপাত করিলে লৌহের ন্যায় কঠিন একটি মাংসপিণ্ড প্রসূত হইল। তিনি সেই মাংসপিণ্ড পরিত্যাগ করিতে যাইতেছিলেন এমন সময় বেদব্যাস আসিয়া কহিলেন, আমার বাক্য বৃথা হইবে না। অতঃপর বেদব্যাসের উপদেশে গান্ধারী শীতল জলে মাংসপিণ্ড ভিজাইয়া রাখিলেন, তাহা হইতে অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ একশত এক ভ্রূণ সৃষ্টি হইল। সেই ভ্রূণগুলি তিনি পৃথক পৃথক ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখিলে এক বৎসর পরে একটি কলসে দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করিল। দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করিবার এক মাস অতিক্রান্ত হইলে বাকি একশত ভ্রূণ হইতে দুঃশাসন, দুঃসহ প্রভৃতি আরও নিরানব্বইটি পুত্র এবং দুঃশলা নামক একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করিলো। গান্ধারী গর্ভবতী থাকিবার সময় এক বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করিত যাহার ফলে সেই বৈশ্যার গর্ভে যুযুৎসু নামক এক পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিল।

ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত

একদা দ্রোণাচার্যের নিকট পরাজিত হইবার পর দ্রুপদ প্রতিশোধ ও পুত্রলাভের জন্য অতিশয় ব্যগ্র হইলেন। তিনি গঙ্গা ও যমুনার তীরে চলিতে চলিতে একটি ব্রাহ্মণদের বসতিতে আসিলেন। সেইস্থানে যাজ ও উপযাজ নামক দুইজন ব্রহ্মর্ষি বাস করিতেন। উপযাজের পদসেবা করিয়া দ্রুপদ কহিলেন, আমি আপনাকে দশ কোটি গাভী দান করিব, আপনি আমাকে এমন পুত্র পাইবার উপায় করুন য়ে পুত্র দ্রোণাচার্যকে বধ করিবে। উপযাজ রাজি হইলেন না, তথাপি দ্রুপদ তাঁহার সেবা করিতে লাগিলেন। এক বৎসর অতিক্রান্ত হইলে উপযাজ বলিলেন, আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যাজ শুচি অশুচি বিচার করেন না। উনি গুরুগৃহে বাস করিবার সময় অপরের উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন ভোজন করিতেন। যাজ ধনের প্রত্যাশা করেন এবং আপনার জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করিবেন। যাজের প্রতি অশ্রদ্ধা হইলেও দ্রুপদ তাহার নিকট প্রার্থনা জানাইলে যাজ সম্মত হইলেন এবং উপযাজকে সহায়রূপে নিযুক্ত করিলেন।

যজ্ঞ সমাপ্ত হইলে যাজ দ্রুপদের পত্নীকে আহ্বান করিয়া কহিলেন আপনার দুই সন্তান উপস্থিত হইয়াছে। অতঃপর যাজ যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দিলে যজ্ঞাগ্নি হইতে এক অগ্নিবর্ণ বর্মমুকুটভূষিত খড়্গ ও ধনুর্বাণধারী কুমার সগর্জনে আবির্ভুত হইলেন। পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হইয়া সাধু সাধু কহিতে লাগিল। সেই সময় আকাশবাণী হইলো — এই রাজপুত্র দ্রোণকে বধ করিবেন। তারপর যজ্ঞবেদী হইতে এক কুমারী আবির্ভুতা হইলেন। তিনি সুদর্শনা, শ্যামবর্ণা, পদ্মপলাশলচনা, কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশ এবং তাহার অঙ্গসৌরভ বহু দূরেও অনুভূত হইতেছিল। পুনর্বার আকাশবাণী হইল - সমস্ত নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণার নিমিত্ত ক্ষত্রিয়ক্ষয় এবং কুরুবংশের সর্বনাশ হইবে। দ্রুপদ ও তাহার পত্নী এই কুমার ও কুমারীকে পুত্র-কন্যা রূপে লাভ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। কুমারের নামকরণ করা হইলো ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং কুমারীর নামকরণ করা হইলো কৃষ্ণা এবং দ্রুপদের কন্যা বলিয়া দ্রৌপদী নামে অভিহিতা হইলেন।

