Story of Mahabharat - 105 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 105

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 105

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০৫

ভীষ্ম বর্ণিত অম্বা ও শিখণ্ডীর কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভীষ্ম বর্ণিত অম্বা ও শিখণ্ডীর কাহিনি

ভীষ্ম শিখণ্ডীকে বধ করবেন না বলায় দুর্যোধন প্রশ্ন করলেন, পিতামহ, আপনি আগে বলেছিলেন যে পাঞ্চাল ও সোমকদের বধ করবেন, তাহলে শিখণ্ডীকে ছেড়ে দেবেন কেন? ভীষ্ম বললেন, তাকে কেন বধ করবো না তার ইতিহাস বলছি শোন –

আমার ভাই চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর তার ছোটো ভাই বিচিত্রবীর্যকে আমি রাজপদে অভিষিক্ত করি এবং তার বিবাহের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ংবর সভা থেকে জোর কোরে তুলে নিয়ে আসি। বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহের সময়ে জ্যেষ্ঠকন্যা অম্বা লজ্জিতভাবে আমাকে জানালেন যে তার পিতা কাশীরাজের অজান্তে তিনি ও শাল্বরাজ বিবাহ করবেন বলে ঠিক করেছেন। তখন আমি কয়েকজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও একজন ধাইয়ের সঙ্গে অম্বাকে শাল্বের কাছে পাঠিয়ে দিলাম এবং তাঁর দুই বোন অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলাম। অম্বাকে দেখে শাল্ব বললেন, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি না, ভীষ্ম তোমাকে হরণ করেছিলেন, তাঁর স্পর্শে তুমি খুশি হয়েছিলে, অতএব তাঁর কাছেই যাও। অম্বা বহু অনুনয় করলেও শাল্ব শুনলেন না। সেখান থেকে চলে এসে অম্বা এই বলে বিলাপ করতে লাগলেন - ভীষ্মকে ধিক, আমার মূঢ় পিতাকে ধিক যিনি পণ্যের মতো আমাকে দান করতে চেয়েছিলেন, শাল্বরাজকে ধিক, বিধাতাকেও ধিক। ভীষ্মই আমার দুঃখের মুখ্য কারণ, তাঁর উপর আমি প্রতিশোধ নেবো। অম্বা নগরের বাইরে তপস্বীদের আশ্রমে উপস্থিত হলেন এবং নিজের ইতিহাস জানিয়ে বললেন, আমি এখানে তপস্যা করতে ইচ্ছা করি। তপস্বীরা বললেন, তুমি তোমার পিতার গৃহে ফিরে যাও। অম্বা তাতে সম্মত হলেন না।

এই সময়ে অম্বার মাতামহ রাজর্ষি হোত্ৰবাহন সেই তপোবনে উপস্থিত হলেন। সমস্ত ঘটনা শুনে তিনি অম্বাকে বললেন, তুমি আমার কাছে থাকো, তোমার অনুরোধে পরশুরাম ভীষ্মকে বধ করবেন, তিনি আমার সখা। এমন সময়ে পরশুরামের প্রিয় শিষ্য অকৃতব্রণ সেখানে এলেন। সব কথা শুনে তিনি অম্বাকে বললেন, তুমি কেমন প্রতিকার চাও? যদি ইচ্ছা করো, তবে পরশুরামের আদেশে শাল্বরাজ তোমাকে বিবাহ করবেন, অথবা যদি ভীষ্মকে পরাজিত দেখতে চাও তবে পরশুরাম তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করবেন। অম্বা বললেন, শাল্বের প্রতি আমার অনুরাগ জেনেই ভীষ্ম আমাকে হরণ করেছিলেন, এই বিবেচনা করে আপনিই সঠিক বিধান দিন। অকৃতব্রণ বললেন, ভীষ্ম যদি তোমাকে হস্তিনাপুরে না নিয়ে যেতেন তবে পরশুরামের আদেশে শাল্ব তোমাকে বিবাহ করতেন, অতএব ভীষ্মেরই শাস্তি হওয়া উচিত।

