Who is the Offender in Bengali Detective stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | অপরাধী কে?

Featured Books
  • स्वयंवधू - 31

    विनाशकारी जन्मदिन भाग 4दाहिने हाथ ज़ंजीर ने वो काली तरल महाश...

  • प्रेम और युद्ध - 5

    अध्याय 5: आर्या और अर्जुन की यात्रा में एक नए मोड़ की शुरुआत...

  • Krick और Nakchadi - 2

    " कहानी मे अब क्रिक और नकचडी की दोस्ती प्रेम मे बदल गई थी। क...

  • Devil I Hate You - 21

    जिसे सून मिहींर,,,,,,,,रूही को ऊपर से नीचे देखते हुए,,,,,अपन...

  • शोहरत का घमंड - 102

    अपनी मॉम की बाते सुन कर आर्यन को बहुत ही गुस्सा आता है और वो...

Categories
Share

অপরাধী কে?

অপরাধী কে?

এক নারকীয় ধর্ষণ ও খুনের তদন্ত, বিচার ও কিছু প্রশ্ন

 

 

 

অবতরণিকা

 

শত অপরাধী মুক্তি পেলেও একজনও নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন সাজা না পায় - এই আপাত মানবিক ও শ্রূতিমধুর বাক্যটি প্রায় সর্বজনবিদিত।

আমরা হয়তো অনেকেই কিছু কিছু অপরাধের ঘটনা জানি অথবা জানি না যে অনেক ঘটনার ক্ষেত্রেই অপরাধ করেও শুধুমাত্র উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে অথবা তদন্তে গাফিলতির কারণে অপরাধী নির্দোষী ঘোষিত হয় আবার ক্ষেত্রবিশেষে মামালা এমন নিরন্ধ্রভাবে সাজানো হয় যে নিরাপরাধ ব্যক্তি দণ্ডিত হয়।

একটি নারকীয় ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাবলি আমার মনে কিছু সন্দেহ ও প্রশ্নের জন্ম দেয়, যার ফলশ্রূতি বিশ্লেষণধর্মী কাহিনীর আকারে এখানে আমার উপস্থাপনা। আমি আশা করি আমার এই বিশ্লেষণধর্মী কাহিনী পাঠক/পাঠিকাদের মনেও কিছু প্রশ্নের জন্ম দেবে, যার উত্তর আমার অজানা।

অশোক ঘোষ

 

 

প্রথম অধ্যায়

মহানগর থেকে বহুদূরে এক প্রত্যন্ত জনবিরল গ্রাম। যে গ্রামের মাঝখানে সুবিশাল জায়গা জুড়ে চতুর্দিকে সুঊচ্চ প্রাচীর পরিবেষ্টিত প্রাসোদপম এক বিলাসবহুল বাংলো। বাংলোর ভিতরে রয়েছে অনেকগুলি সুসজ্জিত কক্ষ এবং আরাম-বিলাসের সমস্ত রকমের উপকরণ ও অত্যাধুনিক বন্দোবস্ত। ওই বাংলোর চতুর্দিকে  বহুদূর পর্যন্ত কোনো জনবসতি নেই। বাংলোটির মালিক সুদীপ বোস মহানগরেই থাকেন এবং তিনি একজন নামকরা ও অত্যন্ত প্রভাবশালী চিকিৎসক ও একটি নামী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। সাধারণতঃ সপ্তাহান্তে  বা পক্ষান্তে তিনি কখনো সপরিবারে কখনো বা কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাংলোটিতে এসে দু’একদিন কাটিয়ে মহানগরে ফিরে যান। ঐ বাংলোটির নিয়মিত  রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য নিয়ুক্ত রয়েছে একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও চৌকশ কর্মচারী। বাংলোর দেখাশোনা করা ছাড়াও যখন মালিক আসেন তখন ওই কর্মচারীটির কাজ তাঁর খিদমত করা। মালিকের অনুমতি  ছাড়া বাংলোটিতে কারোর প্রবেশাধিকার নেই।

ডাক্তার বোস শুধুমাত্র ওই বাংলোটিরই মালিক নন, বিভিন্ন জায়গায় তাঁর স্বনামে ও বেনামে বেশ কয়েকটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এক অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সুদীপ ছোটোবেলা থেকেই ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও মেধাবী। প্রখর বুদ্ধি ও মেধার অধিকারী সুদীপ প্রতিটা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে ডাক্তারীর প্রাথমিক ও উচ্চতর পরীক্ষাতেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। তারপর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে যোগদান করার কয়েক বছরের মধ্যেই একটি নামী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের পদে নিয়োজিত হন। তাঁর উল্কাসদৃশ পদোন্নতির পথ একেবারেই মসৃণ ছিলোনা বরং ছিলো কণ্টকাকীর্ণ। কিন্তু, প্রখর বুদ্ধিমান সুদীপ অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী বেশ কিছু ব্যক্তিত্বের, যেমন উচ্চপদস্থ পুলিশ, আমলা, রাজনৈতিক নেতা, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদির সক্রিয় সহযোগিতায় এক দুর্ভেদ্য জাল রচনা করে তাঁর যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক করে নানাবিধ উপায়ে অগাধ ধন-সম্পদের অধিকারী হয়েছেন। রাজ্যের সমস্ত মেডিকেল কলেজে সুদীপ বোস ও তাঁর সহযোগিদের রচিত জাল এমনভাবে বিস্তৃত ছিলো যে অনেকেই সেই জাল ছিঁড়ে ফেলার বারংবার চেষ্টা করেও সফলকাম হোতে পারেনি।

সুদীপ বোস ও তাঁর সহযোগিদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের নানাবিধ অভিযোগের মধ্যে অন্যতম ছিলো বিভিন্ন ওষুধ, চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় নানা সরঞ্জাম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি সরবরাহকারীদের থেকে ঘুষ নেওয়া, অনৈতিকভাবে হাসপাতালের বায়ো-মেডিকেল বর্জ্যের সঙ্গে নানা ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী বিক্রি করে ক্রেতাদের থেকে কাটমানি নেওয়া, দাবিহীন মৃতদেহ বিক্রি করা, মৃত শরীর থেকে ব্যবহারযোগ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে নিয়ে বহুমূল্যে বিক্রি করা, বহু ছাত্র-ছাত্রীকে পরীক্ষাতে অকৃতকার্য করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ। তবে ওই সমস্ত ভয়ঙ্কর অভিযোগ ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে করা সত্ত্বেও সুদীপ বোস ও তাঁর সহযোগিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। 

-----------------------

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

অনামিকা দেববর্মন – এক উজ্জ্বল প্রতিভা, দৃঢ়চেতা, অনমনীয় মনোভাব ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং কোনোরূপ চাপের কাছে নতি স্বীকার না করা একজন চিকিৎসক। এক নিম্নবিত্ত পরিবারে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান অনামিকা ছোটোবেলা থেকে অত্যন্ত মেধাবী। আর্থিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মেধা ও অধ্যাবসায়ের জোরে বিভিন্ন পরীক্ষায় অনামিকা বরাবর কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে এম.বি.বি.এস. ডিগ্রী অর্জন করবার পর সুদীপ বোস যে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ সেই মেডিকেল কলেজে অনামিকা একাধারে ডাক্তারীর স্নকোত্তর পরীক্ষার্থিনী হিসাবে পড়াশোনা ও রোগীর চিকিৎসাকার্যে নিয়োজিত ছিলো। সুদীপ বোস ও তার তাঁবেদার সহযোগিদের নানা অনৈতিক কাজকর্ম সম্পর্কে কানাঘুষায় বেশ কিছু কথা অনামিকা শুনেছিল, তবে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। কিন্তু বিশ্বাস করে উঠতে না পারলেও অনামিকার মন খানিকটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল।

অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই করে সন্দেহ নিরসনের উদ্দেশ্যে অনামিকা তার পড়াশোনা ও কাজের ফাঁকে সুদীপ বোস ও তাঁর তাঁবেদারদের নজর এড়িয়ে গোপনে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলো। খোঁজ-খবর নেওয়ার উদ্দেশ্যে অনামিকা মাঝে মাঝে অধ্যক্ষের ঘরের পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া শুরু করলো আর লক্ষ্য করতে থাকলো অধ্যক্ষের কাছে হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিরা ছাড়াও কি ধরণের লোকজন আসে। কিছুদিন এইভাবে লক্ষ্য রাখার পর অনামিকা বুঝতে পারলো যে সুদীপ বোস ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি ভয়ঙ্করভাবে সত্য। এভাবেই একদিন অধ্যক্ষের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনামিকার কানে হঠাৎ ভেসে এলো অপরিচিত কেউ একজন অধ্যক্ষকে বলছে “বি পজিটিভ কিডনি”।

কথাটা শোনামাত্র অনামিকা থমকে দাঁড়িয়ে গেলো এবং আরো ভালোভাবে শোনার জন্য একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে পরিস্কারভাবে শুনতে পেলো অধ্যক্ষের সামনে বসা লোকটা বলছে “আগামী ১০ দিনের মধ্যে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে, পার্টি বেশ মালদার, প্রচুর টাকা দেবে”। জবাবে অধ্যক্ষ লোকটিকে বললো “এসব তো রেডিমেড পাওয়া যায় না, তবে, প্রত্যেকদিন তো এই হাসপাতালে বেশ কয়েকটা করে টেঁসে যায় তাই আশা করছি দরকারি কিডনিটা কোনো না কোনো একটার থেকে পাওয়া যাবে, শুধু টেঁসে যাওয়ার পর কিডনিটা বডি থেকে খুবলে নিলেই কাজ হয়ে যাবে, আর, টেঁসে যাওয়ার পর বডিটা তো ভালো করে কাপড় দিয়ে প্যাক করে দেওয়া হবে তাই বাড়ির লোক কিছুই বুঝতে পারবে না, সিধা শ্মশান আর বডি পুড়ে ছাই”। এই পর্যন্ত শোনার পর আগুপিছু না ভেবেই দরজা ঠেলে অনামিকা অধ্যক্ষের ঘরে ঢুকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে বসল “স্যার, এসব আপনি কি বলছেন”? প্রশ্ন শুনেই বেশ কঠিন স্বরে অধ্যক্ষ বললেন “কোন সাহসে তুমি বিনা অনুমতিতে আমার ঘরে ঢুকেছো”? অনামিকা কিছু বলার চেষ্টা করতেই অধ্যক্ষ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন “তুমি ঠিক এক ঘণ্টা পরে আমার সাথে দেখা করবে, এখন বেরিয়ে যাও”।

