ঝরাপাতা
পর্ব - ২৯
💜💕💜💕💜💕💜
- "ও মা ! কেন রে?" মিলি সোজা হয়ে বসেছে পলাশের কথায়।
- "তুই গেলি না কেন? তুই না গেলে কিছু ভালো লাগে?"
- "এটা একটা কথা হল? তোরা ভালোবাসিস আমি জানি। আমার অসুখের জন্য তোরা কত হেল্প করেছিস, বারবার আমার খবর নিয়েছিস, বাড়িতে দেখতে এসেছিস। তোরা অন্ততঃ বুঝবি না, আমার অবস্থা তোদের মতো না? একটা সেমিস্টার পিছিয়ে আছি। রনিদা হেল্প করছে বলে......"
- "রনিদা তোকে কি এক্সট্রা হেল্প করে? ও একে আমাদের কলেজের প্রোফেসর না, সাবজেক্টও আলাদা। ম্যাডাম তো আমাদের কলেজের। আমি বললেই তোকে পড়াতে রাজি হতেন। আর বেকার ওর বাইকে ঘুরে বেড়াস কেন? আমি আছি, অঙ্কুর আছে...."
- "তোরা তো আছিসই। তোরা আমার বন্ধু। তোরা তো হেল্প করবিই। রনিদা বাইরের লোক হয়েও হেল্প করছে...."
- "উফ, ওর কথা বন্ধ কর তো। এর মধ্যে একদিন প্ল্যান কর। তুই আমাদের সঙ্গে সিনেমায় যাবি। কবে যাবি বল।"
মিলি বোঝে, বন্ধুরা অভিমান করেছে। ও আশ্বাস দিতে বলে, "যাব যাব। পরীক্ষাটা হয়ে যাক। সবাই মিলে সিনেমায় যাব। এখন বাড়ি থেকে ছাড়বে না রে।"
- "বললে হল? একদিনের জন্য যাবি, চল না অদ্রিজা। আমার রিকোয়েস্টেও যেতে পারিস না?"
পলাশকে কি করে বোঝাবে ভেবে পায়না, হয়ত সব বন্ধুরাই আশা করছে, ও একদিন সবার সঙ্গে ঘুরতে যাবে। এই সংকটের মধ্যে আরেকটা কল ঢুকছে, কঁক কঁক আওয়াজে কান থেকে নামিয়ে দেখে, রনিই ফোন করছে।
- "একদিন ঠিক যাব। মাকে বলি। শোন না, আমার একটা ফোন আসছে। তোর সঙ্গে কাল কলেজে কথা বলি?" পলাশের উত্তরের আগেই মিলি ফোন কেটে দেয়। ততক্ষণে এনগেজড টোন শুনে রনিও ফোন কেটে দিয়েছে। মিলি এক মুহূর্ত ভাবে, তারপর নিজেই ফোন করে রনিকে।
মিলির ফোন এনগেজড দেখেই অস্থির লাগছিল রনির। দাদা সবে ফিরেছে। এসময় দাদা বৌদি খানিকক্ষণ মায়ের সঙ্গে গল্প করে। তারপর মা বা বৌদি দোকানে পাঠালে দাদা একবার বেরোলে বেরোয়। নয়ত দুজন যাতে খানিকটা সময় কাটায়, ওদের একটু একলা ছাড়তে টুকাইকে রনি বা মা আটকে রাখে। তাই সময় বেশি নেই হাতে। মিলির ফোন কখন শেষ হবে কে জানে ! তারপর নিজে থেকে ফোন করবে কি? বারবার রনি ফোন করলে না বিরক্ত হয় ! এসব ভাবনার মধ্যেই মিলি ফোন করে।
রনির মন ভালো হয়ে গেছে মিলি নিজে তক্ষুণি ফোন করায়। রিসিভ করে বলে, "ব্যস্ত ছিলে? ডিস্টার্ব করলাম?"
- "না, না সেরকম ব্যস্ত কিছু না। ঐ বন্ধুরা আরেকদিন সিনেমায় যেতে বলছিল।"
- "তুমি কি বললে?"
- "বললাম পরীক্ষার পর যাব। ওরা এর মধ্যেই যেতে বলছিল, এইসব কথা হচ্ছিল।"
- "তাহলে তো ডিস্টার্বই করলাম। ওদের সঙ্গে কথা বলছিলে। পরে করব?"