পরদিন অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরশুরাম শিষ্যদের সাথে আশ্রমে উপস্থিত। হলেন। রূপবতী সুকুমারী অম্বার কথা শুনে পরশুরাম বললেন, আমি ভীষ্মকে সংবাদ পাঠাব, তিনি আমার কথা রাখবেন। যদি অন্যথা করেন তবে তাকে আর তাঁর সহযোগিদেরকে যুদ্ধে বিনষ্ট করবো। আর তা যদি না চাও তবে আমি শাল্বকেই আদেশ দেবো। অম্বা বললেন, শাল্বের প্রতি আমার অনুরাগ জেনেই ভীষ্ম আমাকে মুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু শাল্ব আমার চরিত্রদোষের আশঙ্কায় আমাকে গ্রহণ করেননি। আপনি বিচার করে দেখুন কি করা উচিত। আমার মনে হয় ভীষ্মই আমার দুঃখের মূল, তাঁকেই আপনি বধ করুন। পরশুরাম সম্মত হলে অম্বা ঋষিগণের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর তীরে এলেন।

তারপর ভীষ্ম বললেন, তৃতীয় দিনে পরশুরাম দূত পাঠিয়ে আমাকে আহ্বান করলেন। আমি ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতগণের সঙ্গে সত্বর তার কাছে গেলাম এবং একটি গাভী উপহার দিলাম। তিনি উপহার গ্রহণ কোরে বললেন, ভীষ্ম, তুমি অম্বাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে এসে আবার কেন তাকে পরিত্যাগ করলে? তোমার স্পর্শের জন্যই শাল্ব তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, অতএব আমার আদেশে তুমি এঁকে গ্রহণ করো। আমি পরশুরামকে বললাম, আমার ভাই বিচিত্রবীর্ষের সঙ্গে এঁর বিবাহ দিতে পারি না, কারণ পূর্বেই শাল্বের প্রতি এঁর অনুরাগ হয়েছিল এবং আমি মুক্তি দিলে ইনি শাল্বের কাছেই গিয়েছিলেন। আপনি আমাকে বাল্যকালে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন, আমি আপনার শিষ্য, তবে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চান কেন? পরশুরাম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তুমি আমাকে গুরু বলে মানছ অথচ আমি যা বলছি তা করছ না। তুমিই এঁকে গ্রহণ করে বংশরক্ষা করো।

তাঁর আদেশ পালনে আমি রাজি না হওয়ায় পরশুরাম বললেন, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এসো, আমার বাণে তুমি নিহত হবে, তোমার মা গঙ্গা তা দেখবেন। তার পর কুরুক্ষেত্রে পরশুরামের সঙ্গে আমার ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হোলো, ঋষি ও দেবতারা সেই আশ্চর্য যুদ্ধ দেখতে এলেন। আমার মা গঙ্গা আমাকে ও পরশুরামকে নিরস্ত করতে এলেন, কিন্তু তার অনুরোধ বিফল হোলো। আমি পরশুরামকে বললাম, আপনি মাটিতে আছেন তাই আমি রথে চড়ে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আপনি কবচ ধারণ করে রথারোহী হয়ে যুদ্ধ করুন। পরশুরাম সহাস্যে বললেন, পৃথিবী আমার রথ, সমস্ত বেদ আমার বাহন, বায়ু আমার সারথি, বেদমাতারা আমার কবচ। এই বলে তিনি বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন আমি দেখলাম, বিশাল দিব্য ঘোড়া চালিত বিচিত্র রথে তিনি বসে আছেন, তার শরীরে চন্দ্র ও সূর্যচিহ্নিত কবচ, অকৃতব্রণ তাঁর সারথি।