ঠিক এক ঘণ্টা পরে অধ্যক্ষের ঘরের দরজায় নক্ কোরে অনামিকা ভিতরে ঢুকতেই অধ্যক্ষ বললেন দরজা বন্ধ কোরে দিয়ে এসে বসো। অনামিকা বসার পর অধ্যক্ষ বললো, বলো কি বলতে চাও। অনামিকা একটু অস্থিরভাবে বলে উঠলো এতদিন কানাঘুষায় যা শুনেছিলাম, বিশ্বাস করতে পারিনি, কিন্তু আজ নিজে যা দেখলাম আর আপনাকে বলতে শুনলাম, তাতে আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছি। আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি আপনি টাকার জন্য এতটা অনৈতিক ও জঘন্য কাজ করতে পারেন। অনামিকা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে অধ্যক্ষ শীতল কণ্ঠস্বরে বললেন – “তুমি যা দেখেছো ও শুনেছো তা বহুকাল ধরে চলে আসছে। আমার আগে যারা ছিলো তারাও এগুলি করতো আর আমার পরে যারা আসবে তারাও করবে। একটা মৃতদেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার আগে তার শরীরের অংশবিশেষ দিয়ে যদি কোনো মরণোন্মুখ ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে তোলা যায় আর এটা করে যদি কিছু টাকা কামিয়ে নেওয়া যায়, আমরা মনে করিনা তাতে কোনো অন্যায় হয়, বরং পূণ্য হয়। তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনেক টাকা কামাতে পারো। আর যদি হাত মেলাতে না চাও, তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে নিজের বিপদ ডেকে আনবে না আশা করি। আর কোনো কথা হবে না, তুমি এখন যেতে পারো। আর হ্যাঁ, তুমি এই ব্যাপারে কিছু করার চেষ্টা করলে আমি জানতে পারবো, আমার নজর কিন্তু সর্বত্র”।

কথা না বাড়িয়ে অনামিকা অধ্যক্ষের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, ওই সমস্ত অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে যতদূর যেতে হয় যাবে এবং এর শেষ দেখে ছাড়বে, ভয় পেয়ে দমে যাবে না। 

অধ্যক্ষের ঘর থেকে বেরিয়ে অনামিকা সিদ্ধান্ত নিলো যে ওই সব অনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ করতে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজনীয় আইনগ্রাহ্য প্রমাণ যোগাড় করতে হবে। কিন্তু, একার পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রমাণ কিভাবে যোগাড় করা সম্ভব হবে ভাবতে ভাবতে অনামিকা সিদ্ধান্ত নিলো যে সে তার কিছু ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত সহকর্মীর সাহায্য নেবে। সেদিন অনামিকা সারাক্ষণ চুপচাপ শুধু ভেবে গেলো, রাতে ভালোভাবে ঘুমাতেও পারলো না। পরের দিন অনামিকা তার চারজন অত্যন্ত প্রিয় জুনিয়র চিকিৎসক সহকর্মীর, যাদেরকে অনামিকা যথেষ্ট ভরসা করতো, তাদের সাথে খুব গোপনে অধ্যক্ষ ও তাঁর সহযোগিদের অনৈতিক কাজকর্মের ব্যাপারে নিজে যা দেখেছে ও অধ্যক্ষের কাছ থেকে শুনেছে সে সমস্ত বললো। তারপর অনামিকা কিভাবে অধ্যক্ষ ও তাঁর সহযোগিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করতে হবে সেই ব্যাপারে তার সহকর্মীদের সঙ্গে বিশদে আলোচনা কোরে পরবর্তী পদক্ষেপের রূপরেখা ঠিক কোরে নিলো।

-----------------------

তৃতীয় অধ্যায়

মহানগরের উপান্তে মরুভূমিতে মরুদ্যানের মতো প্রায় জনবিরল স্থানে সুউচ্চ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আধুনিক শৈলীতে নির্মিত একটি চমৎকার দ্বিতল বাড়ি। প্রায় মাঝরাতে এই বাড়ির ভিতরে একটি বড় হলে খুব কম পাওয়ারের বাল্বের আলো জ্বলছে। হলের মাঝখানে মিটিঙের উপযুক্ত একটি লম্বা দামী টেবিল ঘিরে অনেকগুলি চেয়ার সাজিয়ে

রাখা রয়েছে। টেবিলের পাশে চেয়ারগুলিতে ওই মুহূর্তে সুদীপ বোস, অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য দপ্তরের কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং জুনিয়র ডাক্তার বসে আছে। প্রথমে সুদীপ বোস সবার উদ্দেশ্যে বললেন “এই জরুরী মিটিঙের বিষয় সম্পর্কে আপনারা সবাই জানেন। মেয়েটাকে সাবধানে করেছিলাম, কিন্তু শুনলো না। পথের কাঁটা সরাতে সরাতে কত যত্ন করে আমরা এই চক্র গড়ে গোটা রাজ্য জুড়ে জাল বিছিয়েছি শুধু একটু বাড়তি রোজগারের আশায়। বেচারা অনামিকা! ও জানেই না, যাদের সহযোগিতায় আমাদের এই জাল ছিঁড়ে ফেলতে চায়, তারা আমাদের এই চক্রের বিশ্বস্ত সদস্য। এখন আপনারা বলুন, আমাদের কি করা উচিৎ? আমাদের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হওয়া চাই এবং ঘুণাক্ষরেও কেউ যেন আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানতে না পারে”। কিছুক্ষণ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হোলো পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে হবে এবং এমনভাবে কাজটা করতে হবে যাতে কোনোভাবেই আমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নাথাকে। সুদীপ বোস আবার বললেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা উচ্চমেধা ও প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সুতরাং আমাদের পরিকল্পনা মতো পথের কাঁটা সরাতে কোনো ফাঁকফোকর যাতে না থাকে, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে এবং আগে থেকেই ভেবে রাখতে হবে যে দরকার হোলে আমরা আমাদের কৃপাধন্য কোনো বাইরের ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কিছু প্রমাণ সৃষ্টি করতে হবে যাতে আইনের জালে সে জড়িয়ে পড়ে। কাজটা জরুরী ভিত্তিতে সারতে হবে। আমাদের মিটিং আপাতত শেষ, আশা করি এই মিটিঙের কথা কাকপক্ষীও জানতে পারবে না। 

 -----------------------

চতুর্থ অধ্যায়

সময়টা মধ্যরাত পেরিয়ে রাত্রিশেষের দিকে এগিয়ে চলেছে। অনামিকার প্রৌঢ় বাবা-মা নিশ্চিন্ত গভীর ঘুমে মগ্ন। অনামিকার বাবার বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। আচমকা ফোনটা বেজে ওঠায় অনামিকার বাবা-মা দুজনেরই ঘুমটা ভেঙে গেলো। ফোনটা রিসিভ করে ঘুমজড়ানো গলায় অনামিকার বাবা জিজ্ঞাসা করলেন – কে বলছেন? ও প্রান্ত থেকে এক মহিলা কন্ঠে জবাব এলো – আমি হাসপাতাল থেকে বলছি, আপনার মেয়ে খুব অসুস্থ, আপনি এক্ষুণি হাসপাতালে চলে আসুন। খুব বিভ্রান্ত হয়ে অনামিকার বাবা উদ্বিগ্ন স্বরে বললো – রাত দশটা নাগাদ মেয়ের সঙ্গে আমার কথা হোলো, তখন তো ও একদম সুস্থ ছিলো, হঠাৎ খুব অসুস্থ কি করে হয়ে গেলো? আবার ও প্রান্ত থেকে জবাব এলো – বলতে পারবো না, আপনার মেয়েকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেছে, আপনারা এখনই হাসপাতালে চলে আসুন, বলেই লাইনটা কেটে দিলো।

ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে অনামিকার বাবা-মা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য যখন তড়িঘড়ি প্রস্তুত হচ্ছেন তখন আবার ফোনটা বেজে উঠলো। অনামিকার বাবা ফোনটা ধরতেই, ও প্রান্ত থেকে সেই একই মহিলা কন্ঠে বললো – আমি হাসপাতাল থেকে বলছি, আপনার মেয়ে সম্ভবতঃ আত্মহত্যা করেছে, আপনারা এখনই হাসপাতালে চলে আসুন, বলেই অনামিকার বাবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইনটা কেটে দিলো।

অনামিকার বাবা-মা ভয়ঙ্কর উদ্বিগ্ন হয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেখলো তাদের অত্যন্ত আদরের একমাত্র মেয়ের নিথর নিষ্প্রাণ শরীরটা একটা বড় হলের মধ্যে হাসপাতালে ব্যবহৃত একটি বেড-এর উপর শায়িত অবস্থায় রয়েছে আর, ওই বেড-এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে একাধিক উচ্চপদস্থ পুলিশ অধিকর্তা, বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও আরও কিছু লোকজন। আদরের একমাত্র মেয়ের এই পরিণতি দেখে অনামিকার বাবা-মা ডুকরে কেঁদে উঠলো আর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশের লোক ও হাসপাতালের কর্মী দ্রুতপায়ে এসে ওনাদেরকে একপাশে বসিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলো।

হাসপাতালে কর্তব্যরত থাকাকালিন অনামিকার মৃত্যুর খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। হাসপাতাল চত্বর ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বহু সংখ্যক সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ, পুলিশ, চিকিৎসক, অনুগামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বহু রোগীদের পরিবারের লোকজনের ভিড়ে থিকথিক করছে। চিকিৎকরা ইতিপূর্বে অনামিকাকে মৃত ঘোষণা করায় স্থানীয় থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা হিসাবে একটি অভিযোগ নিবন্ধিত করা হয়েছে। বাইরে প্রচণ্ড শোরগোল হোচ্ছে। এদিকে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে সারাক্ষণ অনামিকার মৃত্যুর খবর ব্রেকিং নিউজ হিসাবে প্রচার করে চলেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বেড়েই চলেছে। অনামিকার মৃত্যু সম্পর্কে বিক্ষিপ্তভাবে নানা জনে নানা মন্তব্য করছে। এরই মাঝে বেশ কিছু ডাক্তারি পড়ুয়া স্লোগানসহ দাবি করতে থাকলো আজকে এবং এই হাসপাতালেই একজন প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অনামিকার মৃতদেহের ময়না তদন্ত করতে হবে এবং সমস্ত প্রক্রিয়াটার ভিডিওগ্রাফী করতে হবে, আর ময়না তদন্তের সময় জুনিয়র ডাক্তারদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে থাকতে দিতে হবে। ডাক্তারি পড়ুয়াদের দাবির সপক্ষে উপস্থিত জনতা ও রাজনৈতিক নেতারাও লাগাতার স্লোগান দিতে থাকলো।