 

মাংস আহারের বিষয়ে যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্মের উপদেশঃ

যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে কহিলেন, পিতামহ, আপনি বহুবার বলিয়াছেন যে অহিংসা পরম ধর্ম। আপনার কাছে ইহাও শুনিয়াছি যে পিতৃগণ আমিষ ভোজনে অধিকতর তৃপ্তিলাভ করিয়া থাকেন সেইহেতু শ্রাদ্ধকার্যে বহুবিধ মাংস দেওয়া হইয়া থাকে। হিংসা না করিলে মাংস কি প্রকারে পাওয়া যাইবে? ভীষ্ম বলিলেন, যাহারা সৌন্দর্য স্বাস্থ্য আয়ু বুদ্ধি বল ও স্মরণশক্তি কামনা করেন তাহারা হিংসা ত্যাগ করিয়া থাকেন। স্বয়ম্ভুব মনু বলিয়াছেন, যিনি মাংস আহার ও পশুহত্যা করেন না তিনি সর্বজীবের মিত্র ও বিশ্বাসের পাত্র। নারদ বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি অপরের মাংস ভোজন করিয়া আপনার মাংস বৃদ্ধি করিতে চাহে সে কষ্ট ভোগ করিয়া থাকে। মাংসাশী ব্যক্তি মাংস আহার ত্যাগ করিলে যে পূণ্যফল পাইয়া থাকে, বেদাধ্যয়ন ও সকল যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেও সেরূপ ফল পাইতে পারে না। মাংস ভোজনে আসক্তি জন্মাইলে তাহা পরিত্যাগ করা কষ্টসাধ্য। মাংস আহার ত্যাগ করিলে সকল প্রাণী অভয় লাভ করিয়া থাকে। মাংসভোজী না থাকিলে কেহ পশুহত্যা করিবে না, মনুষ্য মাংস ভোজন করিবার নিমিত্ত পশুঘাতক হইয়াছে। মনু কহিয়াছেন, যজ্ঞাদি কর্মে এবং শ্রাদ্ধে পিতৃগণের উদ্দেশ্যে যে মন্ত্রপূত সংস্কৃত মাংস নিবেদিত হইয়া থাকে তাহা পবিত্র, তাহা ভিন্ন অন্য মাংস অপবিত্র এবং অভক্ষ্য।

যুধিষ্ঠির পুনরায় কহিলেন, মাংসাশী ব্যক্তি পিঠা শাক প্রভৃতি সুস্বাদু খাদ্য অপেক্ষা মাংস ভোজনে অধিক তৃপ্তিলাভ করিয়া থাকে। আমার অভিমত মাংসের তুল্য সুস্বাদু এবং সরস খাদ্য কিছুই নাই। অতএব, আপনি মাংস আহার ও মাংস বর্জনের দোষগুণ বর্ণনা করুন। ভীষ্ম বলিলেন, তোমার বাক্য সত্য, মাংস অপেক্ষা অধিক সুস্বাদু কোনো ভক্ষ্যদ্রব্য নাই। ক্ষীণদেহী দুর্বল ইন্দ্রিয়সেবী ও শ্রান্ত লোকের জন্য মাংসই শ্রেষ্ঠ খাদ্য, তাহাতে দ্রুত বলবৃদ্ধি ও পুষ্টিলাভ হইয়া থাকে। তথাপি যে ব্যক্তি অপরের মাংস ভোজন করিয়া আপনার মাংস বৃদ্ধি করিতে চাহে তাহার অপেক্ষা ক্ষুদ্রমতি ও নৃশংস কেহই নাই। বেদে বর্ণিত আছে যে, পশুগণ যজ্ঞের নিমিত্ত সৃষ্ট হইয়াছে, অতএব যজ্ঞ ভিন্ন অন্য কারণে পশুহত্যা রাক্ষসের কর্ম। প্রাচীনকালে মহামুনি অগস্ত্য অরণ্যের পশুগণকে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করিয়াছিলেন, সেইহেতু ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যজ্ঞের নিমিত্ত মৃগয়া ধর্মসম্মত।