- "না না, এখন ওদের সঙ্গে কথা বলব না। একই কথায় চাপাচাপি করছে। মা এখন সিনেমায় যেতে দেবে নাকি পড়া ফেলে? পরীক্ষার পরেই যেতে বলবে। মার সঙ্গে কথা বলে কাল ওদের বলে দেব।"
- "আমার জন্য আজ তোমার সিনেমায় যাওয়া হল না। সরি মিলি, সরি ওয়ানস এগেইন। আমি এরকম না, বিশ্বাস করো। তুমি মানে যতক্ষণ তুমি আমাকে তোমার মনের কথা কিছু বলছিলে না, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। তাতেই আরকি মানে তোমাকে তখন...আর এরকম হবে না, দেখো। তুমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গেলে আমি কিচ্ছু মনে করব না।"
- "তুমি থামবে? আর কতবার সরি বলবে? এটা বলবে বলে তখন ফোন করবে বললে? সব কথা তো হল দুপুরে।" মিলিই রনিকে থামায়।
আর মিলির কাছে আশকারা পেতেই রনির মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে, "কি কথা হল?" ভালোমানুষ মুখ করে প্রশ্ন করে। আরও একটা সি *গা *রে *ট ধরিয়েছে মনের শান্তিতে।
- "কি কথা হল মানে?" মিলি হতভম্ব ! "তোমার সঙ্গেই তো কথা হল। তুমি আমাকে বললে, তোমার কেন রাগ হয়েছিল। এই এখনকার কথাগুলো বললে। সব মিটে গেল। এখন আবার কি কথা জানতে চাইছ যে?"
- "আরও কিছু বলেছিলাম সঙ্গে। সেটা বাদ দিচ্ছ কেন?" রনি আয়েশ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলে।
মিলি এবার বুঝতে পেরেছে ঠাট্টাটা। ওর মুখ বিনা সিঁদুরেই দশমীর সন্ধ্যার মতো লাল হয়ে গেছে।
- "কি হল, বলো সব কথা। দুপুরে যা যা বলেছিলাম, তার মধ্যে এখন যেটা বলিনি, সেটা কি?" রনির ঠোঁট আর চোখের কোণায় হাসিটা ছড়িয়ে পড়ে। মিলির লজ্জারুণ মুখটা কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে।
- "জানি না যাও। এরকম করলে ফোন ছেড়ে দিচ্ছি।" মিলি আরও লজ্জা পেয়ে যায়।
- "এ্যাই না, ফোন ছেড়ো না প্লিজ। মজা করছিলাম। এ্যাই মিলি?" রনি ঝাঁপিয়ে পড়ে।
- "হুঁ বলো।"
- "ঘরে কি করছ? একবার বাইরে এসো না। আর ঠাট্টা করব না, প্রমিস। একবার একটু বারান্দায় এসো।" মিলি বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে আসে। বারান্দার পর সামনে ছোটো একফালি জমি দু বাড়িতেই, গাছপালা, বাগান। মাঝখানে রাস্তা। খুব যে স্পষ্ট একজন আরেকজনকে দেখতে পায়, তা নয়। তবুও মিলি ভীষণ লজ্জায় প্রায় ফিসফিস করে ফোনের কানে কানে বলে, "আমি ভিতরে যাচ্ছি। কেউ দেখতে পেলে....."
- "কেউ দেখবে না, দাঁড়াও তো। তোমার বারান্দায় যেন তুমি দাঁড়াও না, ফোন করো না? তাও যদি আমি না জানতাম ! আর আমি তো যতবার সি *গা *রে *ট খাই, এই ব্যালকনিতেই খাই। কেউ দেখলেও কিছু ভাববে না।"
- "তুমি খুব সি *গা *রে *ট খাও। আমি দেখি তো। এত ভালো না।"
- "হুম, জানি। এতটা খেতাম না। মাঝখানে টেনশনে বেড়েছে। কমিয়ে দেব। তুমি যখন আমার কাছে চলে আসবে, তখন কমিয়ে দেব।"
- "তুমি এসবই বলবে?"
- "এ্যাই এটা কি খারাপ কথা বলেছি? তুমিও জানো আমি ভুল কিছু বলিনি। আজ আমাদের মধ্যে সব কথা হয়ে গেছে। ভালোবাসলে তারা একসঙ্গেই তো থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এখন পড়াশোনা শেষ করো, পরীক্ষার কথা ভাবো। এসব কথা পরে বলব।"
রনির অন্য হাতটায় টান পড়ে, "কাকাই, মাম বলেছে, বেড়ু নিয়ে যেতে। চলো না।" টুকাই কাকাইয়ের হাত ধরে ঝুলে পড়েছে। রনির ঐ হাতেই সি *গা *রে *ট। ও তাড়াতাড়ি হাত ছাড়ায়। সি *গা *রে *টটা বাগানে ছুঁড়ে ফেলে টুকাইয়ের হাত ধরে, "টুকুস, ঠাম কি করছে দেখো তো সোনা। আমি আসছি।"
মিলি ওপার থেকে সব শুনছিল ফোনে, দেখতেও পাচ্ছিল। হাসতে হাসতে বলে, "বেশ হয়েছে। কেমন জব্দ একজন !" রনিও হেসে ফেলে। টুকাই দুই বারান্দায় দুই মূর্তিমানকে দেখে নিয়ে বাবার কাছে দৌড়য়।
বনি তখন পিউর গলা জড়িয়ে ধরে সামনের রবিবার সবাই সিনেমায় যাওয়ার প্ল্যান করছে। ফস করে ঢুকে ঘরের মাঝখানে টুকাই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। বনি আর পিউ একলাফে দুজন দুদিকে ছিটকে গেছে। বনি তাড়াতাড়ি টুকাইকে কোলে নিতেই টুকাই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, "আমাকে আদর না করে মামকে আদর করছিলে কেন?"