বহুদিন ধরে পরশুরামের সঙ্গে আমার যুদ্ধ হোলো। তিনি আমার সারথিকে বধ করলেন, আমাকেও শরাঘাতে ভূপতিত করলেন। তখন আমি দেখলাম, সূর্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী আট জন ব্রাহ্মণ আমাকে হাত দিয়ে ঘিরে আছেন, আমার মা গঙ্গা রথে রয়েছেন। আমি তার চরণ ধরে এবং পিতৃগণকে নমস্কার করে আমার রথে উঠলে মা চলে গেলেন। আমি এক ভয়ঙ্কর বাণ নিক্ষেপ করায় পরশুরাম মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি প্রকৃতিস্থ হয়ে আমাকে মারবার জন্য তার ধনুতে শরযোজন করলেন, কিন্তু মহর্ষিগণ তাঁকে নিবারণ করলেন।

রাত্রিকালে আমি স্বপ্ন দেখলাম, আগের দেখা আট জন ব্রাহ্মণ আমাকে বলছেন, ভীষ্ম, পরশুরাম তোমাকে জয় করতে পারবেন না, তুমিই জয়ী হবে। তুমি প্রস্বাপন অস্ত্র প্রয়োগ করো, তাতে পরশুরাম নিহত হবেন না, কিন্তু ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরাস্ত হবেন। পরদিন কিছু কাল প্রচণ্ড যুদ্ধের পর আমি প্রস্বাপন অস্ত্র নিক্ষেপের উদ্যোগ করলাম। তখন আকাশ থেকে নারদ আমাকে বললেন, তুমি এই অস্ত্র প্রয়োগ কোরো না, দেবগণ বারণ করছেন। পরশুরাম তপস্বী ব্রাহ্মণ এবং তোমার গুরু। এমন সময়ে পরশুরামের পিতৃগণ আবির্ভূত হয়ে তাঁকে বললেন, বৎস, ভীষ্মের সঙ্গে আর যুদ্ধ করো না, ইনি মহাযশা বসু, এঁকে তুমি জয় করতে পারবে না। তার পর নারদাদি মুনিগণ এবং আমার মা গঙ্গা যুদ্ধস্থানে এলেন। মুনিগণ পরশুরামকে বললেন, ব্রাহ্মণের হৃদয় মাখনের মতো, তুমি যুদ্ধ বন্ধ করো, তোমরা পরস্পরের অবধ্য। তখন সেই আট জন ব্রাহ্মণ আবার আবির্ভূত হয়ে আমাকে বললেন, তুমি তোমার গুরুর কাছে যাও, জগতের মঙ্গল করো। আমি পরশুরামকে প্রণাম করলাম। তিনি সস্নেহে বললেন, ভীষ্ম, তোমার সমান ক্ষত্রিয় বীর পৃথিবীতে নেই, আমি তুষ্ট হয়েছি, এখন যাও।

পরশুরাম অম্বাকে ডেকে বললেন, আমি সর্ব শক্তি প্রয়োগ করেও ভীষ্মকে জয় করতে পারি নি, এখন তুমি তার শরণ নাও, তোমার অন্য উপায় নেই। অম্বা পরশুরামকে বললেন, আপনি যথাসাধ্য করেছেন, অস্ত্র দ্বারা ভীষ্মকে জয় করা অসম্ভব। আমি স্বয়ং তাকে যুদ্ধে নিহত করবো।

পরশুরাম মহেন্দ্র পর্বতে চলে গেলেন। তারপর অম্বা যমুনাতীরের আশ্রমে কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন। তিনি দুঃসাধ্য ব্রত গ্রহণ কোরে নানা তীর্থে স্নান করতে লাগলেন। বৃদ্ধ তপস্বীরা তাকে নিরস্ত করতে গেলে অম্বা বললেন, আমি ভীষ্মের বধের নিমিত্ত তপস্যা করছি, স্বর্গকামনায় নয়। তার জন্য আমি পতিলাভে বঞ্চিত হয়েছি। আমার নারীজন্ম ব্যর্থ হয়েছে সেজন্য পুরুষত্বলাভের জন্য দৃঢ় সংকল্প করেছি, আপনারা আমাকে বারণ করবেন না।