 

বিশ্বামিত্র ও চণ্ডালের কাহিনিঃ

যুধিষ্টির ভীষ্মকে কহিলেন, পিতামহ, ধর্ম লোপ পাইলে মনুষ্য পরস্পরকে বঞ্চনা করিয়া থাকে, অনাবৃষ্টির ফলে খাদ্যাভাব হইয়া থাকে, সমস্ত ধন দস্যুর হস্তগত হইয়া থাকে, সেই আপৎকালে কিরূপে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা সমিচীন? ভীষ্ম যুধিষ্টিরকে কহিলেন, আমি এক প্রাচীন কাহিনি বলিতেছি শ্রবণ করো -

ত্রেতা এবং দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে বারো বৎসর কাল ঘোর অনাবৃষ্টি হইয়াছিল। কৃষিকার্য অসম্ভব হইল, তস্কর এবং রাজাদের উৎপীড়নে গ্রাম নগরাদি জনশূন্য হইয়া গেলো, গবাদি পশু খাদ্যাভাবে বিনষ্ট হইল, মনুষ্য ক্ষুধার্ত হইয়া পরস্পরের মাংস ভোজনে প্রবৃত্ত হইল। এইরূপ আপৎকালে মহর্ষি বিশ্বামিত্র স্ত্রীপুত্রকে এক জনপদে রাখিয়া ক্ষুধার্ত হইয়া খাদ্যের সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে পর্যটন করিতে করিতে একদিন তিনি চণ্ডালদের বসতিতে উপনীত হইয়া বিক্ষিপ্তভাবে সারমেয়চর্ম, শুকর ও গর্দভের অস্থি এবং মৃত মনুষ্যের মলিন বস্ত্র দেখিতে পাইলেন। কোনোখানে কুক্কুট ও গর্দভের রব শোনা যাইতেছে, কোনোখানে চণ্ডালরা একে অপরের সহিত কলহরত। বিশ্বামিত্র খাদ্যের সন্ধান করিলেন, কিন্তু কোথাও মাংস অন্ন কিংবা ফলমূল দেখিতে না পাইয়া তিনি দুর্বলতাবশতঃ অবসন্ন হইয়া ভূমিতে পতিত হইলেন। অকস্মাৎ তাহার দৃষ্টিগোচর হইল, এক চণ্ডালের গৃহে সারমেয়র মাংস রক্ষিত আছে। বিশ্বামিত্র ভাবিলেন, প্রাণরক্ষার নিমিত্ত চুরি করিলে অধর্ম হইবে না। রাত্রিকালে চণ্ডালরা নিদ্রিত হইলে বিশ্বামিত্র সেই চণ্ডালের গৃহে প্রবেশ করিলে চণ্ডাল জাগরিত হইয়া কহিল, কে তুমি মাংস চুরি করিতেছ? তোমাকে আমি হত্যা করিবো।

বিশ্বামিত্র উদ্বিগ্ন হইয়া বলিলেন, আমি বিশ্বামিত্র, ক্ষুধায় মৃতপ্রায় হইয়া তোমার গৃহে কুকুরের মাংস চুরি করিতে আসিয়াছি। আমার বেদজ্ঞান লুপ্ত হইয়াছে, আমি খাদ্যাখাদ্য বিচারে অক্ষম, অধর্ম জানিয়াও আমি চুরি করিতেছি। অগ্নি যেরূপ সর্বভূক, আমিও এখন সেইরূপ সর্বভূক।