- "মামকে? কই না, মামকে আদর করিনি তো। মাম পড়ে যাচ্ছিল, তাই ধরেছিলাম। তা টুকাইবাবু বেড়ু যাবে বলে ফিরে এল কেন?" পিউ কোনোমতে হাসি চেপে আছে। ও হাসলেই বনি হেসে ফেলবে। ব্যস, পরে ওকে আচ্ছা ঝাড়বে বনি।
- "বেড়ু যাব তো। কাকাই ফোনে মিলি পিসির সঙ্গে গল্প করছে, এট্টু পরে আসছে বলল।" এবার দুজনেরই চোখ গোল।
বনি ছেলেকে বলে, "কাকাই বলল তোকে মিলি পিসির সঙ্গে কথা বলছে?"
- "আমাকে তো ঠামের কাছে যেতে বলল। আর মিলি পিসির সঙ্গে কথা বলছিল। মিলি পিসি ওদের বাড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল।"
- "আ চ ছা, এই গল্প বেটা ! টুকাইসোনা ঠামের কাছে যাও তো, কাকাই আসবে।" বনি ছেলেকে কোল থেকে নামায়। সে বেচারা এবার ঠামের কাছে দৌড় দিতেই বৌকে বলে, "চলো চলো, এ্যাটাক। কখন ফোন ছেড়ে দেবে। হাতে নাতে ধরতে হবে।"
রনি ওদিকে ফোনে বলে, "বেশ হয়েছে না? আচ্ছা, এটার শোধ পরে নেব। শোনো না, এখন বেরোব টুকাইকে নিয়ে। একবার আসবে? দেখা হলে কথা বলতাম।"
- "এখন? এখন কি করে বেরোব? সারাদিন বাইরে ছিলাম, বাবা ফেরার সময় হয়ে গেছে।"
- "ওহ আচ্ছা। শোনো না, কাল একটু আধঘণ্টা আগে রেডি হয়ে যেও। আমাকে একবার ফোন কোরো, আমি বেরিয়ে যাব। তাহলে একটু কোথাও কথা বলব।"
বনি এসে পিছন থেকে সোজা মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে ওতেই বলে, "মিলি এখন পালা। আগে এটাকে পালিশ করি, তোর ব্যবস্থা পরে হচ্ছে।"
- "এ্যাই দাদা, এটা কি হচ্ছে?" রনি ধরা পড়াটা চাপা দিতে চায়।
- "ভুল বললে বৎস, এটা আমার ডায়লগ। তুমি উত্তর দেবে। মিলিরও লেগপুল হবে, সেটা পরের ইনস্টলমেন্টে।" মিলির ধড়ে প্রাণ এসেছে, যাক বনিদা মজা করছে, রাগ করেনি।
রনি ওদিকে ফোন কাড়ার চেষ্টার সঙ্গে বলে যাচ্ছে, "আরে ফোন দে না ! কাল কখন পড়া সেসব বলছিলাম। আমি নিয়ে যাব তো মিলিকে।"
- "মিলিকে তোর নিয়েই যেতে হবে না। আমি নিয়ে যাব ওকে।" যদিও মিলি সব কথাই শুনছে ফোনে, বনি ফোনটা কানে দেয়, "এ্যাই মিলি, গেলি ঘরে? বলছি না এখন পালা। কার কাছে ধরা পড়বি। আমাদের মতো আরও অনেকে টের পাবে। যা ভাগ। কাল সকালে রেডি হয়ে থাকবি, আমি কলেজে নিয়ে যাব।"
বনি আর রনির চেহারা, মুখের আদল স্বভাব চরিত্র তো বটেই, গলার স্বরেও বেশ মিল আছে। হুবহু বা জমজ মনে হয় না, তবে ভাই ভাই বোঝা যায়। বনি যেই বলল, আমি কলেজে নিয়ে যাব, রনি যেহেতু কথাটা মিলিকে অনেকবার বলেছে, অন্য সম্বোধনে, এখন বনির কথায় মিলির মনে হল, রনিই বলল। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনের একটা পর্দা সরে গেল। বিকেল থেকে যে কথায় বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল, রনি ওকে তুই বলত। তুমি কবে বলা শুরু করল?
চলবে