Story of Mahabharat Part 134 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 134

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 134

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৩৪

চতুর্দশ দিনে অর্জুনের হাতে জয়দ্রথ বধ ও দুর্যোধনের ক্ষোভ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

চতুর্দশ দিনে অর্জুনের হাতে জয়দ্রথ বধ ও দুর্যোধনের ক্ষোভ

ভূরিশ্রবা নিহত হওয়ার পর অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, সূর্যাস্ত আসন্ন, জয়দ্রথের কাছে রথ নিয়ে চলো, আমি যেন প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি। অর্জুনকে আসতে দেখে দুর্যোধন, কর্ণ, বৃষসেন, শল্য, অশ্বত্থামা, কৃপ এবং স্বয়ং জয়দ্রথ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, দিনের অল্পই অবশিষ্ট আছে, জয়দ্রথকে যদি সূর্যাস্ত পর্যন্ত রক্ষা করা যায় তবে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হবে, সে অগ্নিপ্রবেশ করবে। অর্জুন মরলে তার ভাইয়েরাও মরবে, তার পর আমরা নিঙ্কণ্টক হয়ে পৃথিবী ভোগ করবো। কর্ণ, তোমরা সকলে আমার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশেষ যত্ন সহকারে যুদ্ধ করো। কর্ণ বললেন, ভীম আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছে, যুদ্ধে থাকা কর্তব্য সেজন্যই আমি এখানে আছি, কিন্তু আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আছে, তবুও আমি যথাশক্তি যুদ্ধ করবো। মহারাজ, তোমার জন্য আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবো, কিন্তু জয় দৈবের অধীন।

তীক্ষ্ম শরাঘাতে অর্জুন বিপক্ষের সৈন্য হাতি ও ঘোড়া বিনাশ করতে লাগলেন এবং ভীম ও সাত্যকি কর্তৃক রক্ষিত হয়ে ক্রমশ জয়দ্রথের নিকটস্থ হলেন। দুর্যোধন, কর্ণ, কৃপ প্রভৃতি অর্জুনকে ঘিরে ধরলেন, কিন্তু অর্জুনের প্রচণ্ড বাণবর্ষণে তাঁরা আহত হয়ে সরে গেলেন। অর্জুনের শরাঘাতে জয়দ্রথের সারথির মুণ্ড এবং রথের পতাকা ভূপাতিত হোলো। সূর্য দ্রুতগতিতে অস্ত যাচ্ছে দেখে কৃষ্ণ বললেন, ভীত জয়দ্রথকে ছয় জন মহারথ রক্ষা করছেন, এঁদের জয় না কোরে কিংবা ছলনা ভিন্ন তুমি জয়দ্রথকে বধ করতে পারবে না। আমি যোগবলে সূর্যকে আবৃত করবো, তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে ভেবে জয়দ্রথ আর আত্মগোপন করবে না, সেই অবকাশে তুমি তাকে প্রহার করো।

এই বলে কৃষ্ণ যোগবলে সূর্যকে ঢেকে দিলেন। সূর্যাস্ত হয়েছে, এখন অর্জুন অগ্নিপ্রবেশ করবেন - এই ভেবে কৌরবযোদ্ধারা আনন্দিত হলেন। জয়দ্রথ আকাশে সূর্যকে দেখতে পেল না। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, জয়দ্রথ ভয়মুক্ত হয়ে সূর্য দেখছে, দূরাত্মাকে বধ করবার এই উপযুক্ত সময়।

কৃপ, কর্ণ, শল্য, দুর্যোধন প্রভৃতিকে শরাঘাতে বিতাড়িত কোরে অর্জুন জয়দ্রথের প্রতি ধাবিত হলেন। ধূলি ও অন্ধকারে চতুর্দিক আচ্ছন্ন হওয়ায় যোদ্ধারা কেউ কাউকে দেখতে পেলেন না, অশ্বারোহী গজারোহী ও পদাতিক সৈন্য অর্জুনের বাণে আহত হয়ে পালাতে লাগল। কৃষ্ণ আবার বললেন, অর্জুন, জয়দ্রথের শিরচ্ছেদ করো, সূর্য অস্তে যাচ্ছেন। যা করতে হবে শোন - বিখ্যাত রাজা বৃদ্ধক্ষত্র জয়দ্রথের পিতা। পুত্রের জন্মকালে তিনি এই দৈববাণী শুনেছিলেন যে রণস্থলে কোনও শত্রু এর শিরচ্ছেদ করবে। তখন পুত্রবৎসল বৃদ্ধক্ষত্র এই অভিশাপ দিলেন - যে আমার পুত্রের মাথা কেটে ভূমিতে ফেলবে তার মাথা বিদীর্ণ হয়ে যাবে। তার পর যথাকালে জয়দ্রথকে রাজপদ দিয়ে বৃদ্ধক্ষত্র বনে গমন করলেন, এখন তিনি সমস্তপঞ্চকের বাইরে দুষ্কর তপস্যা করছেন। অর্জুন, তুমি অদ্ভুতশক্তিসম্পন্ন কোনও দিব্য অস্ত্র দিয়ে জয়দ্রথের মাথা কেটে বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে ফেলো। যদি ভূমিতে ফেলো তবে তোমার মাথা বিদীর্ণ হবে।

কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন এক মন্ত্রসিদ্ধ বজ্রতুল্য বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ দ্রুতবেগে গিয়ে জয়দ্রথের মাথা কেটে আকাশে উঠল। অর্জুনের আরও কতকগুলি বাণ সেই মাথা উর্ধ্বে বহন কোরে নিয়ে চলল, অর্জুন আবার ছয় মহারথের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। এই সময়ে রাজা বৃদ্ধক্ষত্ৰ সন্ধ্যাবন্দনা করছিলেন। সহসা জয়দ্রথের মস্তক তাঁর কোলে এসে পড়ল । বৃদ্ধক্ষত্র ভীত ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালে তার পুত্রের মাথা ভূমিতে পড়ল আর সাথে সাথে তার নিজের মাথা বিদীর্ণ হয়ে গেল।

তারপর কৃষ্ণ অন্ধকার অপসারিত করলে আকাশে সূর্য প্রকট হোলো। কৌরবগণ বুঝলেন কৃষ্ণের মায়াবলে এমন হয়েছে। দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা কাঁদতে থাকলেন। কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীম, সাত্যকি প্রভৃতি শঙ্খ বাজালেন, সেই আওয়াজ শুনে যুধিষ্ঠির বুঝলেন যে জয়দ্রথ নিহত হয়েছেন।

দুর্যোধন বিষগ্ন হয়ে দ্রোণকে বললেন, আমাদের কিরূপ ধ্বংস হচ্ছে দেখুন। পিতামহ ভীষ্ম, মহাবীর জলসন্ধ, কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, রাক্ষসরাজ অলম্বুষ, মহাবল ভূরিশ্রবা, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, এবং আমার অসংখ্য সৈন্য নিহত হয়েছে। আমি লোভী, পাপী, ধর্মনাশক, তাই আমার যোদ্ধারা নিহত হয়েছেন। পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের যুদ্ধে বধ কোরে আমি শান্তিলাভ করবো কিংবা নিজে নিহত হয়ে বীরলোকে যাবো। আমি সহায়হীন, সকলে পাণ্ডবদের হিতকামনা যেমন করেন তেমন আমার করেন না। ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দিলেন, অর্জুন আপনার শিষ্য তাই আপনিও যুদ্ধে উপেক্ষা করছেন। আমার আর জীবনে প্রয়োজন নেই। আচার্য, আপনি আমাকে মরণের অনুমতি দিন।

দ্রোণ বললেন, তুমি আমার নিন্দা করছ কেন? আমি সর্বদা বলি অর্জুনকে জয় করা অসম্ভব। তোমরা জয়দ্রথকে রক্ষা করবার জন্য অর্জুনকে ঘিরে ধরেছিলে, তুমি, কর্ণ, কৃপ, শল্য ও অশ্বত্থামা জীবিত থাকতে জয়দ্রথ নিহত হলেন কেন? তিনি অর্জুনের হাতে নিস্তার পাননি, আমিও নিজের জীবন রক্ষার উপায় দেখছি না। আমি অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়ে আছি, এর উপর তুমি আমার নিন্দা করছ কেন? যখন ভূরিশ্রবা আর সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ নিহত হয়েছেন তখন আর কে অবশিষ্ট থাকবে? দুর্যোধন, আমি সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য ধ্বংস না করে বর্ম খুলব না। তুমি অশ্বত্থামাকে বলো সে জীবিত থাকতে যেন সোমকগণ রক্ষা না পায়। তোমার বাক্যে দুঃখিত হয়ে আমি শত্রুবাহিনীর মধ্যে প্রবেশ করছি। যদি পারো তবে কৌরবসৈন্য রক্ষা করো, আজ রাত্রিতেও যুদ্ধ হবে। এই বলে দ্রোণ পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের প্রতি ধাবিত হলেন।

দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, দ্রোণ যদি পথ ছেড়ে না দিতেন তবে অর্জুন কি ব্যূহ ভেদ করতে পারত? সে চিরকালই দ্রোণের প্রিয় তাই যুদ্ধ না করেই দ্রোণ তাকে প্রবেশ করতে দিয়েছিলেন। প্রাণরক্ষার জন্য জয়দ্রথ ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, দ্রোণ তাঁকে অভয় দিলেন, কিন্তু অর্জুনকে ব্যূহদ্বার ছেড়ে দিলেন। আমরা অনার্য দুরাত্মা, তাই আমাদের সামনেই আমার চিত্রসেন প্রভৃতি ভাইয়েরা ভীমের হাতে নিহত হয়েছে।

কর্ণ বললেন, তুমি আচার্যের নিন্দা করো না, এই ব্রাহ্মণ জীবনের আশা ত্যাগ করে যথাশক্তি যুদ্ধ করছেন। তিনি স্থবির, শীঘ্রগমনে অক্ষম, অস্ত্র চালনাতেও অশক্ত হয়েছেন। অস্ত্রবিশারদ হলেও তিনি পাণ্ডবদের জয় করতে পারবেন না। দুর্যোধন, আমরাও যথাশক্তি যুদ্ধ করছিলাম তথাপি সিন্ধুরাজ নিহত হয়েছেন, এজন্য মনে করি দৈবই প্রবল। আমরা পাণ্ডবদের সঙ্গে শঠতা করেছি, বিষ দিয়েছি, জতুগৃহে অগ্নি দিয়েছি, পাশা খেলায় পরাজিত করেছি, রাজনীতি অনুসারে বনবাসে পাঠিয়েছি, কিন্তু দৈবের প্রভাবে সবই নিষ্ফল হয়েছে। তুমি ও পাণ্ডবরা মরণপণ কোরে যুদ্ধ করো, দৈব তার নিজ পথেই চলবে। সৎ বা অসৎ সকল কাজের পরিণামে দৈবই প্রবল, মানুষ ঘুমিয়ে থাকলেও দৈব জেগে থাকে।

______________

(ক্রমশ)