ইতিমধ্যে অনামিকার শবদেহ পর্যবেক্ষণ করে এবং ঘটনাস্থলে একটি ছেঁড়া ইয়ারপিস ও সি.সি.টিভি-র ফুটেজ দেখে ধনঞ্জয় সিং নামে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলো। তারপর ডাক্তারি পড়ুয়াদের দাবি মেনে নিয়ে একজন প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ার পর অনামিকার মৃতদেহের ময়না তদন্ত করা হোলো এবং সমস্ত প্রক্রিয়াটার ভিডিওগ্রাফীও করা হোলো। ময়না তদন্তের পরে জানা গেলো যে অনামিকা ধর্ষিতা ও খুন হয়েছে। তার শরীরের নানা স্থানে অনেকগুলি ক্ষত এবং আঘাতের চিহ্ন, যেগুলি বলপ্রয়োগ, আঁচড়ানো ও কামড়ানোর ফলে হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, অনামিকার গোপনাঙ্গে জোর করে পেনিট্রেশানের চিহ্ন, মুখের লালা জাতীয় কিছু লেগে আছে অনামিকার বুকে ও গালে, একটা চোখ দিয়ে রক্তক্ষরণের দাগ, অন্য ব্যক্তির কয়েকটি যৌনরোম অনামিকার গোপনাঙ্গের পাশে  আলতোভাবে লেগে আছে, গোপনাঙ্গ থেকে ঘন সাদাটে তরল নিঃসৃত হয়েছে এবং অনামিকার নখের মধ্যে অন্য ব্যক্তির চামড়ার ছোট্ট টুকরো লেগে আছে। অনামিকার শরীর থেকে ওই সমস্ত বস্তুগুলি সংগ্রহ করা হোলো সেন্ট্রাল ল্যাবোরেটরীতে ফরেন্সিক টেস্ট করাবার জন্য। ময়না তদন্ত সম্পূর্ণ হওয়ার পর আইনসম্মতভাবে রিপোর্ট লেখা হোলো এবং ময়না তদন্ত ও রিপোর্ট সঠিকভাবে করা হয়েছে বলে উপস্থিত সবাই সাক্ষী হিসাবে ওই রিপোর্টে স্বাক্ষর করলেন। এরপর ময়না তদন্তের রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট থানায় পুলিশের কাছে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে অভিযোগপত্র দাখিল করা হোলো।  ময়না তদন্তের শেষে অনামিকার মৃতদেহ পুলিশ অনামিকার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ রাখার পরে স্থানীয় বিধায়কের সক্রিয় ব্যবস্থাপনায় নিকটস্থ শ্মশানে দাহ করে দিলো।

সি.সি.টিভি-র ফুটেজে ঘটনাস্থলে মধ্যরাতে ধনঞ্জয়ের যাওয়া-আসার রেকর্ড এবং ঘটনাস্থলে যে ছেঁড়া ইয়ারপিস পাওয়া গিয়েছিলো সেটা ধনঞ্জয় সিং-এর সনাক্ত করার অন্যতম প্রমাণ হিসাবে পাওয়ার পর পুলিশ ধনঞ্জয় সিংকে গ্রেফতার করে। ধনঞ্জয় সিং স্বেচ্ছাসেবক পুলিশে কর্মরত ছিলো এবং পুলিশের কিছু পদস্থ অফিসারদের নেকনজরে থাকার সুবাদে বেআইনিভাবে পুলিশ ব্যারাকে থাকা, তোলাবাজি করা, পুলিশের মোটরবাইক নিয়ে যথেচ্ছ দাপিয়ে বেড়ানো ছাড়াও মাদকাসক্ত ছিলো বলে জানা গেছে।

ধনঞ্জয়কে গ্রেফতারের পর দেখা গেলো তার শরীরে কয়েকটি ক্ষতচিহ্ন যেগুলি নখের আঁচড়ে হয়েছে বলে মনে হয়, এ ছাড়াও ধনঞ্জয়ের নখের মধ্যে মানুষের চামড়ার ছোট্ট টুকরো পাওয়া গেলো যেটা পুলিশ বাজেয়াপ্ত করলো। ধনঞ্জয় সিংকে গ্রেফতার করার পরে ও ময়না তদন্ত সম্পন্ন হবার পর, পুলিশের একটা দল ধনঞ্জয়ের আস্তানায় গিয়ে সেখান থেকে সি.সি.টিভি-র ফুটেজে দেখা ধনঞ্জয়ের পোশাক বাজেয়াপ্ত করলো। ঘটনাস্থল থেকে বাজেয়াপ্ত করা সমস্ত সামগ্রী, ধনঞ্জয়ের পোশাক, নখের মধ্যে পাওয়া চামড়ার টুকরো ইত্যাদি সবকিছু অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের তদন্তকারী পুলিশ অফিসার পরের দিন ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য সেন্ট্রাল ল্যাবোরেটরীতে পাঠিয়ে দিলো। সেন্ট্রাল ল্যাবোরেটরী থেকে ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট আসার পর দেখা গেলো ঘটনাস্থলে অনামিকার মৃতদেহ থেকে বাজেয়াপ্ত করা সামগ্রী এবং ধনঞ্জয়ের পরিহিত প্যান্টে লেগে থাকা বীর্যের নমুনা ইত্যাদি সবকিছু ধনঞ্জয়ের বলেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

 পঞ্চম অধ্যায়

এদিকে অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা রাজ্য জুড়ে এক ভয়ঙ্কর অরাজকতার পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গেলো। রাজ্যের বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল ঘোলা জলে মাছ ধরতে পথে নেমে পড়লো। পথ-ঘাট, হাট-বাজার, গণ পরিবহণ, বৈদ্যুতিন সামাজিক মাধ্যম সর্বত্র নানা জনে নানা রকম মন্তব্য করতে থাকলো। কেউ বললো এটি গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনা, কেউ বললো অধ্যক্ষ স্বয়ং পুলিশের সঙ্গে যোগ-সাজশে বহু তথ্য-প্রমাণ লোপাট করেছে যার মধ্যে অন্যতম অনামিকার মরদেহ সংরক্ষণ না করে দ্রুত দাহ করা, কেউ কেউ আবার পুলিশের বদলে সি.বি.আই.-কে দিয়ে তদন্তের দাবিতে সোচ্চার হোলো। জুনিয়র ডাক্তাররা লাগাতার কর্মবিরতি ঘোষণা করে অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের বিচারের দাবিতে এবং ওই হাসপাতালের অধ্যক্ষের, কিছু পুলিশ ও স্বাস্থ্য আধিকারিকের অপসারণ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহ আরো অনেকগুলি দাবি পূরণের জন্য মিটিং, মিছিল, অবস্থান ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে প্রবল জনসমর্থন তৈরী করে ফেললো। অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের দ্রুত বিচারের দাবিতে সমাজের নানা স্তরের মানুষ আলাদা ভাবে মহানগরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন মিটিং, মিছিল করতে থাকলো। শুধু তাই নয়, অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সারা দেশ জুড়ে এবং বিশ্বের নানা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ প্রবল প্রতিবাদে মূখর হয়ে উঠলো। এরই মাঝে পুলিশের তদন্তে অনাস্থা জানিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে সি.বি.আই.-কে দিয়ে তদন্তের দাবিতে মামলা করায়, উচ্চ আদালত সি.বি.আই.-কে দিয়ে তদন্তের আদেশ দিয়ে পুলিশকে নির্দেশ দিলেন অনামিকার ধর্ষণ ও খুন সংক্রান্ত মামলার সমস্ত নথিপত্র সি.বি.আই.-কে হস্তান্তর করার জন্য। উচ্চ আদালতের নির্দেশ পেয়ে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার সি.বি.আই.-কে অনামিকার ধর্ষণ ও খুন সংক্রান্ত মামলার সমস্ত নথিপত্র হস্তান্তর করে দিলো। অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় করে দেশের উচ্চতম আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করে সি.বি.আই.-কে তদন্তের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কিছু নির্দেশ দিয়ে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে নির্ধারিত সময়ে আদালতে রিপোর্ট পেশ করার আদেশ দিলেন এবং বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে যথোপযুক্ত নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন উন্নতি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দিলেন। 

-----------------------

 

ষষ্ঠ অধ্যায়

উচ্চ আদালতের নির্দেশ পেয়ে সি.বি.আই. অনামিকার ধর্ষণ ও খুন সংক্রান্ত মামলার তদন্ত শুরু করে দিলো। তদন্ত প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসাবে সি.বি.আই. প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করার জন্য বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির এবং অনামিকার বাবা-মায়ের বয়ান নথিবদ্ধ করা, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করা, পুলিশ কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা সবকিছু আরো দুটি ল্যাবোরেটরী থেকে পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করার মতো কাজ সেরে ফেললো। যদিও দ্বিতীয়বার ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট আগেকার ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্টের থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না। ইতিমধ্যে অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকা, তথ্য-প্রমাণ লোপাটের এবং অবৈধ টাকা-পয়সা লেনদেনের অভিযোগে অধ্যক্ষ সুদীপ বোস ও নিকটবর্তী থানার অফিসার-ইন-চার্জকে বেশ কয়েকদিন লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদ করার পর গ্রেফতার করলো।

পলিগ্রাফ টেস্টের মাধ্যমে ধনঞ্জয়ের স্বীকারোক্তি আদায়ের উদ্দেশ্যে সি.বি.আই.-এর দরখাস্তের পরিপ্রক্ষিতে আদালত অনুমতি দেওয়া সত্বেও পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। ধৃত অধ্যক্ষ, থানার অফিসার-ইন-চার্জ এবং ধনঞ্জয়ের নার্কো টেস্ট করার জন্য অনুমতি চেয়ে সি.বি.আই. আদালতের কাছে দরখাস্ত করে কিন্তু ধৃত অধ্যক্ষ, অফিসার-ইন-চার্জ এবং ধনঞ্জয় নার্কো টেস্ট দিতে অস্বীকার করায় আইনি বাধা থাকার কারণে আদালতের বিচারক সি.বি.আই.-এর দরখাস্ত নামঞ্জুর করে দিলেন।

পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া অনামিকার ধর্ষণ ও খুন সংক্রান্ত নথিপত্র, সি.সি.টিভি-র ফুটেজ ও পরবর্তী তদন্তের ভিত্তিতে নির্ধারিত সময়ের কয়েকদিন আগেই ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে সি.বি.আই. আদালতে অন্তর্বর্তী চার্জশীট জমা করে দিলো। চার্জশীট জমা করার কয়েক দিন পর ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দায়রা আদালতের বিচারক পরবর্তী দিন ধার্য করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন।

ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অনামিকাকে ধর্ষণ ও খুন করার অভিযোগে চার্জ গঠন করার কয়েকদিন পরে ওই ঘটনায় ধৃত অধ্যক্ষ সুদীপ বোস এবং ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী থানার অফিসার-ইন-চার্জের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ও প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সি.বি.আই. আদালতে চার্জশীট জমা দিলো।

-----------------------

 সপ্তম অধ্যায়

আদালত নির্ধারিত দিনে অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শুরু হোলো। মামলাটি অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ার কারণে বিচারক এবং উভয় পক্ষের উকিল, আসামি, সাক্ষী ও আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ছাড়া অন্য কারোর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে আদালতকক্ষের দরজা বন্ধ করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হোলো। আদালতকক্ষের বাইরে উৎসুক জনতা ও সাংবাদিকদের ভিড়ে থিকথিক করছে।

সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম দিনে প্রথম সাক্ষী হিসাবে অনামিকার বাবাকে ফোন করে যিনি অনামিকার মৃত্যুর খবর দিয়েছিলেন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি অনামিকার বাবাকে ফোন করে প্রথমবার জানিয়েছিলেন যে “আপনার মেয়ে খুব অসুস্থ, ওকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেছে, আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন”, ঠিক কি না?