অম্বার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব অম্বাকে বর দিতে এলে অম্বা বললেন, আমি যেন ভীষ্মকে বধ করতে পারি। মহাদেব বললেন, তুমি অন্য দেহে পুরুষত্ব পেয়ে ভীষ্মকে বধ করবে, বর্তমান দেহের সব ঘটনাও তোমার মনে থাকবে। তুম দ্রুপদের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং কিছু কাল পরে পুরুষ হবে। এই বর দিয়ে মহাদেব ফিরে গেলেন আর অম্বা নবজন্ম কামনায় স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করলেন।

সেই সময়ে দ্রুপদ রাজা সন্তান কামনায় মহাদেবের আরাধনা করছিলেন। মহাদেব বর দিলেন, তোমার একটি স্ত্রীপুরুষ সন্তান হবে। যথাকালে দ্রুপদের স্ত্রী একটি পরম রূপবতী কন্যা প্রসব করলেন, কিন্তু তিনি প্রচার করলেন যে তার পুত্র হয়েছে। এই কন্যাকে দ্রুপদ পুত্রের ন্যায় পালন করতে লাগলেন এবং নাম দিলেন শিখণ্ডী। গুপ্তচরের সংবাদে, নারদ ও মহাদেবের কথায় এবং অম্বার তপস্যার বিষয় আমি জানতে পারায় আমি বুঝেছিলাম যে অম্বাই শিখণ্ডী।

শিখণ্ডীর যৌবনকাল উপস্থিত হলে দ্রুপদকে তাঁর স্ত্রী বললেন, মহাদেবের বাক্য মিথ্যা হবে না, শিখণ্ডী পুরুষ হবেই, অতএব কোনও কন্যার সঙ্গে এর বিবাহ দাও। তারপর দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে শিখণ্ডীর বিবাহ হোলো। কিছু কাল পরে এই কন্যা কয়েক জন দাসীকে তার পিতার কাছে পাঠিয়ে জানালেন যে দ্রুপদকন্যা শিখণ্ডিনীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে। হিরণ্যবর্মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দূত দ্বারা দ্রুপদকে বলে পাঠালেন, দুর্মতি, তুমি আমাকে প্রতারিত করেছ, আমি শীঘ্রই তোমাকে সপরিবারে বিনাশ করবো।

দ্রুপদ ভয় পেয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। স্ত্রী বললেন, মহারাজ, আমার পুত্র হয়নি, সতীনদের ভয়ে আমি শিখণ্ডিনীকে পুরুষ বলে প্রচার করেছি, মহাদেবও বলেছিলেন যে আমাদের সন্তান প্রথমে স্ত্রী তার পর পুরুষ হবে। তুমি এখন মন্ত্রীদের পরামর্শ নিয়ে রাজধানী সুরক্ষিত করো এবং প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে পূজা ও হোম করো। পিতামাতার এই কথা শুনে শিখণ্ডিনী ভাবলেন, আমার জন্য এঁরা দুঃখ পাচ্ছেন, আমার মরাই ভালো।

শিখণ্ডিনী গৃহ ত্যাগ করে গহন বনে এলেন। সেই বনে স্থূণাকর্ণ নামে এক যক্ষের ভবন ছিলো। শিখণ্ডিনী তাতে প্রবেশ করে বহু দিন অনাহারে থাকলেন। একদিন যক্ষ দর্শন দিয়ে শিখণ্ডিনীকে বললেন, তোমার ইচ্ছা কি তা বলো, আমি পূর্ণ করবো। আমি কুবেরের অনুচর, যা দেওয়া সম্ভব নয় তাও দিতে পারি। শিখণ্ডিনী তার ইতিহাস জানিয়ে যক্ষকে বললেন আমাকে পুরুষ কোরে দিন। যক্ষ বললেন, রাজকন্যা, আমার পুরুষত্ব কিছুকালের জন্য তোমাকে দেবো, তাতে তুমি তোমার পিতার রাজধানী ও বন্ধুগণকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু তুমি আবার এসে আমার পুরুষত্ব ফিরিয়ে দিও। দ্রুপদকন্যা সম্মত হয়ে যক্ষের সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময় করলেন। স্থণাকর্ণ স্ত্রীরূপ পেলেন আর শিখণ্ডী পুরুষ হয়ে পিতার কাছে গেলেন।

