Blessings of Harichand in Bengali Motivational Stories by SAKTI BISWAS books and stories PDF | হরিচাঁদের আশীর্বাদ

Featured Books
Categories
Share

হরিচাঁদের আশীর্বাদ

নদীর পাড় ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম—ঠাকুরনগর। সকালের কাক ডাকছে, মাঠে কৃষকেরা যাচ্ছে চাষ করতে। গ্রামের ভেতর দিয়ে ধুলো উড়ে যাচ্ছে। এই গ্রামেই বাস করে কৃষ্ণপদ। বয়স তার মাত্র বাইশ, কিন্তু চোখে মুখে এক অদ্ভুত জেদ আর সাহস। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হলেও সে জানে—“জন্ম দিয়ে মানুষ বড় হয় না, মন আর কর্ম দিয়েই বড় হতে হয়।”

কৃষ্ণপদ ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে হরিচাঁদ ঠাকুর আর গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাণী। মা বলতেন—
“বাবা, মতুয়া মানে ভয় পাওয়া নয়। আমরা সবাই সমান। হরিচাঁদ ঠাকুর আমাদের শিখিয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।”
কৃষ্ণপদ গ্রামে স্কুলে যেত। কিন্তু প্রায়ই সে অপমানিত হতো। অনেক সময় শিক্ষকেরা তাকে আলাদা বেঞ্চে বসতে দিতেন না, বন্ধুদের বাবা-মা তাকে তুচ্ছ করত। কৃষ্ণপদ কষ্ট পেত, কিন্তু হাল ছাড়ত না।
সে ভাবত—“আমরা কি তবে মানুষ নই? কেন এই বৈষম্য?”

বছর বছর এই অবহেলা তাকে আরও দৃঢ় করত। সে বই পড়তে শুরু করল, হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী পড়ল। সেখানে লেখা ছিল—
“মানুষ ভেদে নয়, কর্ম ভেদে বড়।”
এই বাক্য কৃষ্ণপদর মনে আগুন ধরিয়ে দিল।
একদিন এল সেই দিন—বারুণী স্নান। সারা পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া ভক্ত ঠাকুরনগরে ভিড় জমালেন। নদীর ঘাটে মানুষের ঢল, চারদিকে ভক্তির সুর। ঢোল, কাঁসর, করতাল বাজছে, সবাই একসাথে গাইছে—
“হরিবোল… হরিবোল… জয় হরিচাঁদ ঠাকুর।”

কৃষ্ণপদ ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। নামসংকীর্তনের ঢেউ যেন তার বুকের ভেতর ঢুকে পড়ল।
মেলার শেষে গুরুজী বললেন—
“মতুয়া সমাজ ভক্তির পাশাপাশি সংগ্রামেরও প্রতীক। শিক্ষা, ঐক্য, আর আত্মসম্মান আমাদের মূলধন। মনে রেখো, সমাজকে বদলাতে গেলে তোমাদের লড়াই করতে হবে।”

কৃষ্ণপদর মনে হলো—এই লড়াই তার নিজেরও লড়াই।

সেই দিন থেকেই কৃষ্ণপদ সিদ্ধান্ত নিল গ্রামে পরিবর্তন আনবে। দিনে সে খেতে যায় খেতে, মজুরি করে; আর সন্ধ্যায় বাচ্চাদের নিয়ে বসে।
তাদের অক্ষর শেখায়, গান শেখায়, গল্প বলে। তার কণ্ঠে প্রায়ই শোনা যেত—
“শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নেই। হরিচাঁদ ঠাকুর শিখিয়েছেন—বিদ্যা নাও, ঐক্যবদ্ধ হও, ভয়কে জয় করো।”

শুরুতে অনেকেই হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামবাসী দেখল, বাচ্চারা পড়াশোনায় এগোচ্ছে, অক্ষর চিনছে, গান গাইছে। প্রবীণরা বলল—
“এই ছেলে আমাদের গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে।”

একদিন শহরের বাজারে কৃষ্ণপদ আর কয়েকজন কাজ করতে গিয়েছিল। সেখানে এক ব্যবসায়ী তাচ্ছিল্যের সুরে বলল—
“তোমরা তো মতুয়া, তোমাদের কাজ শুধু নীচু কাজ করা।”
কৃষ্ণপদ এবার চুপ রইল না। সে সোজা তাকিয়ে বলল—
“আমরা মতুয়া মানেই মানুষ। তোমার মতোই মানুষ। কাজের দিকেই বড়ো ছোটো বোঝা যায়, জন্ম দিয়ে নয়।”

তার সাহসী কথায় সবার মুখ থমকে গেল। সেদিনের পর থেকে অনেকেই কৃষ্ণপদকে নতুন চোখে দেখতে শুরু করল।

গ্রামে এখন নতুন হাওয়া বইছে। তরুণ-তরুণীরা কৃষ্ণপদের সঙ্গে মিলে পড়াশোনায় মন দিল, গান-বাজনা শুরু হলো, এমনকি কিছু লোক নতুন করে ব্যবসা শুরু করল। গ্রামের মেয়েরা বলল—
“আমরা আর পিছিয়ে থাকব না, আমরাও পড়াশোনা করব।”

কৃষ্ণপদ বলল—
“হরিচাঁদ ঠাকুরের বাণী মনে রেখো—মানুষের ধর্ম মানবধর্ম। নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র—সবাই সমান।”

কয়েক বছর পরে রাজ্য থেকে শিক্ষামন্ত্রী এলেন গ্রাম ঘুরতে। দেখে অবাক হলেন—যে গ্রামে আগে অশিক্ষা আর বৈষম্য ছিল, এখন সেখানে শিক্ষা, ঐক্য আর আত্মবিশ্বাস।

মন্ত্রী কৃষ্ণপদকে ডেকে বললেন—
“তোমরা মতুয়ারা প্রমাণ করেছ, ঐক্য আর শিক্ষার আলো দিয়ে সমাজ বদলানো যায়। তোমাদের গ্রাম বাংলার এক উদাহরণ।”

গ্রামের মানুষ হাততালি দিয়ে উঠল। কৃষ্ণপদর চোখ ভিজে গেল।

সেই রাতে কৃষ্ণপদ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল—
“হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর—আপনাদের আশীর্বাদেই আমরা এই পরিবর্তন এনেছি। আমাদের সমাজ একদিন সারা বাংলার, সারা ভারতের গর্ব হয়ে উঠবে।”

তার কানে যেন ভেসে এল দূর থেকে নামসংকীর্তনের ধ্বনি—
“হরিবোল… জয় হরিচাঁদ… জয় গুরুচাঁদ…”

মতুয়া সমাজ শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, এটি মানুষের আত্মমর্যাদা, শিক্ষা ও ঐক্যের প্রতীক। কৃষ্ণপদের মতো হাজারো তরুণ আজও সমাজকে জাগিয়ে তুলছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে।
হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের বাণী আজও মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে।