মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬২
অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধে শাল্ব উলূক ও শকুনি বধ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধে শাল্ব উলূক ও শকুনি বধ
দুপুরবেলায় যুধিষ্ঠির শল্যকে বধ করলেন, কৌরবসেনাও পরাজিত হয়ে যুদ্ধ করতে আনিচ্ছুক হোলো। পাণ্ডব ও পাঞ্চাল সৈন্যগণ বলতে লাগল, আজ ধৈর্যশালী যুধিষ্ঠির জয়ী হলেন, দুর্যোধন শ্রীহীন হলেন। আজ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনবেন এবং শোকাকুল হয়ে ভূমিতে পড়ে নিজের পাপ স্বীকার করবেন। আজ থেকে দুর্যোধন দাস হয়ে পাণ্ডবদের সেবা করবেন এবং তারা যে দুঃখ পেয়েছেন তা বুঝবেন। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র যে পক্ষের যোদ্ধা সে পক্ষের জয় হবে না কেন? জগন্নাথ কৃষ্ণ যাঁদের প্রভু, যাঁরা ধর্মকে আশ্রয় করেছেন, সেই পাণ্ডবদের জয় হবে না কেন?
ভীমের ভয়ে ভীত হয়ে কৌরবসৈন্য পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন তার সারথিকে বললেন, তুমি ওই সৈন্যদের পিছনে ধীরে ধীরে রথ নিয়ে চলো, আমি রণস্থলে থেকে যুদ্ধ করলে আমার সৈন্যেরা সাহস পেয়ে ফিরে আসবে। সারথি রথ নিয়ে চলল, তখন হাতি ঘোড়া ও রথবিহীন একুশ হাজার পদাতিক এবং নানা দেশের বহু যোদ্ধা প্রাণের মায়া ত্যাগ কোরে আবার যুদ্ধ শুরু করলো। ভীম তার বৃহৎ গদার আঘাতে সকলকেই নিষ্পেষিত করলেন। দুর্যোধন তার পক্ষের অবশিষ্ট সৈন্যদের উৎসাহ দিতে লাগলেন, তারা বার বার ফিরে এসে যুদ্ধে রত হোলো, কিন্তু প্রতি বারেই বিধ্বস্ত হয়ে পালিয়ে গেল।
দুর্যোধনের একটি মহাবংশজাত প্রিয় হাতি ছিলো, হাতির বিষয়ে কুশল লোকে তার পরিচর্যা করতো। ম্লেচ্ছাধিপতি শান্তু সেই পর্বতাকার হাতিতে চড়ে যুদ্ধ করতে এলেন এবং প্রচণ্ড বাণবর্ষণ করে পাণ্ডবসৈন্যদের যমালয়ে পাঠাতে লাগলেন। সকলে দেখল, সেই বিশাল হাতি একাই যেন বহু হাজার হয়ে সর্বত্র বিচরণ করছে। পাণ্ডবসেনা আতঙ্কিত হয়ে পালাতে লাগল। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুত ধাবিত হয়ে বহু নারাচ নিক্ষেপ কোরে সেই হাতিকে বিদ্ধ করলেন। শাল্ব অঙ্কুশ প্রহার কোরে হাতিকে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের দিকে চালিয়ে দিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ভয় পেয়ে রথ থেকে নেমে পড়লেন, তখন সেই হাতি শুঁড় দিয়ে ঘোড়া ও সারথি সমেত রথ তুলে নিয়ে ভূতলে ফেলে নিষ্পেষিত করলো। ভীম শিখণ্ডী ও সাত্যকি শরাঘাতে হাতিকে বাধা দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাকে থামাতে পারলেন না। বীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর বিশাল গদা দিয়ে হাতির মাথার পাশে প্রচণ্ড আঘাত করলেন। আর্তনাদ ও রক্তবমন কোরে সেই বিশাল হাতি ভূপতিত হোলো তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন ভল্লের আঘাতে শাল্বের শিরচ্ছেদ করলেন।