চণ্ডাল সসম্ভ্রমে শয্যাত্যাগ করিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া বলিল, মহর্ষি, এমন কর্ম করিবেন না যাহাতে আপনার ধর্মহানি হয়। পণ্ডিতদের মতে সারমেয় শিয়ালেরও অধম, আবার তাহার পশ্চাদ্দেশের মাংস অন্য অঙ্গের মাংসাপেক্ষা অপবিত্র। আপনি ধার্মিকগণের অগ্রগণ্য, প্রাণরক্ষার নিমিত্ত অন্য উপায় অবলম্বন করুন। বিশ্বামিত্র বলিলেন, আমার অন্য কোনো উপায় নেই। প্রাণরক্ষার নিমিত্ত যে কোনও উপায় সঠিক, ক্ষুধা নিবৃত্ত করিয়া সবল হইয়া ধর্মাচরণ করিলেই পাপস্খালন হইবে। বেদরূপ অগ্নি আমার শক্তি, তাহারই প্রভাবে আমি অভক্ষ্য মাংসভোজনে ক্ষুধাশান্তি করিবো। চণ্ডাল বলিল, সারমেয়র মাংস ভোজনে আয়ুবৃদ্ধি হয় না, প্রাণ তৃপ্ত হয় না, অতএব আপনি অন্য খাদ্য সংগ্রহের উপায় করুন অথবা ক্ষুধা দমন করিয়া ধর্মরক্ষা করুন।

বিশ্বামিত্র কহিলেন, অসহনীয় ক্ষুধায় আমার নিকট হরিণের মাংস আর সারমেয়র মাংস সমান। আমার প্রাণসংশয় হইয়াছে, অসৎ কার্য করিলেও আমি চণ্ডাল হইবো না। চণ্ডাল বলিল, ব্রাহ্মণ কুকর্ম করিলে ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয় বলিয়া আমি আপনাকে নিবারণ করিতেছি। নীচ চণ্ডালের গৃহ হইতে সারমেয়র মাংস চুরি করিলে আপনার চরিত্র দূষিত হইবে, আপনাকে অনুতাপ করিতে হইবে।

বিশ্বামিত্র চণ্ডালের কোনও আপত্তি গ্রাহ্য না করিয়া মাংস লইয়া বনে প্রত্যাবর্তন করিলেন। অনন্তর, দেবগণকে নিবেদনপূর্বক সপরিবারে মাংস ভোজন করিবেন এইরূপ ভাবিয়া বিশ্বামিত্র যথাবিধি অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিয়া আনীত সারমেয়মাংস রন্ধন করিয়া দেবগণ ও পিতৃগণকে আহ্বান করিলে দেবরাজ ইন্দ্র প্রচুর বারিবর্ষণ করিয়া ঔষধি ও প্রজাগণকে সঞ্জীবিত করিলেন। ইহাতে বিশ্বামিত্রের পাপ নষ্ট হইলো এবং তিনি পরমগতি লাভ করিলেন।

 

ভীষ্ম বর্ণিত শাস্ত্রানুসারে বিবাহভেদ, কন্যার অধিকার, বর্ণসংকর ও পুত্রভেদঃ

যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করিলেন, পিতামহ, কিরূপ পাত্রে কন্যাদান করা কর্তব্য? ভীষ্ম বললেন, স্বভাব চরিত্র বিদ্যা কুল ও কর্ম দেখিয়া গুণবান পাত্রে কন্যাদান করা সমিচীন। এমন বিবাহের নাম ব্রাহ্মবিবাহ, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে এইরূপ বিবাহই প্রশস্ত। বর ও কন্যার পরস্পরের প্রতি প্রণয়জনিত বিবাহকে গান্ধর্ব বিবাহ বলা হয়। ধন দ্বারা কন্যা ক্রয় করিয়া যে বিবাহ হয় তাহার নাম আসুর বিবাহ। আত্মীয়বর্গকে হত্যা  করিয়া ক্রন্দনরতা কন্যার সহিত বিবাহের নাম রাক্ষস বিবাহ। শেষোক্ত দুই বিবাহ নিন্দনীয়। ব্রাহ্মণাদি প্রত্যেক বর্ণের পুরুষ তাহার সবর্ণের বা নিম্নবর্ণের কন্যাকে বিবাহ করিতে পারে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সমবর্ণা পত্নীই শ্রেষ্ঠ। ত্রিশ বৎসরের পাত্র দশ বৎসরের কন্যাকে এবং একুশ বৎসরের পাত্র সাত বৎসরের কন্যাকে বিবাহ করিবে। ঋতুমতী হইলে কন্যা তিন বৎসর অপেক্ষা করিবার পর স্বয়ং পতি বরণ করিবে। কেবলমাত্র বাগদান করিলে বা পণ গ্রহণ করিলে বিবাহ সম্পন্ন হয় না, মন্ত্রপাঠ ও হোম করিয়া কন্যা সম্প্রদান করিলেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। সপ্তপদী গমনের পর পাণিগ্রহণ মন্ত্র সম্পূর্ণ হয়।