দ্রুপদ আনন্দিত হয়ে দশার্ণরাজকে বলে পাঠালেন, বিশ্বাস করুন, আমার পুত্র পুরুষই। আপনি পরীক্ষা করুন, লোকে আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছে। রাজা হিরণ্যবর্মা কয়েকজন চতুরা সুন্দরী যুবতীকে পাঠালেন। তারা শিখণ্ডীকে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। তাদের কাছে সংবাদ পেয়ে দশার্ণরাজ আনন্দিত হয়ে বৈবাহিক দ্রুপদের ভবনে এলেন এবং কয়েকদিন থেকে কন্যাকে ভৎর্সনা করে চলে গেলেন।

কিছুকাল পরে কুবের স্থূণাকর্ণের ভবনে এলেন। তিনি তার অনুচরগণকে বললেন, এই ভবন সুন্দর ভাবে সাজানো দেখছি, কিন্তু স্থূণাকর্ণ আমার কাছে আসছে না কেন? যক্ষরা বললো, মহারাজ, দ্রুপদের শিখণ্ডিনী নামে একটি কন্যা ছিলেন, কোনও কারণে স্থূণাকর্ণ তাকে নিজের পুরুষত্ব দিয়ে তাঁর স্ত্রীত্ব নিয়েছেন। তিনি এখন স্ত্রী হয়ে গৃহমধ্যে রয়েছেন, তাই লজ্জায় আপনার কাছে আসতে পারছেন না। কুবেরের আজ্ঞায় তার অনুচরগণ স্থূণাকর্ণকে নিয়ে এলো। কুবের ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন, পাপীষ্ঠ, তুমি যক্ষগণের অপমান করেছ, তাই স্ত্রী হয়েই থাকো আর দ্রুপদকন্যা পুরুষ হয়ে থাকুক। শিখণ্ডীর মৃত্যুর পর তুমি পূর্বরূপে ফিরে পাবে। এই বলে কুবের সদলে চলে গেলেন।

পূর্বের প্রতিজ্ঞা অনুসারে শিখণ্ডী এসে স্থূণাকর্ণাকে বললেন, আমি ফিরে এসেছি। স্থুণাকর্ণ বহু বার বললেন, আমি খুশি হয়েছি। তার পর তিনি কুবেরের শাপের কথা জানিয়ে বললেন, রাজপুত্র, এখন তুমি যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করো, দৈবকে অতিক্রম করা আমাদের সাধ্য নয়। শিখণ্ডী আনন্দিত হয়ে রাজভবনে ফিরে গেলেন। দ্রুপদ রাজা তাঁকে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য পাঠালেন। কালক্রমে ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে শিখণ্ডীও ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করলেন।

অম্বার ইতিহাস শেষ করে ভীষ্ম বললেন, দুর্যোধন, আমি গুপ্তচরদের জড় অন্ধ ও বধির সাজিয়ে দ্রুপদের কাছে পাঠাতাম, তারাই আমাকে সকল বৃত্তান্ত জানিয়েছিল। শিখণ্ডী স্ত্রী ছিলো, পরে পুরুষত্ব পেয়ে রথিশ্রেষ্ঠ হয়েছে, কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বাই শিখণ্ডী। আমার এই প্রতিজ্ঞা সকলেই জানে যে স্ত্রীলোককে, নারী থেকে পুরুষ হয়েছে এমন লোককে এবং নারীর মতো নাম ও নারীর রূপ ধারণ করা পুরুষকে আমি শরাঘাত করি না।

______________

(ক্রমশ)