মহাবীর শাল্ব নিহত হোলে কৌরবসৈন্য আবার পালাতে লাগলো। রুদ্রের ন্যায় প্রতাপশালী দুর্যোধন তথাপি অদম্য উৎসাহে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন, পাণ্ডবগণ মিলিত হয়েও তার সম্মুখে দাঁড়াতে পারলেন না। অশ্বত্থামা শকুনি উলূক এবং কৃপাচার্যও পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে সাত শত রথী যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের হাতে তারা নিহত হলেন। তারপর নানা দিকে বিশৃঙ্খল ভাবে যুদ্ধ হতে লাগল। গান্ধাররাজ শকুনি দশ হাজার প্রাসধারী অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে এলেন, কিন্তু তার বহু সৈন্য নিহত হোলো। ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধনের ঘোড়া ও সারথি বিনষ্ট করলেন, তখন দুর্যোধন একটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে শকুনির কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে অশ্বত্থামা কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা তাঁদের রথারোহী যোদ্ধাদের ত্যাগ কোরে শকুনি ও দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হলেন।
ব্যাসদেবের বরে সঞ্জয় দিব্যচক্ষু লাভ কোরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিত থাকতেন এবং প্রতিদিন যুদ্ধশেষে ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধবৃত্তান্ত জানাতেন। কৌরবসৈন্য ক্ষীণ এবং শত্রুসৈন্য বেষ্টিত হয়েছে দেখে সঞ্জয় ও চার জন যোদ্ধা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ধৃষ্টদ্যুম্নের সৈন্যদের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলেন, কিন্তু অর্জুনের বাণে নিপীড়িত হয়ে অবশেষে যুদ্ধে বিরত হলেন। সাত্যকির প্রহারে সঞ্জয়ের বর্ম বিদীর্ণ হোলো, তিনি মূৰ্ছিত হলেন, তখন সাত্যকি তাকে বন্দী করলেন।
দুর্মর্ষণ শুতান্ত জৈত্র প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের দ্বাদশ পুত্র ভীমের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করলেন, কিন্তু সকলেই নিহত হলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, ভীম ধৃতরাষ্ট্রের প্রায় সকল পুত্রকেই বধ করেছেন, বাকি দুর্যোধন ও সুদর্শন অবশিষ্ট আছে তারাও আজ নিহত হবে। শকুনির পাঁচ শত ঘোড়া, দুই শত রথ, এক শত হাতি ও এক হাজার পদাতিক, এবং কৌরবপক্ষে অশ্বত্থামা কৃপ সুশর্মা শকুনি উলূক ও কৃতবর্মা এই ছয়জন বীর অবশিষ্ট আছেন। দুর্যোধনের এর অধিক বল নেই। মূঢ় দুর্যোধন যদি যুদ্ধ থেকে না গালায় তবে তাকে নিহত বলেই জানবে।
তারপর অর্জুন ত্রিগর্তদেশীয় সত্যকর্মা সত্যেষু সুশর্মা, সুশর্মার পঁয়তাল্লিশ জন পুত্র, এবং তাঁদের অনুচরদের বিনষ্ট করলেন। দুর্যোধনের ভাই সুদর্শন ভীম কর্তৃক নিহত হলেন। শকুনি, তাঁর পুত্র উলূক, এবং তাঁদের অনুচরগণ মৃত্যুপণ কোরে পাণ্ডবদের প্রতি ধাবিত হলেন। সহদেব ভল্লের আঘাতে উলুকের শিরচ্ছেদ করলেন। শকুনি ক্রন্দনরত অবস্থায় যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং একটি ভীষণ শক্তি অস্ত্র সহদেবের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সহদেব বাণদ্বারা সেই শক্তি ছেদন কোরে ভল্লের আঘাতে শকুনির মাথা কেটে ফেললেন। শকুনির অনুচরগণও অর্জুনের হাতে নিহত হোলো।
______________
(ক্রমশ)