মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৫৩
অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের তিরস্কার
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের তিরস্কার
কৃষ্ণের কথায় যুধিষ্ঠিরের কাছে যেতে যেতে ভীমকে দেখে অর্জুন খবর জানতে চাইলেন যুধিষ্ঠির কোথায়? ভীম বললেন, কর্ণের বাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তিনি এখান থেকে চলে গেছেন, হয়তো কোনও প্রকারে বেঁচে উঠবেন। অর্জুন বললেন, আপনি শীঘ্র গিয়ে তাঁর অবস্থা জানুন, আমি এখানে শত্রুদের অবরুদ্ধ করে রাখবো। ভীম বললেন তুমিই তাঁর কাছে যাও, আমি গেলে সবাই আমাকে ভীত বলবে। অর্জুন বললেন, সংশপ্তকদের বধ না করে আমি যেতে পারি না। ভীম বললেন, আমিই সমস্ত সংশপ্তকের সঙ্গে যুদ্ধ করবো, তুমি যাও।
শত্রুসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য ভীমকে রেখে এবং তাকে উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ দ্রুতবেগে যুধিষ্ঠিরের শিবিরে রথ নিয়ে এলেন। যুধিষ্ঠির একা শুয়ে ছিলেন, কৃষ্ণ ও অর্জুন তাঁর কাছে গেলেন। কর্ণ নিহত হয়েছে ভেবে যুধিষ্ঠির খুশি হয়ে স্বাগত সম্ভাষণ করে বললেন, তোমাদের দুজনকে দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি, তোমরা কর্ণকে বধ করেছ তো? সাক্ষাৎ যমের মতো কর্ণ আজ আমার সঙ্গে ঘোর যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু তাতে আমি কাতর হইনি। সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি বীরগণকে জয় কোরে তাদের সামনেই কর্ণ আমাকে পরাস্ত করেছিল, আমাকে বহু কটু কথা বলেছিল। অর্জুন, আমি ভীমের পরাক্রমে জীবিত আছি, এ আমি সইতে পারছি না। কর্ণের ভয়ে আমি তেরো বছর রাতে ঘুমাতে পারিনি, দিনেও স্বস্তি পাইনি, সব সময়ে আমি চারদিকে কর্ণকে দেখি। সে আমাকে ঘোড়া ও রথ সমেত জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে, আমার এই ধিকৃত জীবনে রাজ্যে কি প্রয়োজন? ভীষ্ম, দ্রোণ আর কৃপের কাছে আমি যে লাঞ্ছনা পাইনি আজ কর্ণের কাছে তা পেয়েছি। তাই জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কিভাবে কর্ণকে বধ কোরে নিরাপদে ফিরে এসেছ তা বলো। কর্ণ তোমাকে বধ করবে এই আশাতেই ধৃতরাষ্ট্র ও তার পুত্রেরা কর্ণের সম্মান করতেন। সেই কর্ণ তোমার হাতে কি করে নিহত হোলো? যে দ্রৌপদীকে বলেছিল, তুমি দুর্বল পতিত দীনপ্রকৃতি পাণ্ডবদের ত্যাগ করছ না কেন? যে দুরাত্মা পাশা খেলার সভায় হাসতে হাসতে দুঃশাসনকে বলেছিল, দ্রৌপদীকে সবলে ধরে নিয়ে এসো, সেই পাপী কর্ণের মৃতদেহ যুদ্ধভূমিতে শুয়ে আছে তো?
অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমি সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম সেই সময়ে অশ্বত্থামা আমার সামনে এসেছিল। আটটি গাড়ি তাঁর বাণ বহন করছিল, আমার সঙ্গে যুদ্ধের সময় সে সেই সমস্ত বাণই নিক্ষেপ করলো। তবুও আমার বাণের আঘাতে তার দেহ শজারুর মতো হোলো, সে রক্তাক্ত দেহে কর্ণের সৈন্যদের মধ্যে আশ্রয় নিলো। তখন কর্ণ পঞ্চাশ জন রথীকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে এলো। আমি কর্ণের সহচরদের বিনষ্ট করে সত্বর আপনাকে দেখবার জন্য এসেছি। আমি শুনেছি, অশ্বত্থামা ও কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে আপনি আহত হয়েছেন, সে কারণে উপযুক্ত সময়েই আপনি কর্ণের কাছ থেকে চলে এসেছেন। যুদ্ধের সময়ে আমি কর্ণের আশ্চর্য ভার্গব অস্ত্র দেখেছি, কর্ণের আক্রমণ সইতে পারে এমন যোদ্ধা সৃঞ্জয়গণের মধ্যে নেই। আপনি আসুন, দেখবেন আজ আমি রণস্থলে কর্ণের সাথে যুদ্ধ করবো। যদি আজ কর্ণকে সবান্ধবে বধ না করি তবে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীর যে কষ্টকর গতি হয়, আমার যেন তাই হয়। আপনি আশীর্বাদ করুন, যেন আমি কর্ণ ও শত্রুগণকে সসৈন্যে বধ করতে পারি।
কর্ণ জীবিত আছে জেনে আহত যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনকে বললেন, তোমার সৈন্যরা পালিয়েছে, তুমি তাদের পিছনে ফেলে এসেছ। কর্ণকে বধ করতে অক্ষম হয়ে তুমি ভীমকে ত্যাগ করে ভীত হয়ে চলে এসেছ। অর্জুন, তুমি কুন্তীর গর্ভকে অপমান করেছ। আমরা তোমার উপর অনেক আশা রেখেছিলাম, কিন্তু অধিক ফুলে ভরা গাছ যেমন ফল দেয় না তেমন আমাদের তোমার প্রতি আশা বিফল হয়েছে। ভূমিতে রোপিত বীজ যেমন বৃষ্টির প্রতীক্ষায় জীবিত থাকে, আমরাও তেমন রাজ্যলাভের আশায় তেরো বছর তোমার উপর নির্ভর করেছিলাম, কিন্তু এখন তুমি আমাদের সকলকেই নরকে ডুবিয়েছ। তোমার জন্মের পর কুন্তী আকাশবাণী শুনেছিলেন, এই পুত্র ইন্দ্রের মতো বিক্রমশালী ও সর্বশত্ৰুজয়ী হবে, মদ্ৰ কলিঙ্গ ও কেকয়গণকে জয় করবে, কৌরবগণকে বধ করবে। শতশৃঙ্গ পর্বতের শিখরে তপস্বিগণ এই দৈববাণী শুনেছিলেন, কিন্তু তা সফল হোলো না, অতএব দেবতারাও অসত্য বলেন। আমি জানতাম না যে তুমি কর্ণের ভয়ে ভীত। কৃষ্ণ যার সারথি সেই কপিধ্বজ রথে চড়ে এবং সোনার খড়্গ ও গাণ্ডীব ধনু ধারণ কোরে তুমি কর্ণের ভয়ে পালিয়ে এলে! দুরাত্মা, তুমি যদি কৃষ্ণকে ধনু দিয়ে নিজে সারথি হতে তবে দেবরাজ ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন তেমন কৃষ্ণ কর্ণকে বধ করতেন। তুমি যদি কর্ণকে আক্রমণ করতে অসমর্থ হও তবে তোমার চেয়ে অধিক অস্ত্রবিশারদ অন্য রাজাকে গাণ্ডীব ধনু দাও। দুরাত্মা, তুমি যদি পঞ্চম মাসে গর্ভচ্যুত হতে কিংবা কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ না করতে ভালো হতো, তা হলে তোমাকে যুদ্ধ থেকে পালাতে হতো না। তোমার গাণ্ডীবকে ধিক, তোমার শক্তি ও বাণসমূহকে ধিক, তোমার অগ্নিদত্ত কপিধ্বজ রথকেও ধিক।
______________
(ক্রমশ)