Story of Mahabharat - Part-118 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 118

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 118

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১১৮

যুদ্ধের নবম দিনে ভীষ্মের পরাক্রমের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

যুদ্ধের নবম দিনে ভীষ্মের পরাক্রমের কাহিনি

অষ্টম দিনের যুদ্ধের শেষে রাতে কর্ণ ও শকুনিকে দুর্যোধন বললেন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য ও ভূরিশ্রবা পাণ্ডবগণকে কেন দমন করছেন না তার কারণ জানি না, তারা জীবিত থেকে আমার শক্তি ক্ষয় করছে। দ্রোণের সামনেই ভীম আমার ভাইদের বধ করেছে। কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, শোক করো না। ভীষ্ম যুদ্ধ থেকে সরে যান, তিনি অস্ত্রত্যাগ করলে তার সামনেই আমি পাণ্ডবদের সসৈন্যে বধ করবো। ভীষ্ম সর্বদাই পাণ্ডবদের দয়া করেন, সেই মহারথগণকে জয় করবার শক্তিও তার নেই। অতএব তুমি শীঘ্র ভীষ্মের শিবিরে যাও, বৃদ্ধ পিতামহকে সম্মান দেখিয়ে তাঁকে অস্ত্রত্যাগে রাজি করাও।

 

দুর্যোধন ঘোড়ায় চড়ে ভীষ্মের শিবিরে চললেন, তাঁর ভাইয়েরাও সঙ্গে গেলেন। ভীষ্মের কাছে গিয়ে দুর্যোধন হাত জোড় কোরে সাশ্রনয়নে কাতর স্বরে বললেন, শক্ৰহন্তা পিতামহ, আমার উপর কৃপা করুন, ইন্দ্র যেমন দানবদের বধ করেছিলেন আপনি সেইরূপ পাণ্ডবগণকে বধ করুন। আপনার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করুন, পাণ্ডব, পাঞ্চাল, কেকয় প্রভৃতিকে বধ করে সত্যবাদী হন। যদি আমার দুর্ভাগ্যক্রমে বা পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহের বশে বা আমার প্রতি বিদ্বেষের বশে আপনি পাণ্ডবদের রক্ষা করতে চান, তবে কর্ণকে যুদ্ধ করবার অনুমতি দিন, তিনিই পাণ্ডবগণকে জয় করবেন।

দুর্যোধনের কথায় ভীষ্ম অত্যন্ত দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হলেন, কিন্তু কোনও অপ্রিয় কথা বললেন না। কিছুক্ষণ পর তিনি ধীরে ধীরে বললেন, দুর্যোধন, আমাকে তিরস্কার করছ কেন, আমি যথাশক্তি চেষ্টা করছি, তোমার জয়ের জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়েছি। পাণ্ডবগণ কিরূপ পরাক্রান্ত তার প্রচুর নিদর্শন তুমি পেয়েছ। খাণ্ডবদহনের সময় অর্জুন ইন্দ্রকেও পরাস্ত করেছিল। তোমার বীর ভাইয়েরা আর কর্ণ যখন পালিয়েছিল তখন অর্জুন তোমাকে গন্ধর্বদের হাত থেকে মুক্ত করেছিল। বিরাটনগরে গরু হরণের সময় একা অর্জুন আমাদের সকলকে জয় করে উত্তরকে দিয়ে আমাদের পোশাক খুলে নিয়েছিল। শঙ্খ-চক্র-গদাধর অনন্তশক্তি পরমাত্মা কৃষ্ণ যাঁর রক্ষক সেই অর্জুনকে যুদ্ধে কে জয় করতে পারে? নারদাদি মহর্ষিগণ বহুবার তোমাকে বলেছেন কিন্তু তুমি অহঙ্কারের বশে বুঝতে পারোনি। তুমিই এই শত্রুতা সৃষ্টি করেছ, এখন নিজেই যুদ্ধ করে পৌরুষ দেখাও। আমি, সোমক, পাঞ্চাল ও কেকয়গণকে বিনষ্ট করবো, হয় তাদের হাতে মরে যমালয়ে যাব নতুবা তাদের বিনাশ কোরে তোমাকে তুষ্ট করবো। কিন্তু আমার প্রাণ গেলেও শিখণ্ডীকে বধ করবো না, কারণ বিধাতা তাকে শিখণ্ডিনী রূপেই সৃষ্টি করেছিলেন। গান্ধারীপুত্র, সুখে নিদ্রা যাও, কাল আমি এমন মহাযুদ্ধ করবো যে লোকে চিরকাল তার কথা বলবে। ভীষ্মের কথা শুনে দুর্যোধন নতমস্তকে প্রণাম কোরে নিজের শিবিরে চলে গেলেন। দুর্যোধনের কথায় ভীষ্ম অতিশয় অপমানিত বোধ করলেন।

পরদিন ভীষ্ম সর্বতোভদ্র নামে সৈন্যদের এক মহাব্যূহ রচনা করলেন। কৃপ, কৃতবর্মাম জয়দ্রথ, দ্রোণ, ভূরিশ্রবা, শল্য, ভগদত্ত, দুর্যোধন প্রভৃতি এই ব্যূহের বিভিন্ন স্থানে রইলেন। পাণ্ডবগণও এক মহাব্যূহ রচনা করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। অর্জুন ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, তুমি আজ শিখণ্ডীকে ভীষ্মের সম্মুখে রাখ, আমি তাঁর রক্ষক হবো।

যুদ্ধের সময় নানাপ্রকার অশুভ লক্ষণ দেখা গেল, ভূমিকম্প ও উল্কাপাত হোলো, শিয়াল কুকুর প্রভৃতি ভয়ংকর আওয়াজ করতে লাগল। রথে চড়ে মহাবীর অভিমন্যু বাণের আঘাতে কৌরবসৈন্য বিনাশ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে রাক্ষস অলম্বুষ তাকে বাধা দিতে গেল। সে শত্রুঘাতিনী তামসী মায়া প্রয়োগ করলে সমস্ত স্থান অন্ধকারময় হোলে স্বপক্ষ বা বিপক্ষ কিছুই দেখা গেল না। তখন অভিমন্যু ভাস্কর অস্ত্রে সেই মায়া নষ্ট কোরে অলম্বুষকে বাণের আঘাতে আহত করলে অলম্বুষ রথ ফেলে ভয়ে পালিয়ে গেল।

যুদ্ধকালে একবার পাণ্ডবপক্ষের অন্যবার কৌরবপক্ষের জয় হতে লাগল। অবশেষে ভীষ্মের প্রচণ্ড বাণবর্ষণে পাণ্ডবসেনা বিধ্বস্ত হোলো, পাণ্ডবপক্ষের মহারথগণও বারণ না শুনে পালাতে লাগলেন। নিহত হাতি ও ঘোড়ার মৃতদেহে এবং ভাঙ্গা রথ ও পতাকায় রণস্থল ভরে উঠল, সৈন্যগণ আতঙ্কিত হয়ে হাহাকার করতে লাগল।

কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তুমি বিরাটনগরে সঞ্জয়কে বলেছিলে যে যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ সমস্ত কুরুসৈন্য সংহার করবে। ক্ষত্ৰধর্ম স্মরণ কোরে এখন সেই সত্য পালন করো। অর্জুন নতমুখে বললেন, যাঁরা অবধ্য তাদের বধ কোরে নরকবাস করার মতো রাজ্যলাভ ভালো না বনবাসে কষ্টভোগ করা ভালো? কৃষ্ণ, তোমার কথাই রাখব, ভীষ্মের কাছে রথ নিয়ে চলো, ভীষ্মকে নিপাতিত করবো। ভীষ্মের বাণবর্ষণে অর্জুনের রথ ঢেকে গেলে কৃষ্ণ অবিচলিত হয়ে আহত অশ্বদের দ্রুতবেগে চালাতে লাগলেন।

ভীষ্ম ও পাণ্ডবগণের বাণবর্ষণে দুই পক্ষেরই বহু সৈন্য বিনষ্ট হল। পাণ্ডবসৈন্যগণ আতঙ্কিত হয়ে ভীষ্মের অমানুষিক বিক্রম দেখতে লাগল। এই সময়ে সূর্যাস্ত হলে পাণ্ডব ও কৌরবগণ যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ শিবিরে চলে গেলেন। দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা বিজয়ী ভীষ্মের প্রশংসা করতে লাগলেন।

______________

(ক্রমশ)