মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৫৮
সপ্তদশ দিনের যুদ্ধে অর্জুন কর্তৃক কর্ণ বধ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
সপ্তদশ দিনের যুদ্ধে অর্জুন কর্তৃক কর্ণ বধ
দুঃশাসনকে বধের পর ভীম ধৃতরাষ্ট্রের আরও দশ পুত্রকে ভল্লের আঘাতে যমালয়ে পাঠালেন। কর্ণের পুত্র বৃষসেন প্রবল বিক্রমে পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের সঙ্গে বহুক্ষণ যুদ্ধ কোরে অর্জুনের বাণে নিহত হলে, পুত্রশোকার্ত কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের মতো অর্জুন ও কর্ণের যুদ্ধ দেখে সমস্ত ভুবন যেন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই বীরের পক্ষপাতী হোলো। নক্ষত্রসমেত আকাশ, আদিত্যগণ, অসুর, রাক্ষস, প্রেত, পিশাচ, বৈশ্য, শূদ্র ও সংকর জাতি, শৃগাল, কুকুর, সাপ প্রভৃতি সকলে কর্ণের পক্ষে গেলেন। অপর দিকে পৃথিবী, নদী, সমুদ্র, পর্বত, বৃক্ষাদি, বাসুকি প্রভৃতি নাগগণ, মাঙ্গলিক পশুপাখি, দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিগণ অর্জুনের পক্ষ নিলেন।
ব্রহ্মা, মহাদেব ও ইন্দ্রাদি দেবগণও যুদ্ধ দেখতে এলেন। ইন্দ্র ও সূর্য নিজ নিজ পুত্রের জয় কামনায় বিবাদ করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ও মহাদেব বললেন, অর্জুনের জয় হবে তাতে সন্দেহ নেই, কারণ ইনি খাণ্ডবদাহ করে অগ্নিদেবকে তৃপ্ত করেছিলেন, স্বর্গে ইন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন, কিরাতরূপী মহাদেবকে তুষ্ট করেছিলেন এবং স্বয়ং বিষ্ণু এঁর সারথি। মহাবীর কর্ণ বসুলোকে বা বায়ুলোকে যান, কিংবা ভীষ্ম ও দ্রোণের সঙ্গে স্বর্গে থাকুন, কিন্তু অর্জুনই বিজয়লাভ করুন।
অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, আজ তুমি কর্ণপত্নীদের বিধবা দেখবে। ঋণমুক্ত হয়ে অভিমন্যুর মা সুভদ্রা, তোমার পিসি কুন্তী, দ্রৌপদী এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আজ তুমি আনন্দ সংবাদ দেবে।
কর্ণ ও অর্জুন পরস্পরের প্রতি নানাপ্রকার ভয়ানক মহা অস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন। উভয়পক্ষের হাতি ঘোড়া রথ ও পদাতিক সৈন্য বিধ্বস্ত হতে থাকল। অর্জুনের বাণের আঘাতে অসংখ্য কৌরবযোদ্ধা প্রাণত্যাগ করলেন। তখন অশ্বত্থামা দুর্যোধনের হাত ধরে বললেন, দুর্যোধন প্রসন্ন হও, পাণ্ডবদের সঙ্গে বিরোধ ত্যাগ করো, যুদ্ধকে বন্ধ করো। আমি বারণ করলে অর্জুন নিবৃত্ত হবেন, কৃষ্ণও বিরোধ চান না। সন্ধি করলে পাণ্ডবরা সর্বদাই তোমার অনুগত হয়ে থাকবেন। তুমি যদি শান্তি কামনা করো তবে আমি কর্ণকেও নিরস্ত করবো। দুর্যোধন দুঃখিতমনে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কথা সত্য, কিন্তু দুর্মতি ভীম বাঘের মতো দুঃশাসনকে বধ কোরে যা বলেছে তা তুমিও শুনেছ, অতএব শান্তি কি কোরে হবে? পূর্বের বহু শত্রুতা স্মরণ কোরে পাণ্ডবরা আমাকে বিশ্বাস করবে না। কর্ণকেও তোমার বারণ করা উচিত নয়। আজ অর্জুন অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে আছে, কর্ণ তাকে বধ করবেন।
অর্জুন ও কর্ণ আগ্নেয়, বারুণ, বায়ব্য প্রভৃতি নানা অস্ত্র পরস্পরের প্রতি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। অর্জুনের ইন্দ্র অস্ত্র কর্ণের ভার্গব অস্ত্রে প্রতিহত হয়েছে দেখে ভীম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তোমার সামনেই পাপী কর্ণের বাণে বহু পাঞ্চাল বীর কেন নিহত হলেন? তুমিই বা তার দশটা বাণে বিদ্ধ হলে কেন? তুমি যদি না পারো তবে আমিই তাকে গদাঘাতে বধ করবো। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, আজ তোমার সকল অস্ত্র কর্ণের অস্ত্রে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? তুমি কি মোহগ্রস্ত হয়েছ তাই কৌরবদের আনন্দধ্বনি শুনতে পাচ্ছ না? যে শক্তিতে তুমি রাক্ষস ও অসুরদের বধ করেছিলে সেই শক্তিতে আজ তুমি কর্ণকেও বধ করো, নতুবা আমার সুদর্শন চক্র দিয়ে কর্ণের মাথা কেটে ফেলো।
অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, কর্ণের বধ এবং লোকের মঙ্গলের জন্য আমি এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিক্ষেপ করবো, তুমি অনুমতি দাও, দেবগণও অনুমতি দিন। এই বলে অর্জুন ব্রহ্মাকে নমস্কার কোরে ব্রহ্ম অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, কিন্তু কর্ণ সেই অস্ত্র প্রতিহত করলেন। ভীমের উপদেশে অর্জুন আর এক ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। তা থেকে শত শত শূল, কুঠার, চক্র, নারাচ বেরিয়ে এসে শত্রুসৈন্য বধ করতে লাগল। এই সময়ে যুধিষ্ঠির সোনার বর্ম পরে কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধ দেখতে এলেন। চিকিৎসদের ঔষধের গুণে তিনি বাণের ক্ষত থেকে মুক্ত ও বেদনাহীন হয়েছিলেন।
আত্যধিক জোরে আকর্ষণ করায় অর্জুনের গাণ্ডীবধনুর গুণ ছিঁড়ে গেল, সেই সুযোগে কর্ণ এক শত ক্ষুদ্রক বাণে অর্জুনকে ঢেকে ফেললেন এবং কৃষ্ণকেও ষাটটি নারাচ দিয়ে বিদ্ধ করলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন পরাজিত হয়েছেন মনে কোরে কৌরবসৈন্য হাততালি দিতে লাগল। গাণ্ডীবে নূতন গুণ পরিয়ে অর্জুন মূহুর্তের মধ্যে অসংখ্য বাণ নিক্ষেপ কোরে অন্ধকার কোরে ফেললেন এবং কর্ণ, শল্য ও সমস্ত কৌরবযোদ্ধাকে আহত কোরে কর্ণের সমস্ত রক্ষক যোদ্ধাদের বিনষ্ট করলেন। বাকি কৌরবীরগণ কর্ণকে ফেলে পালাতে লাগলেন, দুর্যোধনের অনুরোধেও তারা রইলেন না।
খাণ্ডবদাহের সময় অর্জুন যার মাকে বধ করেছিলেন সেই তক্ষকপুত্র অশ্বসেন এতদিন পাতালে শুয়েছিল। রথ, ঘোড়া ও হাতির পায়ের চাপে ভূতল কাঁপতে থাকায় অশ্বসেন উঠে পড়ল এবং মাতৃবধের প্রতিশোধ নেবার জন্য বাণের রূপ ধারণ কোরে কর্ণের তূণে ঢুকে থাকল। ইন্দ্র ও লোকপালগণ হাহাকার করে উঠলেন। কর্ণ না জেনেই সেই বাণ তার ধনুতে যোগ করলেন। শল্য বললেন, এই বাণে অর্জুন আহত হবে না, তুমি এমন বাণ নিক্ষেপ করো যাতে তাঁর মৃত্যু হয়। কর্ণ শল্যের কথা না শুনে সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ সশব্দে নিক্ষিপ্ত হয়ে আকাশপথে জ্বলতে জ্বলতে যেতে লাগল। তখন কৃষ্ণ তার পায়ের চাপে অর্জুনের রথ মাটিতে এক হাত বসিয়ে দিলেন। সেই নাগবাণের আঘাতে অর্জুনের সোনার মুকুট মাথা থেকে পড়ে গেল।
