একবার আমি ভালোবাসার অন্য নাম দিয়েছিলাম "আয়না"। জানো কেন? কারণ আয়নার মতো ভালোবাসা শুধু সেটুকু প্রতিফলিত করে, যা আমরা দেখতে চাই। আর এই ভাবনাটা প্রথম আমার মাথায় আসে রৌনক আর মেঘের গল্পটা শুনে।
মেঘ, সে ছিল এক ভাস্কর। তার হাত যেন পাথরের নীরবতাকে ভেঙে প্রাণ দিতে পারত। কিন্তু তার নিজের জীবনটা ছিল অনেকটাই নীরব। একাকীত্ব আর শিল্পই ছিল তার সঙ্গী। আর রৌনক? সে ছিল এক রাতের পাখি। তার কণ্ঠ ছিল তারার মতো উজ্জ্বল, কিন্তু সে গান গাইত শুধু চাঁদের কাছে। মানুষের ভিড় তার ভালো লাগত না, সে শুধু একান্তে তার গান শোনাতে চাইত প্রকৃতির কানে।
প্রথমবার যখন রৌনক মেঘের স্টুডিওতে পা রাখল, মেঘ তখন একটুকরো মার্বেলে এক অপ্সরার মুখ ফুটিয়ে তুলছিল। রৌনকের চোখের দিকে তাকিয়ে মেঘের মনে হলো, সে যেন বহু পুরোনো কোনো কবিতার লাইন খুঁজে পেল, যা এত দিন তার অজান্তেই ছিল। রৌনক মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মেঘের শিল্পকর্ম। সে জানতে চাইল, "আপনি কার মুখ বানাচ্ছেন?" মেঘ একটু হেসে উত্তর দিল, "আমার কল্পনার।"
রৌনক হাসল। তার হাসিটা ছিল চাঁদের আলোর মতো শীতল কিন্তু মায়াবী। সে বলল, "আপনি কি জানেন, আমি চাঁদের কাছে গান গাই? আমার গানে শুধু নির্জনতা আর ভালোবাসা থাকে।" মেঘের মনে হলো, এ যেন তার নিজের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
সেই দিন থেকে মেঘ আর রৌনকের জীবন এক নতুন ছন্দে বাঁধা পড়ল। মেঘের স্টুডিওতে রৌনকের গানের সুর মিশে যেতে লাগল মার্বেলের কোলাহলে। মেঘ যখন পাথর কেটে অপ্সরা গড়ত, রৌনক তখন তার পাশে বসে গান গাইত। তাদের সম্পর্কটা ছিল এক অদ্ভুত সমীকরণের মতো। একজন নীরবতার পূজারি, অন্যজন সুরের সাধক।
একদিন রৌনক মেঘকে বলল, "যদি আমি হঠাৎ হারিয়ে যাই, আপনি কি আমাকে খুঁজে নেবেন? মেঘ, আমার মনে হয় আমি এই পৃথিবীর জন্য নই।" মেঘ অবাক হয়ে রৌনকের দিকে তাকাল। তার চোখে এক অজানা ভয় খেলা করছিল। সে রৌনকের হাত ধরে বলল, "তুমি এমন কথা বলছ কেন? তুমি হারিয়ে গেলেও আমি তোমাকে খুঁজে বের করব। যত দূরই হোক না কেন, আমি তোমার পিছু ছাড়ব না।"
সেদিন রাতে রৌনক মেঘকে একটা গান শোনাল। গানটা ছিল চাঁদের গল্প নিয়ে। সেই গল্পে চাঁদ নাকি রোজ রাতে এক অপ্সরার খোঁজে আকাশ পাড়ি দেয়। গানটা শেষ হতেই রৌনক বলল, "যদি আমি হারিয়ে যাই, তুমি এই গানটা মনে রেখো। চাঁদ আমাকে খুঁজে নেবে, আর তুমিও আমাকে খুঁজে পাবে।"
এরপর সত্যি সত্যিই একদিন রৌনক উধাও হয়ে গেল। মেঘ তাকে আর খুঁজে পেল না। মেঘের পৃথিবীটা যেন হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল। তার হাতে আর পাথর কাটতে ভালো লাগত না। তার চোখ শুধু রৌনককে খুঁজত। রাতের পর রাত সে স্টুডিওর ছাদে বসে থাকত, চাঁদের দিকে তাকিয়ে। তার কানে ভাসত রৌনকের সেই গান, "চাঁদ আমাকে খুঁজে নেবে, আর তুমিও আমাকে খুঁজে পাবে।"
একদিন গভীর রাতে মেঘ দেখল, চাঁদটা যেন তার দিকে আরও কাছে চলে আসছে। সে এক অপার্থিব আলোর ছটায় ভরে উঠল। মেঘ অনুভব করল, এক অদ্ভুত শক্তি তাকে টানছে। সে যেন সেই আলোর টানে ভেসে উঠল শূন্যে। তার মনে হলো, সে যেন রৌনকের গানটা শুনতে পাচ্ছে, অনেক দূর থেকে।