প্রথম সাক্ষী       : হ্যাঁ বলেছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : একটু পরেই আপনি অনামিকার বাবাকে আবার ফোন করে জানিয়েছিলেন যে “আপনার মেয়ে বোধ হয় আত্মহত্যা করেছে, আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন”, ঠিক কি না?

প্রথম সাক্ষী       : হ্যাঁ বলেছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : তাহলে, প্রথমে আপনি অনামিকার বাবাকে ভুল খবর দিয়েছিলেন কেন?

প্রথম সাক্ষী       : আমাকে হাসপাতাল থেকে কেউ একজন ইন্টারকমে বলেছিলো অনামিকার বাবাকে ওই খবরটা দেওয়ার জন্য। কিন্তু, যে বলেছিলো তার নাম আমি জানিনা।

ধনঞ্জয়ের উকিল : তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা গেছে যে অনামিকা ধর্ষিতা ও খুন হয়েছিলো, তাহলে দ্বিতীয়বার ফোন করে আপনি অনামিকা আত্মহত্যা করেছে বলে তার বাবাকে ভুল খবর দিয়েছিলেন কেন?

প্রথম সাক্ষী        : আমাকে আবার ইন্টারকমে বলেছিলো অনামিকার বাবাকে ওই খবরটা দেওয়ার জন্য। কিন্তু, এই ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে সঠিক ঘটনাটা জানতাম না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

প্রথম সাক্ষী       : না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন।

সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু সাক্ষীকে কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

দ্বিতীয় সাক্ষী হিসাবে ঘটনাস্থল হলের কেয়ারটেকারকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও দ্বিতীয় সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : যে সময় হলটার মধ্যে অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে বলে তদন্তে প্রকাশ, আপনি কি ওই সময়ে ডিউটিতে ছিলেন?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : হ্যাঁ, ছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকা ওই হলটার মধ্যে কি জন্য গিয়েছিলো আপনি জানেন কি? 

দ্বিতীয় সাক্ষী     : উনি রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমাকে হলের দরজা খুলে দিতে বলায়, আমি দরজার তালাটা খুলে দিয়ে এসেছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার সঙ্গে আর কেউ এসেছিলো? 

দ্বিতীয় সাক্ষী     : উনি একাই এসেছিলেন।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই হলটার প্রধান দরজা ছাড়া আর কোনো দরজা আছে?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : হ্যাঁ, আছে।

ধনঞ্জয়ের উকিল : হলের সমস্ত দরজা কি সি.সি.টিভি.-র আওতায় আছে?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : না, শুধু প্রধান দরজা সি.সি.টিভি.-র আওতায় আছে।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই হলটা কি প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : ওখানে সাধারণতঃ বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান, সম্মেলন, কোনো বিষয়ের উপর আলোচনা সভা ইত্যাদি হয়ে থাকে। তা ছাড়া, কোনো ডাক্তারের রাতে ডিউটির সময় ফুরসত পেলে ওখানে বিশ্রাম নিতেন।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার মৃতদেহ কে প্রথম দেখতে পায়?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : আমি দেখতে পাই।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি কিভাবে বুঝলেন যে অনামিকা মারা গেছে?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : অনামিকা যে মারা গেছে আমি বুঝতে পারিনি। আসলে, একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পেয়ে আমি ভেজানো দরজাটা খুলে হলের মধ্যে গিয়ে দেখি অনামিকা কেমন অদ্ভুতভাবে শুয়ে আছে। সেখানে আর কাউকে দেখতে পাইনি। আমি ম্যাডাম ম্যাডাম বলে কয়েকবার ডেকেও কোনো সাড়া না পাওয়ায় একটু ভয় বাইরে এসে দেখলাম একজন কম বয়সী ডাক্তারবাবু করিডোরে দিয়ে যাচ্ছেন। ওই ডাক্তারবাবুকে আমি ঘটনাটা বললে, উনি বললেন, ঠিক আছে, আপনি গিয়ে বসুন, আমি দেখছি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : তারপর আপনি কি করলেন?

দ্বিতীয় সাক্ষী     : ডাক্তারবাবুর নির্দেশমতো আমি আমার ডিউটির জায়গায় গিয়ে বসে পড়লাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : যে ডাক্তারবাবুকে আপনি ডেকে নিয়ে গেলেন, তাঁর নাম কি?

দ্বিতীয় সাক্ষী   : আমি জানি না। আসলে, এত বড় হাসপাতাল, সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়ে প্রচুর ডাক্তারবাবু, তাই শুধুমাত্র কিছু বড় ডাক্তারবাবু আর খুব কম সংখ্যক জুনিয়র ডাক্তারবাবুকে চিনি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই হাসপাতালের সব জুনিয়র ডাক্তারবাবুদেরকে যদি আপনার সামনে হাজির করা হয়, আপনি তাদের মধ্য থেকে সেই ডাক্তারবাবুকে চিনতে পারবেন? 

দ্বিতীয় সাক্ষী     : না, আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বলে ওনার মুখটা ভালোভাবে লক্ষ্য করিনি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই হলটার মধ্যে আর কাউকে আপনি ঢুকতে দেখেছিলেন?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই হলের মধ্যে অনামিকা ঢোকার আগে কেউ ঢুকেছিলো কি না আপনি জানেন?

দ্বিতীয় সাক্ষী     :  না, আমি লক্ষ্য করে দেখিনি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি তো ওই হলের কেয়ারটেকার ছিলেন এবং তালাবন্ধ দরজার চাবি আপনার কাছে থাকতো। তাহলে সি.সি.টিভি-র ফুটেজে ধনঞ্জয়ের ওই হলে যাওয়া-আসার দৃশ্য দেখা গেলো অথচ আপনার নজর এড়িয়ে গেলো কিভাবে?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : আমি হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলাম সেই সময়।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনার ডিউটির জায়গা থেকে ওই হলের দূরত্ব কতটা?

দ্বিতীয় সাক্ষী     : পাশেই।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকা যেভাবে ধর্ষিতা ও খুন হয়েছে, তাতে নিশ্চয়ই অনেকটা সময় লেগেছে আর ওই সময় অনামিকা নিশ্চয়ই প্রবল বাধা দেওয়া ছাড়াও সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছিলো, অথচ আপনি কিছুই শুনতে পাননি?

দ্বিতীয় সাক্ষী     : শুনতে পেলে তো আমি দৌড়ে যেতাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি মাননীয় আদালতকে বলুন তো, যদি মাঝরাতে সি.সি.টিভি-র ফুটেজে ধনঞ্জয়ের ওই হলে যাওয়া-আসার দৃশ্য দেখা গেলেও আপনার নজর এড়িয়ে যেতে পারে তাহলে যে সময়ের সি.সি.টিভি-র ফুটেজ মিসিং সেই সময় আরও কেউ তো আপনার নজর এড়িয়ে ওই হলটাতে ঢুকে যেতে পারে?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : আমার মনে হয় না আর কেউ হলটাতে ঢুকেছিলো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনেকে বলছে যে অভিযুক্ত ধনঞ্জয় অবৈধভাবে টাকা নিয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা করতো। যদি তাই হয় তবে এই ধরণের কাজের জন্য ধনঞ্জয়ের তো ওই হলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। তাহলে, মাননীয় আদালতকে বলুন তো, মাঝরাতে ওই হলে অনামিকা একা বিশ্রাম নিচ্ছে, এই খবরটা ধনঞ্জয় কি ভাবে পেলো যদি হাসপাতালের সঙ্গে যু্ক্ত এবং অনামিকার গতিবিধির উপর নজর রাখছে এমন কেউ ধনঞ্জয়কে ডেকে না পাঠায়?

দ্বিতীয় সাক্ষী      : এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আমি বলছি আপনি অনামিকার প্রকৃত ধর্ষক ও খুনীদের চেনেন, কিন্তু কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করে এবং ভয় পেয়ে আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।

দ্বিতীয় সাক্ষী     : আমি মিথ্যা কথা বলিনি। আমি যেটুকু জানি, তাই বলেছি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন। প্রয়োজনে আদালতের অনুমতি নিয়ে আপনাকে আবার সাক্ষী দিতে আসতে হোতে পারে।

দ্বিতীয় সাক্ষীকেও সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

তৃতীয় সাক্ষী হিসাবে ওই হাসপাতালের সি.সি.টিভির. তত্ত্বাবধায়ককে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও তৃতীয় সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : যে হাসপাতালে অনামিকার ধর্ষণ ও খুন হয়েছে বলে অভিযোগ, আপনি ওই হাসপাতালে সি.সি.টিভির. তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন, তাই তো?

তৃতীয় সাক্ষী      : হ্যাঁ।

ধনঞ্জয়ের উকিল : হাসপাতালের কোন কোন জায়গা সি.সি.টিভি.-র আওতায় আছে আপনি জানেন?

তৃতীয় সাক্ষী      : হ্যাঁ জানি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার ধর্ষণ ও খুন হওয়ার সময় ওই হলের বাইরে সি.সি.টিভি.-র ফুটেজ কিছুক্ষণের জন্য মিসিং রয়েছে কি কারণে বলতে পারবেন?

তৃতীয় সাক্ষী      : ওই সময়টায় লিঙ্ক ফেলিওর হয়েছিলো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই সময়টায় হাসপাতালের আর কোনো জায়গায় সি.সি.টিভি.-র লিঙ্ক ফেলিওর হয়েছিলো কি?

তৃতীয় সাক্ষী      : আজ্ঞে না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই হলটার প্রধান প্রবেশপথ সি.সি.টিভি.-র আওতায় থাকলেও হলের অন্য দরজা কি সি.সি.টিভি.-র আওতায় আছে?

তৃতীয় সাক্ষী      : আজ্ঞে না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনার বক্তব্য অনুযায়ী অন্য দরজা দিয়ে কেউ হলের ভিতরে যাতায়াত করে থাকলে সি.সি.টিভি.-র আওতায় আসবে না, তাই তো?

তৃতীয় সাক্ষী      : হ্যাঁ।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন।

তৃতীয় সাক্ষীকেও সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

চতুর্থ সাক্ষী হিসাবে মহানগরের নগরপালকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও চতুর্থ সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি মহানগরের নগরপালের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত ভাবে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদির মতো গুরুতর কোনো অপরাধের তদন্ত করেন কি?

চতুর্থ সাক্ষী       : না। সাধারণতঃ ঘটনাস্থল যে থানার অন্তর্গত সেখানকার যোগ্য অফিসার তদন্ত করেন।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই ধরণের অপরাধের ঘটনা ঘটলে আপনি ব্যক্তিগতভাবে ঘটনাস্থলে হাজির হন কি?

চতুর্থ সাক্ষী       : সাধারণতঃ না। তবে, খুব স্পর্শকাতর ঘটনা হোলে আমাকে যেতে হয় অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য।

ধনঞ্জয়ের উকিল : কার কাছ থেকে অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আপনি সদলবলে ভোরবেলায় পৌঁছে গিয়েছিলেন?

