Story of Mahabharat Part 103 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 103

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 103

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০৩

দুর্যোধনের দূত হয়ে উলূকের যুধিষ্ঠিরের কাছে গমনের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

দুর্যোধনের দূত হয়ে উলূকের যুধিষ্ঠিরের কাছে গমনের কাহিনি

কুরুক্ষেত্রের পাশে হিরন্বতী নদীর নিকটে পাণ্ডবগণ সেনাবাহিনী সন্নিবেশ করলে কৌরবগণও সেখান থেকে কাছেই তাদের সেনাবাহিনী স্থাপন করলেন। কর্ণ, দুঃশাসন ও শকুনির সঙ্গে মন্ত্রণা করে দুর্যোধন স্থির করলেন যে শকুনির পুত্র উলূক দূত হয়ে পাণ্ডবদের কাছে যাবেন। তিনি উলূককে এইরূপ উপদেশ দিলেন –

“তুমি যুধিষ্ঠিরকে বলবে, তুমি সমস্ত প্রাণীকে অভয় দিয়ে থাকো, তাহলে নৃশংসের মতো জগৎ ধ্বংস করতে চাও কেন? প্রাচীনকালে দেবগণ প্রহ্লাদের রাজ্য হরণ করলে প্রহ্লাদ বলেছিলেন - হে দেবগণ, প্রকাশ্যে ধর্মের কথা বলে লুকিয়ে পাপকাজ করার নাম বৈড়াল ব্রত। উলূক, নারদ দ্বারা বর্ণিত এই কাহিনিটি তুমি যুধিষ্ঠিরকে শুনিও — এক দুষ্ট বিড়াল গঙ্গাতীরে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যার ভান করতো। পাখীরা তার কাছে গিয়ে প্রশংসা করতে লাগলে বিড়াল ভাবল আমার তপস্যা সফল হয়েছে। বেশ কিছুদিন পরে এক দল ইঁদুর স্থির করলো এই বিড়াল আমাদের মামা, তাই ইনি আমাদের সকলকে রক্ষা করবেন। ইঁদুরদের বক্তব্য শুনে বিড়াল বললো তপস্যা এবং তোমাদের রক্ষা এই দুই কাজ একসঙ্গে করা অসম্ভব, তবুও তোমাদের যাতে মঙ্গল হয় তা আমি করবো। কিন্তু আমি তপস্যায় ক্লান্ত হয়ে আছি, কঠিন ব্রত পালন করছি, তাই কোথাও যাবার মতো শক্তি আমার নেই। বৎসগণ, তোমরা আমাকে প্রত্যেক দিন নদীর তীরে বহন করে নিয়ে যেয়ো। ইঁদুরেরা সম্মত হোলো এবং সমস্ত ইঁদুর বিড়ালের আশ্রয়ে এলো। প্রত্যেক দিন ইঁদুর খেয়ে বিড়ালের শরীর ক্রমশ ভারী ও বলিষ্ঠ হতে লাগল। ইঁদুররা ভাবলো মামা ক্রমশঃ ভারী হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আমাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন? একদিন ডিণ্ডিক নামে এক ইঁদুর বিড়ালের আচরণ লক্ষ্য করবার জন্য তার সঙ্গে সঙ্গে গেলে বিড়াল তাকে খেয়ে ফেললো। তখন কোলিক নামে এক অতি বৃদ্ধ ইঁদুর বললো, এঁর তপস্যা ছল মাত্র, এঁর বিষ্ঠায় লোম দেখা যাচ্ছে কিন্তু ফলমূলভোজীর বিষ্ঠায় তা থাকে না। ইনি ভারী হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আমাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, সাত আট দিন থেকে ডিণ্ডিককেও দেখছি না। এই কথা শুনে ইঁদুররা পালিয়ে গেলে দুষ্ট বিড়ালও তার আগের জায়গায় ফিরে গেলো। দুরাত্মা যুধিষ্ঠির, তুমিও বৈড়াল ব্রত অবলম্বন কোরে জ্ঞাতিদের প্রতারিত করছো। তুমি পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলে, আমি তা দিইনি, কারণ আমার এই ইচ্ছা যে তুমি যুদ্ধ করো। তুমি কৃষ্ণকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলে যে তুমি শান্তি ও যুদ্ধ দুইয়ের জন্যই প্রস্তুত আছ। আমি যুদ্ধের আয়োজন করেছি, এখন তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করো।”

উলূক, তুমি কৃষ্ণকে বলবে, কৌরবসভায় যে মায়া দেখিয়েছিলে সেই মায়া, ইন্দ্রজাল, কুহক বা বিভীষিকা দেখলে অস্ত্রধারী বীর ভয় পায় না, গর্জন করে। আমরাও বহুপ্রকার মায়া দেখাতে পারি, কিন্তু তেমন উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাই না। কৃষ্ণ, তুমি হঠাৎ যশস্বী হয়ে উঠেছ, কিন্তু আমরা জানি পুরুষের চেহারায় নপুংসক অনেক আছে। তুমি কংসের দাস ছিলে সেজন্য আমার মতো কোনও রাজা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করেননি।

