Story of Mahabharat Part 122 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 122

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 122

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২২

শরশয্যায় ভীষ্মের কাছে কর্ণের আগমনের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভীষ্মের শরশয্যার কাছে কর্ণের আগমনের কাহিনি

ভীষ্মের সঙ্গে সবাই দেখা করার পর ভীষ্ম নীরব হলে সকলে নিজেদের শিবিরে ফিরে গেলেন। এই সময়ে কর্ণ কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে ভীষ্মের কাছে এলেন এবং তার চরণে পতিত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি কর্ণ, নিরপরাধ হয়েও আমি আপনার বিদ্বেষভাজন। ভীষ্ম দেখলেন, তার কাছাকাছি আর কেউ নেই। তিনি রক্ষীদের সরিয়ে দিলেন এবং এক হাতে পিতার মতো কর্ণকে আলিঙ্গন করে সস্নেহে বললেন, তুমি যদি আমার কাছে না আসতে তবে নিশ্চয়ই তা ভালো হোত না। আমার সঙ্গে স্পর্ধা করতে সেজন্য তুমি আমার অপ্রিয় হওনি। আমি নারদের কাছে শুনেছি তুমি কুন্তীপুত্র, সূর্য হতে তোমার জন্ম। সত্য বলছি, তোমার প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই। তুমি অকারণে পাণ্ডবদের হিংসা করো, নীচস্বভাব দুর্যোধনের আশ্রয়ে থেকে তুমি পরশ্রীকাতর হয়েছ। তোমার তেজোহানি করবার জন্যই আমি তোমাকে কুরুসভায় বহুবার রুক্ষ্ম কথা শুনিয়েছি। আমি তোমার দুঃসহ বীরত্ব, বেদনিষ্ঠা এবং দানের বিষয় জানি, অস্ত্রপ্রয়োগে তুমি কৃষ্ণের সমান। আগে তোমার উপর আমার যে ক্রোধ ছিল তা দূর হয়েছে। পাণ্ডবগণ তোমার সহোদর, তুমি তাদের সঙ্গে মিলিত হও, আমার পতনেই শত্রুতার অবসান হোক, পৃথিবীর রাজারা শান্তিতে থাকুন।

কর্ণ বললেন, মহাবাহু, আপনি যা বললেন তা আমি জানি। কিন্তু কুন্তী আমাকে ত্যাগ করলে অধিরথ আমাকে পালন করেছিলেন। আমি দুর্যোধনের ঐশ্বর্য ভোগ করেছি, তা নিষ্ফল করতে পারি না। বাসুদেব যেমন পাণ্ডবদের জয়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আমিও সেইরূপ দুর্যোধনের জন্য ধন, শরীর, পুত্র, স্ত্রী সমস্তই উৎসর্গ করেছি। আমি ক্ষত্রিয়, রোগ ভোগ করে মরতে চাই না, সেজন্যই দুর্যোধনকে আশ্রয় করে পাণ্ডবদের ক্রোধ বৃদ্ধি করেছি। যা অবশ্যম্ভাবী তা নিবারণ করা যাবে না। এই দারুণ শত্রুতার অবসান করা আমার অসাধ্য, আমি স্বধর্ম রক্ষা করেই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবো। পিতামহ, আমি যুদ্ধের সংকল্প করেছি, আমাকে অনুমতি দিন। হঠাৎ বা দুর্বুদ্ধির বশে আপনাকে যে কটুবাক্য বলেছি বা অন্যায় করেছি তা ক্ষমা করুন।

ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, তুমি যদি এই দারুণ শত্রুভাব দূর করতে না পারো তবে অনুমতি দিচ্ছি, স্বৰ্গকামনায় যুদ্ধ করো। আক্রোশ ত্যাগ করো, সদাচার রক্ষা করো, নিরহংকার হয়ে যথাশক্তি যুদ্ধ কোরে ক্ষত্রিয়োচিত স্বর্গলোক লাভ করো। ধর্মযুদ্ধ ভিন্ন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছু নেই। দুই পক্ষের শান্তির জন্য আমি দীর্ঘকাল বহু যত্ন করেছি, কিন্তু তা সফল হোলো না।।

ভীষ্মকে অভিবাদন করে কর্ণ কাঁদতে কাঁদতে রথে উঠে দুর্যোধনের কাছে চলে গেলেন।

তারপর কর্ণ রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে রথারোহণে ভীষ্মের কাছে আবার এলেন এবং কান্নাভেজা চোখে অভিবাদন কোরে হাত জোড় কোরে বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আমি কর্ণ, আপনি প্রসন্ননয়নে চেয়ে দেখুন, শুভ বাক্য বলুন। সৎকর্মের ফল নিশ্চয় ইহলোকে লভ্য নয়, তাই আপনি ধর্মপরায়ণ বৃদ্ধ হয়েও ভূতলে শয়ন করেছেন। কুরুবীরগণকে বিপদসাগরে ফেলে আপনি পিতৃলোকে যাচ্ছেন, ক্রুদ্ধ বাঘ যেমন হরিণ বিনাশ করে, পাণ্ডবগণ সেইরূপ কৌরবগণকে বিনাশ করবে। আমি অসহিষ্ণু হয়েছি, আপনি অনুমতি দিলে আমি প্রচণ্ড বিক্রমশালী অর্জুনকে অস্ত্রের বলে বধ করতে পারবো।

ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, সমুদ্র যেমন নদীগণের, সূর্য যেমন সকল তেজের, সাধুজন যেমন সত্যের, উর্বরা ভূমি যেমন বীজের, মেঘ যেমন জীবগণের, তুমিও তেমন বান্ধবগণের আশ্রয় হও। আমি প্রসন্নমনে বলছি, তুমি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, কৌরবগণকে উপদেশ দাও, দুর্যোধনের জয় নিশ্চিত করো। দুর্যোধনের মতো তুমিও আমার পৌত্রের মতো। মনীষিগণ বলেন, সজ্জনের সঙ্গে সজ্জনের যে সম্বন্ধ তা জন্মগত সম্বন্ধের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কৌরবসৈন্য যেমন দুর্যোধনের, সেইরূপ তোমরাও, এই জ্ঞান কোরে তাদের রক্ষা করো।

ভীষ্মের চরণে প্রণাম করে কর্ণ সত্বর রণস্থলের অভিমুখে প্রস্থান করলেন।

______________

(ক্রমশ)