চতুর্থ সাক্ষী       : হাসপাতাল থেকে কেউ একজন ফোন কোরে আমাকে ঘটনার কথা জানায় এবং বলে যে মৃতা ঐ হাসপাতালের একজন ডাক্তার তাই হাসপাতালের মধ্যে ভয়ঙ্কর হাঙ্গামা হোচ্ছে। সেইজন্য ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে আমি ওখানে পৌঁছে যাই।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঘটনাস্থলে পৌঁছে অনামিকাকে কি অবস্থায় দেখতে পেলেন?

চতুর্থ সাক্ষী       : একটি বেডের উপর অবিন্যস্তাবে শায়িত অবস্থায় ছিলো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার শরীরে ধর্ষণ ও ক্ষতচিহ্নগুলি থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে অপরাধী ও অনামিকার মধ্যে রীতিমতো ধস্তাধস্তি হয়েছিলো। আপনি ঘটনাস্থলে ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন?

চতুর্থ সাক্ষী       : না, শুধু ধনঞ্জয়ের ছেঁড়া ইয়ারপিস ছাড়া তেমন কিছুই দেখতে পাইনি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : একজন অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক হিসাবে আপনার কি মনে হয়নি যে অনামিকার মতো একজন শক্ত-সমর্থ তরুণী চিকিৎসককে একা ধনঞ্জয়ের দ্বারা ওই রকম ভয়ঙ্করভাবে শারীরিক নিগ্রহ, ধর্ষণ ও খুন করা সম্ভব নয়?

চতুর্থ সাক্ষী       : আমার তেমন কিছু মনে হয়নি। আর তা ছাড়া অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য-প্রমাণ ধনঞ্জয়ের বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার মৃতদেহ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এমনটা কি মনে হয় না যে হয়তো অনামিকাকে অন্য কোথাও খুন করে ওই হলটার মধ্যে রাখা হয়েছিলো?

চতুর্থ সাক্ষী       : না, তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : যদি তেমনটা না হয় তবে পাশের ঘরে একজন ডিউটিরত থাকা সত্ত্বেও কিছু শুনতে পায়নি কেনো?

চতুর্থ সাক্ষী       : সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের প্রাথমিক পর্যায়ের তদন্ত সংক্রান্ত সবকিছু আপনার নির্দেশ মোতাবেক হয়েছে বলে আপনি দাবি করেছিলেন, ঠিক তো?

চতুর্থ সাক্ষী       : হ্যাঁ।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি জানেন যে সি.বি.আই. ষড়যন্ত্র ও প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে হাসপাতালের অধ্যক্ষ সুদীপ বোস ও সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার-ইন-চার্জকে গ্রেফতার করেছে। তাহলে কি বুঝবো যে এই ষড়যন্ত্র ও প্রমাণ লোপাটের ঘটনা আপনার নির্দেশ মোতাবেক হয়েছে?   

চতুর্থ সাক্ষী       : না। ষড়যন্ত্র ও প্রমাণ লোপাটের মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত করে আরো কিছু তথ্য-প্রমাণ যাতে না পাওয়া যায় তার জন্য কি অনামিকার মৃতদেহ তড়িঘড়ি দাহ করা হয়েছিলো?

চতুর্থ সাক্ষী      : একেবারেই না। প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ময়না তদন্ত করা হয়েছিলো এবং সেই ময়না তদন্তের প্রক্রিয়ায় উপস্থিত সকলেই সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আচ্ছা ধনঞ্জয় সিং তো একজন মামুলি স্বেচ্ছাসেবক পুলিশ হিসাবে কর্মরত ছিলো অথচ তার বেআইনিভাবে পুলিশ ব্যারাকে থাকা, তোলাবাজি করা, পুলিশের মোটরবাইক নিয়ে যথেচ্ছ দাপিয়ে বেড়ানো ছাড়াও মাদকাসক্তি, এগুলির পিছনে কি আপনাদের প্রত্যক্ষ মদত ছিলো?

চতুর্থ সাক্ষী     : দেখুন, পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবক পুলিশে কয়েক হাজার মানুষ কর্মরত। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবার বিষয়ে সব খবর রাখতে পারি না। তবে, হয়তো কারো মদত থাকতে পারে, যেটা আমি জানি না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে যে নানারকম বেআইনি কাজকর্ম করা ছাড়াও, ধনঞ্জয় অন্যায়ভাবে টাকা নিয়ে বিভিন্ন রোগীকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিতো এবং সেই সূত্রে ধনঞ্জয়ের সঙ্গে ওই হাসপাতালে কর্মরত অনেক প্রভাবশালী  চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো – এই ব্যাপারে আপনি কি ওয়াকিবহাল ছিলেন? 

চতুর্থ সাক্ষী       : এই ধরণের কোনো তথ্য আমি জানি না এবং আমার পক্ষে জানা সম্ভবপর নয়।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আমি বলছি যে ধনঞ্জয়ের সঙ্গে ওই হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুবাদে, যখনই তারা ধনঞ্জয়কে ডেকে পাঠাতো, ধনঞ্জয় গিয়ে হাজির হোতো। 

চতুর্থ সাক্ষী      : হোতে পারে, তবে আমার জানা নেই।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ধনঞ্জয় অবৈধভাবে টাকা নিয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা করতো বলে অনেকে অভিযোগ করেছে। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয় তবে এই ধরণের কাজের জন্য ধনঞ্জয়ের তো ওই হলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। তাহলে, মাননীয় আদালতকে বলুন তো, মাঝরাতে ওই হলে অনামিকা একা বিশ্রাম নিচ্ছে, এই খবরটা ধনঞ্জয় কি ভাবে পেলো যদি হাসপাতালের সঙ্গে যু্ক্ত এবং অনামিকার গতিবিধির উপর নজর রাখছে এমন কেউ ধনঞ্জয়কে ডেকে না পাঠায়?

চতুর্থ সাক্ষী      : আমি নিশ্চিতভাবে কিছু জানি না। তা ছাড়া, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তদন্তের দায়িত্বভার সি.বি.আই.-কে দেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের সুযোগ ছিলো না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন মহল থেকে তথ্য-প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে তদন্তের দাবি করা হয়েছিলো। এই প্রসঙ্গে আপনি কি বলবেন? 

চতুর্থ সাক্ষী      : অভিযোগ মিথ্যা। আমি যে কোনো তদন্তের মুখোমুখি হোতে রাজি আছি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন।

চতুর্থ সাক্ষীকেও সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবুরা কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

পঞ্চম সাক্ষী হিসাবে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসককে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও পঞ্চম সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : আইন অনুযায়ী সন্ধ্যার পরে কোনো মৃতদেহের ময়না তদন্ত করা যায় না, তবুও আপনি করেছিলেন, কেনো?

পঞ্চম সাক্ষী     : নগরপাল, তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং কিছু জুনিয়র ডাক্তারের উপস্থিতিতে আমি অনামিকার মৃতদেহের ময়না তদন্ত করতে বাধ্য হই, কারণ, জুনিয়র ডাক্তারদের এবং মৃতার কিছু আত্মীয়-স্বজনের জোরালো দাবি ছিলো অবিলম্বে ময়না তদন্ত করতে হবে।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ময়না তদন্তের রিপোর্টে অনামিকার গোপনাঙ্গে জোরপূর্বক পেনিট্রেশান করা হয়েছে বলে আপনি লিখেছেন। আমার প্রশ্ন হোলো, জোরপূর্বক পেনিট্রেশানের ফলে যে ধরণের নিদর্শন সৃষ্টি  হয়, পুরুষাঙ্গের মতো সেক্সটয় বা ওই ধরণের কোনো বস্তু দ্বারা একই ধরণের নিদর্শন সৃষ্টি করা সম্ভবপর কি? 

পঞ্চম সাক্ষী      : হ্যাঁ, সম্ভব।

ধনঞ্জয়ের উকিল : মৃতার গোপনাঙ্গে জোরপূর্বক পেনিট্রেশানের ফলে যে ধরণের নিদর্শন আপনি দেখেছিলেন, সেটি অনামিকাকে খুন করবার পরে সে ধর্ষিতা হয়েছে বলে প্রমাণ এবং তদন্ত ভুল পথে চালিত করার উদ্দেশ্যে পুরুষাঙ্গের মতো সেক্সটয় বা ওই ধরণের কোনো বস্তু দ্বারা সৃষ্টি করা হোতে পারে কি?

পঞ্চম সাক্ষী       : হ্যাঁ, হোতে পারতো। কিন্তু, এখানে সেটা হয়নি। কারণ, অনামিকার গোপনাঙ্গে আসামীর কয়েকটি যৌনরোম পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে মৃতার গোপনাঙ্গে জোরপূর্বক পেনিট্রেশান হয়েছিলো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে গবাদি পশুর প্রজনন বা ইন্সেমিনেশান ইঞ্জেক্টরের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। আমার প্রশ্ন হোলো অনামিকার গোপনাঙ্গ থেকে নিঃসৃত যে গাঢ় সাদাটে তরল পদার্থ পাওয়া গেছে, যেটা ধনঞ্জয়ের শুক্রমিশ্রিত বলে ফরেন্সিক পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে, সেটা কি অনামিকার মৃত্যুর পরে তার গোপনাঙ্গে ইঞ্জেক্টরের মাধ্যমে করা সম্ভব?

পঞ্চম সাক্ষী      : সম্ভব। কিন্তু, এখানে সেটা হয়নি। কারণ, অনামিকার গোপনাঙ্গে আসামীর কয়েকটি যৌনরোম পাওয়া প্রমাণ করে যে পেনিট্রেশান হয়েছিলো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক হিসাবে বলুন অনামিকার মৃত্যু কিভাবে সংঘটিত হয়েছিলো? 

ধনঞ্জয়ের উকিল : জোরপূর্বক শ্বাসরোধ করার কারণে অনামিকার মৃত্যু হয়েছিলো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আচ্ছা, এমনও তো হোতে পারে যে ধনঞ্জয়কে দোষী প্রমাণ করার জন্য তার শরীর থেকে যৌনরোম সংগ্রহ করে অনামিকার গোপনাঙ্গে রেখে দেওয়া হয়েছে?

পঞ্চম সাক্ষী      : হয়তো হোতে পারে। আমি এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার ক্ষত-বিক্ষত মৃত শরীর দেখে কি মনে হয় না যে একা ধনঞ্জয়ের পক্ষে ওই ভাবে ধর্ষণ ও খুন করা সম্ভব ছিলো না।

পঞ্চম সাক্ষী      : এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি জানিয়েছেন যে যখন ময়না তদন্ত করেছিলেন তখন সেখানে নগরপাল, তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং কিছু জুনিয়র ডাক্তার উপস্থিত ছিলো এবং পুরো প্রক্রিয়ার ভিডিওগ্রাফী করা হয়েছিলো। এখন বলুন তো, ময়না তদন্ত সঠিকভাবে করার পদ্ধতি সম্পর্কে আপনি ছাড়া বাকি যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে কারোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো?

পঞ্চম সাক্ষী      : সম্ভবতঃ না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, ময়না তদন্ত নিয়ম মেনে সঠিকভাবে করা হয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ কোরে যারা সাক্ষী হিসাবে আপনার লিখিত ময়না তদন্তের রিপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন, তারা সেটা সম্যকভাবে না বুঝেই করেছেন, ঠিক কি না?  

