চতুর্থ পর্ব: “প্রথম আঘাত”
গিরিরামপুরে দিনটা ছিল শান্ত। আকাশ পরিষ্কার, গঙ্গার ঢেউ শান্ত। কিন্তু প্রাসাদের গোপন কক্ষে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠছিল।
মন্ত্রী বলল—
“আজ রাতেই কাজ হবে। রাজপুত্রকে আমরা সম্পূর্ণভাবে আমাদের হাতে আনব। আর এই মেয়েটি—আরাধ্যা—ওকে সরিয়ে দিতে হবে। নাহলে সে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা নষ্ট করে দেবে।”
তাদের পরিকল্পনা ছিল সহজ—আরাধ্যাকে অপমান করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে রাজপুত্র নিজেই তাকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয়।
---
রাত নামল। প্রাসাদের অঙ্গনে বড়সড় এক সভা বসানো হলো। রাজা সেখানে উপস্থিত, রাজপুত্রও আছে। হঠাৎ মন্ত্রী অভিযোগ আনল—
“মহারাজ, এই আরাধ্যা একজন সাধারণ মেয়ে হলেও সে আপনার রাজ্যের নিয়ম ভেঙেছে। সে নাকি গোপনে কালো তন্ত্র করে গ্রামের লোককে বশে রাখছে।”
সকলেই অবাক। রাজা চমকে উঠলেন।
“তুমি কি প্রমাণ দিতে পারবে?”
মন্ত্রী এক মিথ্যা সাক্ষী নিয়ে এল, যে বলল—
“আমি নিজের চোখে দেখেছি আরাধ্যাকে রাতে শ্মশানে যজ্ঞ করতে।”
গ্রামবাসী ভয়ে ফিসফিস করতে লাগল।
---
রাজপুত্র রাগে ফেটে পড়ল।
“তাহলে ঠিকই বলেছিলাম! এ মেয়েটি বিপদ। আমাদের রাজ্যে কালো জাদু আমি সহ্য করব না।”
আরাধ্যা শান্ত গলায় বলল—
“রাজপুত্র, আমি কিছুই ভুল করিনি। আমি মায়ের সেবিকা। যদি মনে হয় আমি দোষী, তবে মাতঙ্গীর সামনে আমাকে দাঁড় করান। তিনি বিচার করবেন।”
---
সেই রাতে মন্দিরে সবাই জড়ো হলো। আরাধ্যা মাতঙ্গীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করল—
“মা, যদি আমি দোষী হই, তবে আমার জীবন নাও। আর যদি আমি নির্দোষ হই, তবে সত্য প্রকাশ করো।”
হঠাৎ মন্দির কাঁপতে লাগল। প্রদীপের শিখা একসঙ্গে উঁচু হয়ে উঠল। মূর্তির চোখ থেকে আগুনের মতো আলো বেরোল। এবং সেই আলো সোজা গিয়ে পড়ল সেই মিথ্যা সাক্ষীর ওপর। সে চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল আর কাঁদতে কাঁদতে স্বীকার করল—
“আমি মিথ্যা বলেছি! আমাকে মন্ত্রী টাকা দিয়ে মিথ্যা বলতে বলেছিল!”
গ্রামবাসী স্তব্ধ। রাজা ক্ষুব্ধ।
---
রাজপুত্র হতবাক হয়ে গেল। সে আরাধ্যার দিকে তাকিয়ে যেন প্রথমবার বুঝল, সে ভুল করেছে।
“আমি… আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই,” সে বলল।
আরাধ্যা শুধু শান্ত হাসল।
“ক্ষমা চাইতে হবে না। বুঝলেই যথেষ্ট।”
---
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা চুপ করে রইল না। সেই রাতেই তারা আরাধ্যার কুটিরে আগুন ধরিয়ে দিল। পুরো কুটির পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সবাই ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—আরাধ্যা অক্ষত রইল। সে আগুনের মাঝেই বসে ছিল, চোখ বন্ধ করে।
গ্রামবাসী বলল—
“এ যে দেবীর কৃপা!”
প্রাসাদের সবাই ছুটে এল। রাজপুত্র প্রথমবার তার হাত ধরে টেনে বের করল। তার চোখে আতঙ্ক।
“তুমি আছো তো? কিছু হয়নি তো?”