সে দেখল, সে এক অন্য জগতে চলে এসেছে। সে জগৎটা ছিল তারাদের তৈরি এক উপত্যকা, যেখানে বাতাসও সুর হয়ে বয়ে যায়। আর সেখানে, এক স্ফটিকের তৈরি পাহাড়ের চূড়ায়, রৌনক বসে গান গাইছে। তার পাশে অসংখ্য অপ্সরা তার গান শুনছে। মেঘ অবাক হয়ে দেখল, রৌনক যেন সেই চাঁদের অপ্সরাদের একজন।
রৌনক মেঘকে দেখে হাসল। তার হাসিটা সেই আগের মতোই মায়াবী, তবে আরও উজ্জ্বল। সে বলল, "আমি জানতাম তুমি আসবে। তুমিই আমার অসমাপ্ত কবিতা।" মেঘের চোখে জল এসে গেল। সে রৌনকের দিকে ছুটে গেল।
সেদিন থেকে মেঘ আর রৌনক সেই তারার জগতে একসাথে বসবাস করতে লাগল। মেঘ তার কল্পনার অপ্সরাকে বাস্তবে পেয়েছিল, আর রৌনক পেয়েছিল তার সেই ভালোবাসার মানুষটিকে, যে তাকে পৃথিবীর সব বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছিল। তাদের ভালোবাসা ছিল এক ফ্যান্টাসি, এক কাল্পনিক গল্প, কিন্তু তা ছিল চিরন্তন সত্য। চাঁদ আজও তাদের সাক্ষী, আর তাদের গল্প আজও এক অসমাপ্ত কবিতা হয়ে ঘুরে বেড়ায় বাতাসের কানে।
মেঘ আর রৌনকের গল্পটা শুধু তাদের দুজনের ছিল না। এটা ছিল আমাদের সবার ভেতরের সেই অব্যক্ত স্বপ্নের প্রতিধ্বনি, সেই অদেখা ভালোবাসার হাতছানি। আমরা সবাই তো জীবনের কোনো না কোনো মোড়ে একাকীত্ব আর নীরবতার মধ্যে থাকি, আর তখন হয়তো একটা সুর বা একটা ছবি আমাদের আত্মাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। রৌনকের গান যেমন মেঘের পাথরে প্রাণ এনেছিল, তেমনি মেঘের শিল্প রৌনকের আত্মাকে এক নতুন রূপে প্রকাশ করেছিল।
তাদের ভালোবাসা শিখিয়েছে যে, সম্পর্ক মানে শুধু পাশে থাকা নয়, সম্পর্ক মানে একে অপরের আত্মাকে বুঝতে পারা, একে অপরের স্বপ্নকে সম্মান জানানো। আর যখন সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবের সীমানা পেরিয়ে যায়, তখন ভালোবাসাই একমাত্র সেতু হয়ে দাঁড়ায়, যা আমাদের নিয়ে যায় এক অন্য জগতে, যেখানে কোনো বিচ্ছেদ নেই, শুধু অনন্তকালের মিল।
এই গল্পটা আমাদের শেখায় যে, ভালোবাসা কোনো বাঁধাধরা নিয়মের অধীন নয়। এটা কখনো কখনো অলৌকিক হতে পারে, কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর হতে পারে। নিজের মনের কথা শুনতে শিখুন, নিজের স্বপ্নগুলোকে উড়তে দিন। কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফ্যান্টাসি হলো ভালোবাসা, আর এই ভালোবাসা এতটাই শক্তিশালী যে, তা আপনাকে যেকোনো সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আপনার সত্যিকারের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে।
আপনার জীবনেও হয়তো এমন কোনো 'রৌনক' বা 'মেঘ' আছে, যে আপনার অস্তিত্বের এক অন্য দিক উন্মোচন করবে। সেই মানুষটিকে খুঁজে নিন, অথবা নিজেই সেই রৌনক বা মেঘ হয়ে উঠুন। কারণ, ভালোবাসা যখন মনের গভীরে থাকে, তখন তা কখনোই অসমাপ্ত থাকে না, তা শুধু এক নতুন রূপে যাত্রা শুরু করে।