শররূপী মহানাগ অশ্বসেন পুনর্বার কর্ণের তূণে প্রবেশ করতে গেলো। কর্ণের প্রশ্নের উত্তরে সে বললে, তুমি না দেখেই আমাকে মোচন করেছিলে সেজন্য অর্জুনের মস্তক চূর্ণ করতে পারিনি; আবার আমাকে নিক্ষেপ করো, তোমার আর আমার শত্রু আর্জুনকে বধ করব। অশ্বসেনের ইতিহাস শুনে কর্ণ বললেন, অন্যের শক্তি অবলম্বন কোরে আমি জয়ী হতে চাই না। নাগ, যদি শত অর্জুনকেও বধ করা যায়, তথাপি এই শর আমি আবার প্রয়োগ করবো না, অতএব তুমি চলে যাও। তখন অশ্বসেন অর্জুনকে মারবার জন্য নিজেই ধাবিত হোলো। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তুমি এ মহানাগকে বধ করো, খাণ্ডবদহনকালে তুমি এর শত্রুতা করেছিলে। ওই দেখো, জ্বলন্ত উল্কার মতো তোমার দিকে আসছে। অর্জুন ছয়টি বাণের আঘাতে অশ্বসেনকে কেটে ভূপাতিত করলেন। তখন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ স্বয়ং দুই হাতে টেনে অর্জুনের রথ ভূমি থেকে তুললেন।
অর্জুন শরাঘাতে কর্ণের স্বর্ণকিরীট, কুণ্ডল ও উজ্জ্বল বর্ম বহু খণ্ডে কেটে ফেললেন এবং বর্মহীন কর্ণকে ক্ষতবিক্ষত করলেন। জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ন্যায় কর্ণ বেদনা ভোগ করতে লাগলেন। তারপর অর্জুন যমদণ্ডতুল্য বাণ তার বুকে বিদ্ধ করলেন। কর্ণের মুষ্টি শিথিল হোলো, তিনি ধনুর্বাণ ত্যাগ কোরে অবশ হয়ে টলতে লাগলেন। সৎস্বভাব পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন সেই অবস্থায় কর্ণকে মারতে ইচ্ছা করলেন না। তখন কৃষ্ণ ব্যস্ত হয়ে আর্জুনকে বললেন, তুমি থামলে কেন? বুদ্ধিমান লোক দুর্বল বিপক্ষকে অবসর দেন না, বিপদগ্রস্ত শত্রুকে বধ কোরে ধর্ম ও যশ লাভ করেন। তুমি জলদি করো, নতুবা কর্ণ সবল হয়ে আবার তোমাকে আক্রমণ করবেন। কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুন শরাঘাতে কর্ণকে আচ্ছন্ন করলেন, কর্ণও প্রকৃতিস্থ হয়ে কৃষ্ণার্জুনকে শরবিদ্ধ করতে লাগলেন।
কর্ণের মৃত্যু আসন্ন হওয়ায় কাল অদৃশ্যভাবে তাকে ব্রাহ্মণের শাপের বিষয় জানিয়ে বললেন, ভূমি তোমার রথচক্র গ্রাস করছে। তখন কর্ণ পরশুরামপ্রদত্ত মহা আস্ত্রের বিষয় ভুলে গেলেন, তার রথও ভূমিতে প্রবেশ কোরে ঘুরতে লাগল। কর্ণ বিষণ্ণ হয়ে দুই হাত নেড়ে বললেন, ধর্মজ্ঞগণ সর্বদাই বলেন যে ধর্ম ধার্মিককে রক্ষা করেন। আমরা যথাযোগ্য ধর্মাচরণ করি, কিন্তু দেখছি ধর্ম ভক্তগণকে রক্ষা না কোরে বিনাশ করেন। তার পর কর্ণ অনবরত শরবর্ষণ করে অর্জুনের ধনুর্গুণ বারবার কাটতে লাগলেন। কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন এক ভয়ংকর দিব্যাস্ত্র তার ধনুতে যোজনা করলেন। এই সময়ে কর্ণের রথচক্র আরও ভূমিতে প্রবিষ্ট হোলো। ক্রোধে অশ্রুপাত কোরে কর্ণ আর্জুনকে বললেন, মুহূর্তকাল অপেক্ষা করো, দৈবক্রমে আমার রথের চক্র ভূমিতে বসে গেছে। তুমি কাপুরুষের অভিসন্ধি ত্যাগ করো, সাধুস্বভাব বীরগণ দুর্দশাপন্ন বিপক্ষের প্রতি অস্ত্রক্ষেপণ করেন না। তোমাকে বা বাসুদেবকে আমি ভয় করি না, তুমি মহাকুলবিবর্ধন ক্ষত্রিয়পুত্র, ধর্মোপদেশ স্মরণ কোরে ক্ষণকাল ক্ষমা করো।