আরাধ্যা শান্তভাবে বলল—
“যারা আমাকে ক্ষতি করতে চাইছে, তারা এবার দেবীর আসল রূপ দেখবে।”
---
পরদিন ভোরে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। মন্ত্রী এবং তার সঙ্গীরা যেই জায়গায় ষড়যন্ত্র করছিল, সেখানে হঠাৎ বজ্রপাত হলো। সবাই গুরুতর আহত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ অজ্ঞান। গ্রামবাসী বলল—
“এটা দেবীর বিচার।”
রাজা ঘোষণা করলেন—
“আজ থেকে গিরিরামপুরে আরাধ্যা মাতঙ্গীর প্রধান পূজারিণী হবে।”
---
“অন্ধকারের দূত”
গিরিরামপুরে ভোর নেমেছে। গঙ্গার ধারে বাতাস ঠান্ডা, কিন্তু রাজপ্রাসাদের উঠোনে অদ্ভুত উত্তেজনা। কারণ গত রাতের বজ্রপাতের পর থেকেই সবাই ফিসফিস করছে—
“এবার বড় কিছু ঘটতে চলেছে।”
ঠিক তখনই দূর থেকে এক অচেনা যাত্রী এল। তার পরনে কালো পোশাক, মাথায় লম্বা কাপড়, মুখের অর্ধেক ঢাকা। সে রাজপ্রাসাদে এসে বলল—
“আমি দূর দেশের সাধক। গিরিরামপুরে যে অলৌকিক শক্তি জেগেছে তার সঙ্গে আমার কথা আছে।”
রাজা তাকে অতিথি করে রাখলেন। কিন্তু আরাধ্যার চোখে কিছু একটা অস্বস্তি। রাতে সে মন্দিরে বসে প্রার্থনা করল—
“মা, এই মানুষটি কে? আমি কি ওকে বিশ্বাস করতে পারি?”
হঠাৎ মন্দিরের প্রদীপ নিজের থেকে জ্বলে উঠল। আরাধ্যা শুনল এক কণ্ঠ—
“সে আলো নয়, ছায়া। সতর্ক থেকো।”
---
পরদিন সেই সাধক রাজপুত্রের সঙ্গে আলাদা দেখা করল।
“তুমি রাজপুত্র, তোমার ভাগ্যে রাজ্য আছে। কিন্তু এই মেয়েটি—যাকে তুমি পূজারিণী বানালে—সে তোমাকে দুর্বল করছে। যদি তুমি শক্তিশালী হতে চাও, তবে আমার সঙ্গে যজ্ঞ করো।”
রাজপুত্র দ্বিধায় পড়ল। একদিকে সে আরাধ্যার প্রতি টান অনুভব করছে, অন্যদিকে তার মধ্যে এখনও অহংকার রয়ে গেছে।
---
সেই রাতেই রাজপুত্র লুকিয়ে সেই সাধকের সঙ্গে পাহাড়ের গুহায় গেল। সেখানে অদ্ভুত কালো যজ্ঞ চলছিল। মন্ত্র উচ্চারণে বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
ঠিক তখনই গঙ্গার জল হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। মন্দিরে আরাধ্যা ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠল। তার চোখ খুলে গেল, যেন কেউ তাকে ডাকছে।
সে দৌড়ে গঙ্গার ধারে গেল। হঠাৎ তার সামনে মাতঙ্গীর অগ্নিময় রূপ দেখা দিল।
“আরাধ্যা, তাড়াতাড়ি যাও। আজ রাতেই তোমার স্বামী অন্ধকারের ফাঁদে পড়তে চলেছে।”
আরাধ্যা কেঁপে উঠল।
“মা, আমি কি তাকে বাঁচাতে পারব?”
“যদি তোমার বিশ্বাস অটুট থাকে।”
---
সে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের গুহায় পৌঁছল। সেখানে দেখল রাজপুত্র যজ্ঞকুণ্ডে বসে আছে আর কালো ধোঁয়া চারদিকে ঘুরছে। সাধক মন্ত্র পড়ছে—
“এই যজ্ঞে তুমি শক্তি পাবে, কিন্তু এই শক্তি তোমার রক্তকে রক্তের পথে টেনে নেবে।”
আরাধ্যা গম্ভীর কণ্ঠে বলল—
“থামো! এটা অশুভ যজ্ঞ। যদি আজ এটি সম্পূর্ণ হয়, গিরিরামপুর ধ্বংস হবে।”
রাজপুত্র চমকে তাকাল। তার চোখে দ্বন্দ্ব।
“আমি শুধু শক্তিশালী হতে চাই।”
আরাধ্যা সামনে এগিয়ে এসে তার হাত ধরল।
“শক্তি কেবল তলোয়ার থেকে আসে না। সত্য, ভক্তি আর সঠিক পথ—এগুলোই তোমাকে রাজা বানাবে।”
---
হঠাৎ যজ্ঞকুণ্ড থেকে আগুনের শিখা বেরোল। মনে হল পুরো গুহা পুড়ে যাবে। সাধক গর্জে উঠল—
“তুমি আমার কাজ নষ্ট করলে! তোমাদের রাজ্য শেষ করব আমি।”
ঠিক সেই মুহূর্তে মাতঙ্গীর রুদ্ররূপ আবির্ভূত হলো। বজ্রের মতো কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
“অশুভ শক্তি, তুমি গিরিরামপুরে টিকতে পারবে না।”
এক ঝলক আলো বেরিয়ে সাধককে গুহার বাইরে ছুড়ে ফেলল।
---
রাজপুত্র হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
“আমি ভুল করছিলাম। তুমি আমাকে রক্ষা করেছ।”
আরাধ্যা শুধু বলল—
“মায়ের ইচ্ছা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না।”