সূরিদ্ধি দত্ত, নামটা যেন তার ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। কলকাতার অন্যতম বিত্তশালী দত্ত পরিবারের একমাত্র কন্যা সে। জন্ম থেকেই সে দেখেছে প্রাচুর্য, বিলাসিতা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের কাছে তার কোনো আবদারই অপূর্ণ থাকেনি। তবে এই প্রাচুর্যের আড়ালে সূরিদ্ধি ছিল নিরহংকার, বিনয়ী এক তরুণী। বি.কম মাস্টার্স করার জন্য সে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, তখন তার পরিচিত জগৎটা যেন আরও বড় হলো। নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ – সবটাই তার ভালো লাগছিল।
অন্যদিকে, অর্ণব ঘোষ। নামটা শুনেই যেন একটা সাদামাটা ছবি ভেসে ওঠে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অর্ণব, চোখে তার হাজার স্বপ্ন। আইপিএস অফিসার হওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে প্রতি মুহূর্তে তাড়িয়ে বেড়াতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উপস্থিতি ছিল শান্ত, নিরিবিলি। পড়াশোনায় অত্যন্ত মনোযোগী অর্ণব তার বন্ধুদের কাছে ছিল এক অনুপ্রেরণা। তার জীবনের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট – দেশের সেবা করা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।
প্রথম দেখাটা ছিল নিতান্তই সাধারণ। লাইব্রেরিতে এক সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট বই খুঁজতে গিয়ে দু’জনের চোখাচোখি। অর্ণব বইটি আগে হাতে তুলেছিল, সূরিদ্ধি একটু ইতস্তত করে অনুরোধ করল। অর্ণব হাসিমুখে বইটি এগিয়ে দিল। সেই ছোট্ট বিনিময়ই ছিল তাদের সম্পর্কের প্রথম ধাপ। এরপর ক্লাসে, ক্যান্টিনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে তাদের দেখা হতে লাগল। অর্ণব তার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলত, দেশ ও সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কথা বলত। সূরিদ্ধি মুগ্ধ হয়ে শুনত। তার বিত্তশালী জীবনের বাইরে এমন এক নির্ভেজাল, স্বপ্নবান মানুষের সংস্পর্শে এসে সে যেন এক নতুন জগতের সন্ধান পেল। অর্ণবও সূরিদ্ধির সরলতা, তার উদার মন দেখে আকৃষ্ট হলো। তাদের অজান্তেই দু’জনের হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করল।
দিনগুলো দ্রুত কাটছিল। অর্ণবের কাছে আইপিএস হওয়াটা শুধু স্বপ্ন ছিল না, ছিল এক প্রতিজ্ঞা। সে জানত, এই পথটা সহজ নয়। রাত জেগে পড়াশোনা, শরীরচর্চা, মক টেস্ট – সবটাতেই সে নিজেকে নিবেদন করেছিল। সূরিদ্ধি তার স্বপ্নকে সমর্থন করত, তাকে উৎসাহ দিত। কখনও লাইব্রেরিতে পড়াশোনায় সাহায্য করত, কখনও তার জন্য পছন্দের খাবার নিয়ে আসত। তাদের প্রেম ছিল অনেকটা শান্ত নদীর মতো, গভীর এবং অবিচল। কোনো উচ্চকিত প্রকাশ ছিল না, ছিল শুধু একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর বোঝাপড়া।
এক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে অর্ণব সূরিদ্ধিকে বলল, "সূরিদ্ধি, আমার আইপিএস হওয়ার স্বপ্নটা অনেক বড়। জানি না কবে পূরণ হবে। আমার পরিবার সাধারণ, তোমার মতো বিত্তশালী বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হয়তো সবাই মেনে নেবে না।"
সূরিদ্ধি অর্ণবের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। তার চোখে ছিল এক দৃঢ়তা। "অর্ণব, ভালোবাসার মাপকাঠি অর্থ হয় না। তোমার স্বপ্নটা আমারও স্বপ্ন। আমি তোমার আইপিএস হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি যখন আইপিএস হবে, সেদিনই তোমার হাত ধরে তোমার বাড়িতে যাব। সেদিন তোমার পরিবার তোমাকে আমার চেয়েও বড় করে দেখবে।"
সূরিদ্ধির এই কথাগুলো অর্ণবকে আরও শক্তি জুগিয়েছিল। সে জানত, তার পাশে এমন একজন মানুষ আছে যে তার স্বপ্নকে শুধু বোঝে না, বরং তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অপেক্ষা করতেও রাজি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঠ চুকলো। অর্ণব পুরোদমে ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ডুব দিল। সূরিদ্ধি মাস্টার্স শেষ করে বাবার ব্যবসায় যোগ দিল, কিন্তু তার মন পড়ে থাকত অর্ণবের কাছে। তাদের দেখা সাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল, কারণ অর্ণব এতটাই ব্যস্ত ছিল যে সময় বের করা কঠিন ছিল। তবে ফোনের মাধ্যমে তারা একে অপরের খবর রাখত। একে অপরের প্রতি তাদের বিশ্বাস এতটুকু কমেনি।
পাঁচটি বছর কেটে গেল। এই পাঁচ বছর সূরিদ্ধির জীবনে কম ঝড় আসেনি। পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসছিল। বড়লোকের ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সূরিদ্ধি প্রতিবারই দৃঢ়ভাবে না করে দিয়েছিল। সে জানত, তার অর্ণব একদিন ফিরবেই। তার মনের গভীরে অর্ণবের প্রতি বিশ্বাস ছিল পর্বতপ্রমাণ।
একদিন সকালে অর্ণবের ফোন এল। তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর আনন্দ। "সূরিদ্ধি, আমি পেরেছি! আমি আইপিএস হয়েছি!"