পঞ্চম সাক্ষী      : না, আমি উপস্থিত সবাইকে ময়না তদন্তের নিয়ম সম্পর্কে আগেই বুঝিয়েছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন।

পঞ্চম সাক্ষীকেও সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

ষষ্ঠ সাক্ষী হিসাবে অনামিকার বসতবাড়ির এলাকার বিধায়ককে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও ষষ্ঠ সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার খুন হয়ে যাওয়ার খবর চাউর হওয়ার পর এলাকার বিধায়ক হিসাবে আপনি অবিলম্বে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। আপনার বিধানসভা এলাকায় ইতিপূর্বে যে সমস্ত খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিলো, সেই সব ঘটনাস্থলে কি আপনি গিয়েছিলেন?

ষষ্ঠ সাক্ষী         : সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয়নি, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গিয়েছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার মৃতদেহের তড়িঘড়ি ময়না তদন্ত ও দাহ করে ফেলার জন্য আপনি চাপ দিয়েছিলেন কেনো?

ষষ্ঠ সাক্ষী         : ময়না তদন্ত করার জন্য আমি কাউকে কোনো চাপ দিইনি। তবে, ব্যাপারটা অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ার কারণে এবং উত্তরোত্তর বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতি সামলানোর জন্য অনামিকার মৃতদেহ তাড়াতাড়ি দাহ করানোর ব্যবস্থা কোরে দিয়েছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আচ্ছা, এমন তো নয় যে অনামিকার মৃতদেহের যাতে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত না করা হয় সেইজন্য তাড়াহুড়ো করে মৃতদেহ দাহ করে দেওয়া হয়েছিলো?

ষষ্ঠ সাক্ষী      : না, তেমন কোনো কিছু আমার কল্পনাতেও আসেনি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আচ্ছা, এমনও তো হোতে পারে যে আসল অপরাধীরা আপনার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাড়াহুড়ো করে অনামিকার মৃতদেহ দাহ করিয়েছে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত যাতে না করা যায়?

ষষ্ঠ সাক্ষী         : না, আমাকে অনামিকার মৃতদেহ দাহ করানোর ব্যাপারে কেউ কিছু বলেনি। আগেই তো বলেছি যে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য অনামিকার মৃতদেহ তাড়াতাড়ি দাহ করানোর ব্যবস্থা কোরে দিয়েছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন।

ষষ্ঠ সাক্ষীকেও সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

সপ্তম সাক্ষী হিসাবে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও সপ্তম সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্তে যে সব বায়োলজিক্যাল ও নন- বায়োলজিক্যাল সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো, সেগুলির ডি.এন.এ. এবং ফরেন্সিক পরীক্ষা কি আপনি করেছিলেন? 

সপ্তম সাক্ষী      : হ্যাঁ, আমিই করেছিলাম।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ডি.এন.এ. এবং ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ হোতে গেলে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হয় আপনি কি সেই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেছেন?

সপ্তম সাক্ষী       : হ্যাঁ, আমি প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেছি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনার দেওয়া ডি.এন.এ. এবং ফরেন্সিক পরীক্ষার লিখিত রিপোর্ট অনুযায়ী যে সব বায়োলজিক্যাল ও নন- বায়োলজিক্যাল সামগ্রী আপনি পরীক্ষা করেছিলেন, সেগুলি সব অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের বলে উল্লেখ করেছেন। এবারে বলুন তো, বিভিন্ন পরীক্ষিত সামগ্রীর মধ্যে অনামিকার গোপনাঙ্গ থেকে নিঃসৃত যে গাঢ় সাদাটে তরল পদার্থ পাওয়া গেছে, তাতে কি শুধুমাত্র ধনঞ্জয়ের শুক্র পাওয়া গেছে, না কি অন্য কোনো ব্যক্তির শুক্রও মিশ্রিত ছিল?

সপ্তম সাক্ষী       : শুধুমাত্র ধনঞ্জয়ের শুক্র পাওয়া গেছে, অন্য কোনো ব্যক্তির শুক্র পাওয়া যায়নি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আমি বলছি যে আপনি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির নির্দেশ পালন করে শুধুমাত্র ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে ওই ডি.এন.এ. এবং ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছেন।

সপ্তম সাক্ষী       : না, আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, নিয়ম মেনে ও নিরপেক্ষভাবে এই রিপোর্ট লিখেছি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন।

সপ্তম সাক্ষীকেও সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

 

অষ্টম সাক্ষী হিসাবে অনামিকার বাবাকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও অষ্টম সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল প্রথমেই অনামিকার বাবাকে বললেন যে, আপনার একমাত্র আদরের মেয়ের পৈশাচিক খুনের ঘটনায় আমি আপনার প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পেশাগত দায়বদ্ধতায় আমি এই খুনের ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো যার উত্তর আপনার কাছে আশা করছি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনার মেয়ে কি অন্তর্মুখী না কি খোলামেলা স্বভাবের ছিলো।

অষ্টম সাক্ষী      : আমার মেয়ে খোলামেলা স্বভাবের ছিলো, তবে, আমাদের দুশ্চিন্তা বা কষ্ট হোতে পারে এমন কোনো কথা আমাদের বলতো না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনার মেয়ের প্রতি যে পৈশাচিক অত্যাচার ও খুনের ঘটনা ঘটলো, এরকম যে ঘটতে পারে এমন কোনো আভাস আপনার মেয়ের কথায় কখনো কি পেয়েছিলেন?

অষ্টম সাক্ষী      : না, আমার মেয়ের কথায় বা ব্যবহারে এমন কোনো আভাস কখনো পাইনি। তা ছাড়া ও  তো অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলো এবং সবার সাথে মিলেমিশে চলতো তাই ওর সাথে এমনটা যে হোতে পারে আমি তা কল্পনাও করতে পারিনি। 

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনার মেয়ের মৃতদেহের ময়না তদন্তের সময়ে আপনি ও আপনার স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন এবং আপনার স্ত্রী ময়না তদন্তের রিপোর্টে স্বাক্ষর করেছিলেন। আমার প্রশ্ন হোলো আপনার মতে ময়না তদন্ত কি সঠিকভাবে করা হয়েছিলো?

অষ্টম সাক্ষী      : হ্যাঁ।

ধনঞ্জয়ের উকিল : এই ঘটনায় প্রথমে পুলিশ আর পরে সি.বি.আই ধনঞ্জয়কে অভিযুক্ত করেছে। আপনি ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে বলে কাউকে সন্দেহ করেন?

অষ্টম সাক্ষী      : কাকে সন্দেহ করবো বলুন? তবে, আমি বিশ্বাস করি কোনো একজনের পক্ষে আমার মেয়েকে ঐরকম পৈশাচিক অত্যাচার কোরে খুন করা সম্ভব নয়।

ধনঞ্জয়ের উকিল : প্রথমে পুলিশ আর পরে সি.বি.আই যেভাবে তদন্ত কোরে রিপোর্ট দিয়েছে, আপনি কি তাতে সন্তুষ্ট?

অষ্টম সাক্ষী      : একেবারেই সন্তুষ্ট নই। ঠিকভাবে তদন্ত হোলে, আমার মেয়ের খুনের ঘটনায় জড়িত আরও লোক নিশচয়ই ধরা পড়তো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আপনি নামুন।

অষ্টম সাক্ষীকেও সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু কোনো প্রশ্ন করলেন না।

-----------------------

নবম সাক্ষী হিসাবে সি.বি.আই.-এর তদন্তকারী অফিসারকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষের উকিল তাঁর জবানবন্দি নথিভুক্ত করানোর পর ধনঞ্জয়ের উকিল ওই সাক্ষীকে জেরা শুরু করলেন। ধনঞ্জয়ের উকিল ও নবম সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ –

ধনঞ্জয়ের উকিল : মাননীয় উচ্চ আদালতের নির্দেশে তদন্তভার পাওয়ার পরে পুলিশের কাছ থেকে এই মামলা সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র নিয়ে সি.বি.আই-এর তরফ থেকে প্রধান তদন্তকারী অফিসার হিসাবে আপনিই তো তদন্ত করে অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে চার্জশীট দিয়েছেন?

নবম সাক্ষী       : হ্যাঁ।

ধনঞ্জয়ের উকিল : পুলিশের কাছ থেকে যে সব নথিপত্র পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তদন্ত করে যে সমস্ত তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিলেন, সবদিক খতিয়ে দেখে তার ভিত্তিতেই চার্জশীট দিয়েছেন?

নবম সাক্ষী       : হ্যাঁ।

ধনঞ্জয়ের উকিল : পুলিশ যে সমস্ত তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিল, সেগুলি ছাড়া ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে আর কি তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিলেন?

নবম সাক্ষী       : নতুন কোনো তথ্য-প্রমাণ বলতে বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যা জানতে পেরেছিলাম, সে সবই ছিলো ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধনঞ্জয় ছাড়া আর কেউ জড়িত থাকতে পারে কি না সে ব্যাপারে আপনার কোনো সন্দেহ হয়নি?

নবম সাক্ষী       : সন্দেহ হয়েছিলো, কিন্তু কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি এ পরিপ্রেক্ষিতে এবং আপনার সহকর্মীরা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল ওই হলটার ভিতর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করে কোনো নতুন  তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিলেন?

নবম সাক্ষী       : না, নতুন কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনেক ডাক্তার, সমাজের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ এমনকি আপনারাও অভিযোগ করেছেন তথ্য-প্রমাণ লোপাটের। আমার প্রশ্ন, কি ধরণের তথ্য-প্রমাণ লোপাট হয়েছে বলে আপনাদের সন্দেহ এবং সেটা কারা করেছে বলে আপনাদের মনে হয়?

নবম সাক্ষী       : সি.সি.টিভি-র কিছু অংশ মিসিং, অনামিকাকে যে ভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে তাতে ঘটনাস্থল থেকে বাজেয়াপ্ত করা সামগ্রী ছাড়াও আরো কিছু তথ্য-প্রমাণ থাকা উচিৎ ছিলো, মৃতদেহ দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত করার সুযোগ পাওয়া গেলে আরো কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। বেশ কিছু প্রমাণ লোপাটের ক্ষেত্রে হাসপাতালের অধ্যক্ষ সুদীপ বোস, সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জ এবং পর্দার আড়ালে থাকা কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ভূমিকা ছিলো বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ওই হলে বিশ্রাম নিতে যাওয়ার আগে অনামিকা তার চারজন পুরুষ সহকর্মীদের সাথে রাতের খাবার খেয়েছিলো বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। ওই চারজনকে আপনারা অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন কি?

নবম সাক্ষী      : হ্যাঁ, জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কিন্তু, নানাভাবে চেষ্টা করেও ওদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বা ঘটনার পিছনে ওদের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে হয়নি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : পুলিশি তদন্তের নথিপত্রে অনামিকার মৃতদেহের এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা দেখে এমনটা কি মনে হয় না যে হয়তো অনামিকাকে অন্য কোথাও খুন করে ওই হলটার মধ্যে রাখা হয়েছিলো?