যুধিষ্ঠির পুনরায় ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কন্যা থাকিলে অপুত্রক ব্যক্তির ধন অন্য কেহ পাইতে পারে কি? ভীষ্ম কহিলেন, কন্যা পুত্রের সমান, তাহার পৈতৃক ধনে অন্য কেহ অধিকারী হইবে না। পুত্র থাকিলেও মাতার যৌতুক ধনে কেবলমাত্র কন্যার অধিকার। অপুত্রক ব্যক্তির দৌহিত্রও পুত্রের সমান অধিকারী।

যুধিষ্ঠির কহিলেন, আপনি বর্ণসংকরের উৎপত্তি ও কর্মের বিষয়ে বলুন। ভীষ্ম কহিলেন, পিতা ব্রাহ্মণ আর মাতা ব্রাহ্মণকন্যা হইলে পুত্র ব্রাহ্মণ, মাতা ক্ষত্রিয়কন্যা হইলে পুত্র মূর্ধাভিষিক্ত, মাতা বৈশ্যকন্যা হইলে পুত্র অম্বষ্ঠ এবং মাতা শূদ্রকন্যা হইলে পুত্র পারশব নামে পরিচিত হয়। পিতা ক্ষত্রিয় আর মাতা ক্ষত্রিয়কন্যা হইলে পুত্র ক্ষত্রিয়, মাতা বৈশ্যকন্যা হইলে পুত্র মাহিষ্য এবং মাতা শূদ্রকন্যা হইলে পুত্র উগ্র নামে পরিচিত হয়। পিতা বৈশ্য আর মাতা বৈশ্যকন্যা হইলে পুত্র বৈশ্য এবং মাতা শূদ্রকন্যা হইলে পুত্রকে করণ নামে পরিচিত হয়। শূদ্র ও শূদ্রার পুত্র শূদ্রই হয়।

নিম্নবর্ণের পিতা ও উচ্চবর্ণের মাতার সন্তান নিন্দনীয় হয়। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণীর পুত্র সূত, তাহাদের কর্ম রাজাদের স্তুতিপাঠ। বৈশ্য ও ব্রাহ্মণীর পুত্র বৈদেহক বা মৌল্য, তাহাদের কর্ম অন্তঃপুর রক্ষণ, তাহাদের উপনয়নাদি সংস্কার নাই। শূদ্র ও ব্রাহ্মণীর পুত্র চণ্ডাল, তাহারা কুলের কলঙ্ক, গ্রামের বহির্দেশে বাস করে এবং ঘাতকের কর্ম করে। বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়ার পুত্র বাক্যজীবী বন্দী বা মাগধ। শূদ্র ও ক্ষত্রিয়ার পুত্র মৎসজীবী নিষাদ। শূদ্র ও বৈশ্যার পুত্র সূত্রধর। শাস্ত্রে কেবলমাত্র চতুর্বর্ণের ধর্ম নির্দিষ্ট আছে, বর্ণসংকর জাতির ধর্মের কোনো বিধান নাই, তাহারা সংখ্যায়ও অত্যধিক।

পরিশেষে ভীষ্ম কহিলেন, ঔরসজাত পুত্র আত্মস্বরূপ। পতির অনুমতিতে অন্যের দ্বারা উৎপন্ন সন্তানের নাম নিরুক্তজ, বিনা অনুমতিতে সন্তান হইলে তাহার নাম প্রসূতিজ। বিনামূল্যে প্রাপ্ত অপরের পুত্র দত্তকপুত্র, মূল্য দ্বারা প্রাপ্ত পুত্রকে কৃতকপুত্র বলে। গর্ভবতী কন্যার বিবাহের পর যে পুত্রের জন্ম হয় তাহার নাম অধ্যোঢ়। কুমারী কন্যার পুত্র কানীন বলিয়া পরিচিত হয়।

________