সূরিদ্ধির চোখে জল এসে গিয়েছিল। এ আনন্দের অশ্রু। তার পাঁচ বছরের অপেক্ষা সার্থক হয়েছে। সেদিন অর্ণব আর সূরিদ্ধির ভালোবাসার জয় হয়েছিল।
অর্ণব যখন আইপিএস অফিসার হিসেবে ইউনিফর্ম পরে সূরিদ্ধির বাবার বাড়িতে প্রবেশ করল, দত্ত পরিবার তখন বিস্ময়ে স্তব্ধ। তাদের ধারণা ছিল না যে অর্ণব ঘোষ নামের এই সাধারণ ছেলেটি এত বড় সাফল্য অর্জন করবে। সূরিদ্ধির বাবা-মা তাদের মেয়েকে এতদিন ধরে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অর্ণবের সাফল্য দেখে তারা মুগ্ধ হলেন। তাদের জামাই হিসেবে অর্ণবকে গ্রহণ করতে তাদের আর কোনো দ্বিধা রইল না। সূরিদ্ধির চোখে ছিল তৃপ্তির হাসি। অর্ণব তার স্বপ্ন পূরণ করেছে, আর সে তার ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করেছে।
এক ঝলমলে দিনে অর্ণব ও সূরিদ্ধির বিয়ে হলো। অর্ণব জানত, সূরিদ্ধির ভালোবাসা আর বিশ্বাস তাকে এই কঠিন পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করেছে। আর সূরিদ্ধি জানত, তার জীবনে অর্ণব নামের এই মানুষটি তার সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করেছে, তাকে দিয়েছে এক অনন্য পরিচয়। তাদের গল্প প্রমাণ করে দিল, ভালোবাসা শুধু অর্থের হিসাব মানে না, মানে বিশ্বাস, অপেক্ষা আর স্বপ্নের সার্থকতা।
আপনার গল্পটি কেমন লাগলো জানাতে পারেন। আরও কিছু যোগ করতে চাইলে, আমাকে জানাতে পারেন।ভালোবাসা আর ত্যাগের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে সূরিদ্ধি আর অর্ণব যখন শেষমেশ এক হলো, তখন তাদের গল্পটা যেন শুধু তাদের একার রইল না। তাদের ভালোবাসার বাঁধন আরও মজবুত হয়ে উঠল, যা সময়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করা। অর্ণবের ইউনিফর্মের উজ্জ্বলতা আর সূরিদ্ধির চোখে লেগে থাকা অপেক্ষার জ্যোতি, এক অন্যরকম দ্যুতি ছড়িয়েছিল তাদের চারপাশে। তাদের প্রেম প্রমাণ করে দিল, সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়ম বা প্রাচুর্যের দেওয়াল ভালোবাসার সামনে কতটা তুচ্ছ।
অর্ণবের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল, দেশের সেবা করার ব্রত নিয়ে সে এগিয়ে গিয়েছিল এক নতুন জীবনে। আর সূরিদ্ধি? সে শুধু একজন আইপিএস অফিসারের স্ত্রী হয়ে থাকেনি, বরং নিজের স্বপ্নকে অর্ণবের স্বপ্নের সঙ্গে এক করে বাঁচতে শিখেছিল। তাদের সংসার হয়ে উঠেছিল ভালোবাসা, বিশ্বাস আর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার এক আদর্শ উদাহরণ। যে ভালোবাসার জন্য সূরিদ্ধি দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছিল, যে স্বপ্ন পূরণের জন্য অর্ণব নিজেকে নিবেদন করেছিল, সেই প্রেমই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হয়ে রইল। তাদের গল্প শুনে অনেকেই বুঝল, প্রকৃত ভালোবাসা সত্যিই সব বাধা পেরিয়ে জয়ী হতে পারে