নবম সাক্ষী       : হোতে পারে। তবে, ঘটনাস্থলে মৃতদেহের অবস্থান এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা না দেখে শুধুমাত্র পুলিশি তদন্তের নথিপত্রে তার বর্ণনা দেখে অনামিকাকে অন্যত্র খুন করে ওই হলটার মধ্যে রাখা হয়েছিলো এমনটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে পুলিশ তদন্ত করে এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় যে সমস্ত তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলো, আপনারা তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সব তথ্য-প্রমাণের বাইরে নতুন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছেন কি?

নবম সাক্ষী     : হ্যাঁ। তবে, সেই সব তথ্য-প্রমাণ হাসপাতালের অধ্যক্ষ সুদীপ বোস, সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জ এবং তাদের সঙ্গে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা কি ওই অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে আপনি মনে করেন?

নবম সাক্ষী      : সরাসরি নয়, তবে হাসপাতালের অধ্যক্ষ সুদীপ বোস ও সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জের এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ভূমিকা সেদিকেই ইঙ্গিত করে।

ধনঞ্জয়ের উকিল : এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে তৎকালিন নগরপাল বলেছিলেন যে, ঘটনার তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়ে সবকিছুই তাঁর নির্দেশ মোতাবেক হয়েছে? নগরপালের ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন?  

নবম সাক্ষী       : না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত করে আরো কিছু তথ্য-প্রমাণ যাতে না পাওয়া যায় তার জন্য কি অনামিকার মৃতদেহ তড়িঘড়ি দাহ করা হয়েছিলো?

নবম সাক্ষী      : আমার সেটাই বিশ্বাস।

ধনঞ্জয়ের উকিল : আপনি কি জানেন যে ধনঞ্জয়ের সঙ্গে ওই হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুবাদে, যখনই তারা ধনঞ্জয়কে ডেকে পাঠাতো, ধনঞ্জয় গিয়ে হাজির হোতো? 

নবম সাক্ষী      : হ্যাঁ, তদন্ত করার সময়ে আমি সেই রকমই জানতে পেরেছি।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঘটনার রাতে ওই হাসপাতালে ধনঞ্জয়ের স্বেচ্ছাসেবক পুলিশ হিসাবে ডিউটি ছিলো না বা ধনঞ্জয় মাঝরাতে কোনো রোগীকে ওই হাসপাতালে ভর্তির বন্দোবস্ত করতেও আসেনি। তা ছাড়া, ধনঞ্জয়ের তো ওই হলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হওয়ার কথাও নয়। তাহলে, মাননীয় আদালতকে বলুন তো, মাঝরাতে ওই হলে অনামিকা একা বিশ্রাম নিচ্ছে, এই খবরটা ধনঞ্জয় কি ভাবে পেলো যদি হাসপাতালের সঙ্গে যু্ক্ত এবং অনামিকার গতিবিধির উপর নজর রাখছে এমন কেউ ধনঞ্জয়কে ডেকে না পাঠায়?

নবম সাক্ষী      : আমি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারবো না। তবে, হাসপাতালেরই কোনো ব্যক্তি যে ধনঞ্জয়কে ওই হলটাতে আসতে বলেছিলো, সে সম্ভাবনা প্রবল।

ধনঞ্জয়ের উকিল : অভিযুক্ত ধনঞ্জয়,  অধ্যক্ষ সুদীপ বোস ও সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জের নার্কো টেস্ট করার জন্য আপনারা আদালতে আবেদন করেছিলেন, কিন্তু অভিযুক্তরা রাজি না হওয়ায় আপনাদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এই ঘটনায় আপনার কি মনে হয় না যে নার্কো টেস্ট হোলে ওদের মুখ থেকে এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত আরও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ও কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যেত? 

নবম সাক্ষী      : হ্যাঁ, যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো।

ধনঞ্জয়ের উকিল : যে সব বায়োলজিক্যাল ও নন-বায়োলজিক্যাল সামগ্রী অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের বলে ফরেন্সিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এমন তো নয় যে সেগুলি ধনঞ্জয়কে ভয় দেখিয়ে তার উপরে চাপ সৃষ্টি করে কোনো এক বা একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ধনঞ্জয়ের শরীর থেকে বায়োলজিক্যাল সামগ্রী সংগ্রহ করে অনামিকার শরীরে প্রতিস্থাপন করে কৃত্রিম তথ্য-প্রমাণ সৃষ্টি করেছে তদন্তকে ভুল পথে চালনা করার জন্য? 

নবম সাক্ষী       : এতটা নিখুঁতভাবে করা অসম্ভব। এটা একেবারেই আকাশ-কুসুম কল্পনা।

ধনঞ্জয়ের উকিল : সাধারণতঃ এই ধরণের ধর্ষণ ও খুনের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। আপনি ঘটনার তদন্ত করে অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে এই ধর্ষণ ও খুনের পিছনে কি উদ্দেশ্য ছিলো জানতে পেরেছেন?

নবম সাক্ষী       : না।

ধনঞ্জয়ের উকিল : ঠিক আছে, আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।

ধনঞ্জয়ের উকিল জেরা শেষ করার পর নবম সাক্ষীকে অধ্যক্ষ সুদীপ বোস ও থানার অফিসার-ইন-চার্জের উকিলবাবু জেরা শুরু করলেন –

উকিলবাবু  : আপনি ইতিপূর্বে বলেছেন যে, হাসপাতালের অধ্যক্ষ সুদীপ বোস, সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জ এবং তাদের সঙ্গে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তথ্য-প্রমাণ লোপাটের ভূমিকা ছিলো। আপনি কি অনুগ্রহ কোরে বলবেন, কি ধরণের তথ্য-প্রমাণ তারা লোপাট করেছিলো? 

নবম সাক্ষী : অনামিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে অধ্যক্ষ সুদীপ বোস এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জের মধ্যে মোবাইল ফোনে কথোপকথন, ঘটনাস্থলে দেরি কোরে পৌঁছানোর, ঘটনার এফ.আই.আর. নিতে অস্বাভাবিক দেরি ইত্যাদি ঘটনা ওদের তথ্য-প্রমাণ লোপাটে জড়িত থাকার সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে।

উকিলবাবু   : সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত মানে, এটা আপনার সন্দেহ, তাই তো?

নবম সাক্ষী : শুধু সন্দেহ নয়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

উকিলবাবু   : আপনি একজন সি.বি.আই.-এর ঝানু তদন্তকারী অফিসার হিসাবে বলুন তো, আপনার সন্দেহ এবং দৃঢ় বিশ্বাস কি আইনগ্রাহ্য?

নবম সাক্ষী : সেটা মাননীয় আদালতের বিচার্য বিষয়।

উকিলবাবু : ঠিক আছে, আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই, আপনি নামুন।

উপরে উল্লিখিত নয় জন সাক্ষী ছাড়াও সুরতহাল বা ময়না তদন্তের রিপোর্টে সাক্ষরকারী, বাজেয়াপ্ত সামগ্রীর তালিকায় সাক্ষরকারী এবং আরো কিছু ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করা হোলো, কিন্তু, তাদের সাক্ষ্য এই মামলার বিচারের জন্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ার কারণে এখানে উপস্থাপিত করা হোলো না।

-----------------------

অষ্টম অধ্যায়

সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হওয়ার পর বাদী এবং অভিযুক্ত উভয়পক্ষের উকিলবাবুরা মামলার তদন্তে সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ এবং বিভিন্ন সাক্ষীদের সাক্ষ্যদানের উপর ভিত্তি করে তাদের বক্তব্য পেশ করলেন। তাদের বক্তব্যের মূল অংশবিশেষ নীচে উপস্থাপন করা হোলো -

প্রথমে বাদী পক্ষের সরকারী উকিলবাবু তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। মাননীয় ন্যায়াধীশ, আজ আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এমন একটি ধর্ষণ ও খুনের মামলায় বক্তব্য রাখছি যা শুধু বিরলতম নয়, যার পৈশাচিকতা তুলনাহীন। এই ধরণের নিষ্ঠুর পৈশাচিক ধর্ষণ ও খুনের অপরাধ যারা করে, তাদের জন্য দণ্ডবিধিতে কঠিনতম শাস্তির বিধানও নিতান্তই লঘু।

এই মামলায় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পাওয়া যায়নি ঠিকই, কিন্তু তদন্তকারী অফিসার সমস্ত পারিপার্শ্বিক, বায়োলজিক্যাল ও নন-বায়োলজিক্যাল তথ্য-প্রমাণ, সি.সি.টিভি-র ফুটেজ এবং বিভিন্ন সাক্ষীর বয়ানের ভিত্তিতে সবদিক বিবেচনা কোরে ধনঞ্জয়কে প্রধান অপরাধী সাব্যস্ত কোরে এবং অধ্যক্ষ সুদীপ বোস এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জকে তথ্য-প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত কোরে এই মামলায় চার্জশীট দিয়েছে।

আমরা জানি যে, বহু অপরাধ সংঘটিত হয় যেখানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী থাকে না আর সেই সমস্ত ক্ষেত্রে অপরাধের উদ্দেশ্য, পারিপার্শ্বিক এবং বস্তুগত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়ে থাকে এবং এক সময় অপরাধী ধরাও পড়ে।

এই মামলায় গৃহীত সাক্ষীদের জবানবন্দি থেকে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি যাতে মনে করা যেতে পারে এই পৈশাচিক ধর্ষণ ও খুন একা ধনঞ্জয় নয় বরং একাধিক ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়েছিলো। বরং, সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং সমস্ত পারিপার্শ্বিক, বায়োলজিক্যাল ও নন-বায়োলজিক্যাল তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ধনঞ্জয়কে ধর্ষক ও খুনী হিসাবে প্রতিপন্ন করে।

অপর দিকে, অধ্যক্ষ সুদীপ বোস এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জের মধ্যে কথোপকথন, অভিযোগ নথিবদ্ধ করতে দীর্ঘসূত্রিতা, তদন্তে অসহযোগিতা, নার্কো টেস্টে রাজি না হওয়া ইত্যাদি ঘটনা থেকে পরিস্কার যে তারা প্রত্যক্ষভাবে না হোলেও পরোক্ষভাবে তথ্য-প্রমাণ লোপাট করেছে তাদের কোনো ঘনিষ্ট লোকের মাধ্যমে এবং তাদের নার্কো টেস্ট করা সম্ভব হোলে প্রত্যক্ষভাবে তথ্য-প্রমাণ লোপাটকারীদের সনাক্ত করা সম্ভবপর হোতো।

যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ, সি.সি.টিভি-র ফুটেজ এবং বিভিন্ন সাক্ষীর বয়ান সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ই ধর্ষক ও খুনী এবং অধ্যক্ষ সুদীপ বোস এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জ ওই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তথ্য-প্রমাণ লোপাটের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং, মাননীয় ন্যায়াধীশের কাছে আমার প্রার্থনা ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধীদেরকে চরমতম দণ্ডাদেশ দিয়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।