কৃষ্ণ কর্ণকে বললেন, অদৃষ্টের বশে এখন তুমি ধর্ম স্মরণ করছ। নীচ লোকে বিপদে পড়লে দৈবের নিন্দা করে, নিজের কুকর্মের নিন্দা করে না। তুমি যখন দুর্যোধন দুঃশাসন আর শকুনির সঙ্গে মিলে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে দূতসভায় আনিয়েছিলে তখন তোমার ধর্ম স্মরণ হয়নি। যখন পাশা খেলায় নিপুণ শকুনি অনভিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে ছলনা কোরে জয় করেছিলেন তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তোমার সম্মতিতে দুর্যোধন ভীমকে বিষযুক্ত খাবার খাইয়েছিল, জতুগৃহে ঘুমন্ত পাণ্ডবদের যখন পুড়িয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল, দুঃশাসন রজস্বলা দ্রৌপদীকে চুল ধরে টেনে আনলে যখন তুমি উপহাস করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? তেরো বছর পার হলেও তোমরা যখন পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দাওনি, বহু মহারথের সঙ্গে মিলে যখন বালক অভিমন্যুকে হত্যা করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? এই সব সময়ে যদি তোমার ধর্ম না থাকে তবে এখন ধর্ম ধর্ম করছ কেন? আজ যতই ধর্মাচরণ করো তুমি নিষ্কৃতি পাবে না।
বাসুদেবের কথা শুনে কর্ণ লজ্জায় অধোবদন হলেন, কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি ভীষণ ক্রোধে ধনু তুলে নিয়ে অর্জুনকে মারবার জন্য একটি ভয়ংকর বাণ যোজনা করলেন। বিশাল সাপ যেমন উঁই-এর ঢিপিতে প্রবেশ করে, কর্ণের বাণ তেমন অর্জুনের বাহুতে প্রবেশ করলো। অর্জুনের মাথা ঘুরতে লাগল, দেহ কাঁপতে লাগল, হাত থেকে গাণ্ডীব পড়ে গেল। এই অবসরে কর্ণ রথ থেকে লাফিয়ে নেমে দুই হাত দিয়ে রথচক্র তোলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তখন অর্জুন চেতনা লাভ করে ক্ষুরপ্র বাণ দিয়ে কর্ণের রত্নভূষিত ধ্বজ কেটে ফেললেন। তারপর তিনি তূণ থেকে বজ্র অগ্নি ও যমদণ্ডের ন্যায় করাল অঞ্জলিক বাণ তুলে নিয়ে বললেন, যদি আমি তপস্যা ও যজ্ঞ কোরে থাকি, গুরুজনকে সন্তুষ্ট কোরে থাকি, সুহৃদগণের উপদেশ শুনে থাকি, তবে এই বাণ আমার শত্রুর প্রাণহরণ করুক।
তারপর অর্জুন সেই অঞ্জলিক বাণ দ্বারা কর্ণের মাথা কেটে ফেললেন। রক্তবর্ণ সূর্য যেমন অস্তাচলে ডুবে যান, তেমন সেনাপতি কর্ণের মস্তকহীন শরীর ভূমিতে পতিত হোলো। সকলে দেখল, কর্ণের নিপাতিত দেহ থেকে একটি তেজ আকাশে উঠে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করলো। কৃষ্ণ অর্জুন ও অন্যান্য পাণ্ডবগণ হৃষ্ট হয়ে শঙ্খধ্বনি করলেন, পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণ সিংহনাদ ও তুর্যধ্বনি কোরে বস্ত্র ও বাহু নাড়াতে লাগল। বীর কর্ণ রক্তাক্তদেহে শরাচ্ছন্ন হয়ে ভূমিতে পড়ে আছেন দেখে মদ্ররাজ শল্য ধ্বজহীন রথ নিয়ে চলে গেলেন।
______________
(ক্রমশ)