 -----------------------

বাদী পক্ষের উকিলবাবুর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের উকিলবাবু তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি বললেন মাননীয় ন্যায়াধীশ, আমার বাদী পক্ষের উকিলবাবু বন্ধু যে বলেছেন তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এমন একটি ধর্ষণ ও খুনের মামলায় বক্তব্য রাখছেন যা শুধু বিরলতম নয়, যার পৈশাচিকতা তুলনাহীন – তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণভাবে সহমত পোষণ করি।

ব্যক্তিগতভাবে আমার অত্যন্ত খারাপ লাগছে যে, আমি এমন জঘন্য অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্তের পক্ষে সওয়াল করছি। কিন্তু উপায় নেই, আমাকে অভিযুক্তের পক্ষে সওয়াল করতে হবে কারণ, নিজেকে এই পেশায় যুক্ত করার সময় আমাকে শপথ নিতে হয়েছে যে যত জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত হোক না কেন, সে আমার কাছে আইনি সহায়তা চাইলে আমি দিতে বাধ্য।

আমার বাদী পক্ষের উকিলবাবু বন্ধু তাঁর সুদীর্ঘ বক্তৃতার মধ্যে বলেছেন যে, “সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং সমস্ত পারিপার্শ্বিক, বায়োলজিক্যাল ও নন-বায়োলজিক্যাল তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ধনঞ্জয়কে ধর্ষক ও খুনী হিসাবে প্রতিপন্ন করে”। আমি তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে একেবারেই সহমত নই, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করে বলতে চাই যে, তদন্তকারী অফিসার এবং বাদী পক্ষের উকিলবাবু বন্ধু অভিযুক্ত ধনঞ্জয়কে দোষী প্রমাণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

এই মামলায় কোনো ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসাবে পাওয়া না গেলেও, তদন্তকারী অফিসার পারিপার্শ্বিক, বায়োলজিক্যাল ও নন-বায়োলজিক্যাল তথ্য-প্রমাণ, সি.সি.টিভি-র ফুটেজ এবং বিভিন্ন সাক্ষীর বয়ানের ভিত্তিতে সবদিক বিবেচনা কোরে ধনঞ্জয়কে ধর্ষক ও খুনী সাব্যস্ত করে এই মামলায় চার্জশীট দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমি মাননীয় ন্যায়াধীশের দৃষ্টি আকর্ষণ কোরে বলতে চাই যে, প্রত্যক্ষদর্শী একজনই মাত্র ছিলো যার নাম সি.সি.টিভি. এবং যার যান্ত্রিক চোখ থাকে সদাজাগ্রত। আর ওই পৈশাচিক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সেই প্রত্যক্ষদর্শী অভিযুক্ত ধনঞ্জয়কে ঘটনাস্থলের দিকে যেতে ও আসতে দেখেছে। যদিও ওই প্রত্যক্ষদর্শীর যান্ত্রিক চোখ সদাজাগ্রত থাকে, তবু অদ্ভুতভাবে ধনঞ্জয়ের ঘটনাস্থলের দিকে যাওয়া ও আসার মাঝে খানিকটা সময় অজ্ঞাত কারণে তার যান্ত্রিক চোখ ছিলো বন্ধ।

তদন্তকালিন বাজেয়াপ্তকৃত সমস্ত পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণ, বায়োলজিক্যাল ও নন-বায়োলজিক্যাল সামগ্রী এবং ওই সমস্ত সামগ্রীর ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষিত ফলাফল ও অভিমত ধনঞ্জয়কে খুন ও ধর্ষণে অভিযুক্ত করেছে। এই খুন ও ধর্ষণের ঘটনা অনেকগুলি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে –

(১) মৃতার শরীরে ক্ষতচিহ্নগুলি প্রমাণ করে যে, অপরাধী অথবা অপরাধীগণের সঙ্গে যথেষ্ট ধস্তাধস্তি হয়েছিলো এবং মৃতা নিশ্চয়ই সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছিলো। অথচ, ঘটনাস্থল বলে দাবি করা ওই হলের নিকটস্থ ঘরে একজন কর্মরতা থাকা সত্ত্বেও কিছু শুনতে পায়নি। এটা থেকে ধরে নেওয়া যায় যে অনামিকাকে অন্য কোথাও খুন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তার মৃত শরীর ঐ হলে এনে রাখা হয়েছিলো অথবা হলের নিকটস্থ ঘরে কর্মরতা কেয়ারটেকার যে বা যারা খুনী সে বা তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ার কারণে আতঙ্কবশতঃ সবকিছু জানা সত্ত্বেও অসত্য কথা বলেছে।

(২) ঘটনাস্থলে অনামিকা এবং অপরাধী অথবা অপরাধীগণের মধ্যে ধস্তাধস্তির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

(৩) অনামিকা অত্যন্ত সংবেদনশীল ও ভালো স্বভাবের মেয়ে ছিলো এবং তার সঙ্গে কারোর কোনো শত্রুতা ছিলো বলে জানা যায়নি। তাহলে, অনামিকা কি কারণে পৈশাচিক শারীরিক নিগ্রহ ও খুনের শিকার হোলো, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়নি।

(৪) মৃতার শরীরে লেগে থাকা যে সমস্ত যৌনরোম, বীর্য, চামড়ার টুকরো ধনঞ্জয়ের এবং ধনঞ্জয়ের নখের মধ্যে পাওয়া চামড়ার টুকরো অনামিকার বলে তদন্তকারী অফিসার দাবি করেছে এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ সনাক্ত এবং প্রত্যয়িতকরণ করেছে। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হোলে, ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক এবং তদন্তকারী অফিসার স্বীকার করেছে যে, ওই সমস্ত সামগ্রী একজনের শরীর থেকে সংগ্রহ কোরে অপর একজনের শরীরে কৃত্রিমভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।

(৫) এই ধর্ষণ ও খুনের পিছনে ধনঞ্জয়ের উদ্দেশ্য কি তা জানতে পারা যায়নি।

(৬) অনামিকা মাঝরাতে ওই হলের মধ্যে একা বিশ্রাম নিচ্ছে এই খবর ধনঞ্জয়কে কে জানিয়েছিলো, সে ব্যাপারে তদন্তে কারোর প্রতি কোনো রকম সন্দেহ প্রকাশ বা আলোকপাত করা হয়নি।

(৭) কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি ভয় দেখিয়ে ও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে ধনঞ্জয়ের উপর ধর্ষণ ও খুনের

(৮) ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থল হল থেকে ছেঁড়া ইয়ারপিস পেয়ে আর সি.সি.টিভি-র ফুটেজে ধনঞ্জয়ের ঘটনাস্থলে যাওয়া-আসার দৃশ্য দেখে পুলিশ ধনঞ্জয়কে গ্রেফতার করে প্রাথমিকভাবে তিনদিন তদন্ত করার পর তদন্তভার সি.বি.আই.-এর উপর বর্তায়, কিন্তু দীর্ঘদিনের তদন্তে নতুন কোনো তথ্য-প্রমাণ সি.বি.আই. যোগাড় করতে পারেনি। যার ফলে, পুলিশ দ্বারা বাজেয়াপ্তকৃত সামগ্রী আর ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের অভিমতের উপর ভিত্তি করে ধনঞ্জয়কে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে। এর থেকে পরিস্কার, বিভিন্ন কোণ থেকে পর্যালোচনা করে তদন্তের অভিমুখ আরো গভীরে নিয়ে গিয়ে যে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী ছিলো, সি.বি.আই. সেইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বা সত্য উদ্ঘাটনের কোনো চেষ্টাই করেনি।

এই সমস্ত অনুত্তর প্রশ্নের কোনো উত্তর সি.বি.আই.-এর তদন্তে প্রতিফলিত হয়নি। মাননীয় ন্যায়াধীশের কাছে আমার নিবেদন, এই রকম একটি স্পর্শকাতর মামলার যতটা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা উচিৎ ছিলো, তা আদৌ না কোরে অনুত্তর প্রশ্নের কোনো উত্তর না খুঁজে, অত্যন্ত সাধারণভাবে তদন্ত সেরে শুধুমাত্র বাজেয়াপ্তকৃত সামগ্রী আর ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের অভিমতের উপর ভিত্তি করে ধনঞ্জয়কে অপরাধী সাব্যস্ত করে চার্জশীট দিয়ে দায় সেরেছে। সি.বি.আই.-এর এই তদন্ত তাদের কর্তব্যের প্রতি দায়বদ্ধতায় প্রমাণ করেনি বরং দায়সারা মনোভাব প্রমাণ করে। সি.বি.আই.-এর এই দায়সারা তদন্তের পিছনে এবং আসল অপরাধীকে আড়াল করার প্রচেষ্টার পিছনে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

একজন প্রাজ্ঞ বিচারক হিসাবে মাননীয় ন্যায়াধীশ এই সুপ্রিষ্ঠিত নীতির সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত আছেন যে শত অপরাধী মুক্তি পেলেও একজনও নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়। তাই মাননীয় ন্যায়াধীশের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, সি.বি.আই. এই মামলায় অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেইজন্য “শত অপরাধী মুক্তি পেলেও একজনও নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়” এই সুপ্রিষ্ঠিত নীতির নিরিখে অভিযুক্ত ধনঞ্জয়কে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তির নির্দেশ দেওয়া হোক।

এরপর অধ্যক্ষ সুদীপ বোস এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জের উকিলবাবু তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করলেন। তিনি বললেন মাননীয় ন্যায়াধীশ, আমার অতি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হোলো কোনো গ্রহণযোগ্য তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই অনুমান ও সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আমার মক্কেলদ্বয়ের বিরুদ্ধে ওই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তথ্য-প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সি.বি.আই. চার্জশীট দিয়েছে, যা আইনগ্রাহ্য নয়। সুতরাং, মাননীয় ন্যায়াধীশের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, অধ্যক্ষ সুদীপ বোস এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন-চার্জকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তির নির্দেশ দেওয়া হোক।

-----------------------

 

পরিশিষ্ট

 

একটি নারকীয় ও পৈশাচিক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই রহস্যধর্মী কাহিনী। ওই ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে আমার মনে অনেকগুলি প্রশ্নের জাগে। আমারই মতো অনেকের মনে হয়তো একই রকমের না হোলেও নানা প্রশ্ন জেগেছে। এখানে প্রথম দিকে বর্ণিত ঘটনাবলি এবং পরে বর্ণিত বিচার প্রক্রিয়ার অনেকটাই কাল্পনিক। আমার মনে জেগে ওঠা প্রশ্নমালা এবং তার উত্তর এখানে তুলে ধরেছি বিভিন্ন সাক্ষীর জবানবন্দি ও সওয়াল-জবাবের মাধ্যমে। ধনঞ্জয় ধর্ষক ও খুনী কি না, সে বিচারের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলাম সমস্ত সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের হাতে।

 "Every allegation against any accused is to be proved beyond any reasonable doubt, otherwise, the benefit of doube to be given to the Accused"