উলূক, তুমি সেই বহুভোজী ষাঁড় মূর্খ ভীমকে বলবে, বিরাটনগরে তুমি বল্লভ নামে পাচক হয়ে ছিলে, তা আমারই পৌরুষের ফল। পাশা খেলার সভায় যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তা যেন মিথ্যা না হয়, যদি শক্তি থাকে তবে দুঃশাসনের রক্ত পান করো। নকুল ও সহদেবকে বলবে, দ্রৌপদীর কষ্ট স্মরণ কোরে এখন যুদ্ধে তোমাদের পৌরুষ দেখাও। বিরাট আর দ্রুপদকে বলবে, প্রভু ও দাস পরস্পরের গুণাগুণ বিচার করে না, তাই গৌরবহীন যুধিষ্ঠির আপনাদের প্রভু হয়েছে। ধৃষ্টদ্যুম্নকে বলবে, তুমি দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করবে এসো। শিখণ্ডীকে বলবে, তুমি নির্ভয়ে যুদ্ধ করতে এসো, ভীষ্ম তোমাকে নারী মনে করেন, তোমাকে বধ করবেন না।

উলূক, তুমি অর্জুনকে বলবে, রাজ্য থেকে নির্বাসন, বনবাস এবং দ্রৌপদীর কষ্ট স্মরণ করে এখন পুরুষত্ব দেখাও। লৌহময় অস্ত্রসমূহ তীক্ষ্ণ করা হয়েছে, সমস্ত ঘোড়া প্রচুর খাদ্য খেয়ে পুষ্ট হয়ে আছে, যোদ্ধারা নিয়মিত বেতন পেয়েছে, অতএব কৃষ্ণের সঙ্গে এসে কালই যুদ্ধ করো। তুমি দুর্ধর্ষ বিশাল কৌরবসেনার শক্তি বুঝতে পারছ না। কৃষ্ণ তোমার সহায় তা জানি, তোমার গাণ্ডীব অতি শক্তিশালী তাও জানি, তোমার তুল্য যোদ্ধা নেই তাও জানি, তথাপি তোমাদের রাজ্য হরণ কোরে তেরো বছর ভোগ করেছি। পাশা খেলার সভায় তোমার গাণ্ডীব কোথায় ছিলো? ভীমের শক্তি কোথায় ছিলো? তোমরা আমাদের দাস হয়েছিলে, দ্রৌপদীই তোমাদের মুক্ত করেন। তুমি নপুংসক সেজে বেণী দুলিয়ে বিরাটকন্যাকে নাচ শেখাতে। এখন কৃষ্ণের সঙ্গে এসে যুদ্ধ করো, আমি তোমাদের ভয় করি না। হাজার হাজার কৃষ্ণ এবং শত শত অর্জুনও আমার অব্যর্থ বাণের আঘাতে পালিয়ে যাবে।

উলূক, পাণ্ডবশিবিরে গিয়ে দুর্যোধনের সকল কথা জানালেন। ভীমকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ দেখে কৃষ্ণ হেসে বললেন, শকুনিনন্দন, শীঘ্র ফিরে যাও, দুর্যোধনকে জানিও যে তার সব কথা আমরা শুনেছি, তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই হবে। ভীম বললেন, মূর্খ, তুমি দুর্যোধনকে বলবে, আমি দুঃশাসনের রক্তপান কোরে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবো। আর উলূক, তোমার পিতার সামনে আগে তোমাকে বধ করবো তার পর সেই পাপিষ্ঠকে বধ করবো।

অর্জুন হাসতে হাসতে বললেন, ভীম, যাদের সঙ্গে আপনার শত্রুতা তারা এখানে নেই, উলূককে নিষ্ঠুর কথা বলা আপনার উচিত নয়। উলূক, দুর্যোধন যে কথা বলেছেন, কাল সৈন্যদের সামনে গাণ্ডীব দিয়ে আমি তার জবাব দেবো। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস উলূক, তুমি দুর্যোধনকে বলবে, যে লোক পরের ধন হরণ করে এবং নিজের শক্তিতে তা রাখতে না পেরে অপরের সাহায্য নেয়, সে নপুংসক। দুর্যোধন, তুমি পরের শক্তিতে নিজেকে শক্তিমান মনে কোরে গর্জন করছো কেন? অর্জুন বললেন, উলূক, দুর্যোধনকে বলবে, তুমি ভীষ্মকে যুদ্ধে নামিয়ে মনে করছো আমরা দয়াবশে তাঁকে মারব না। যার ভরসায় তুমি গর্ব করছো সেই ভীষ্মকে আমি প্রথমে বধ করবো। বৃদ্ধ বিরাট ও দ্রুপদ বললেন, আমরা দাস হই বা যাই হই, কার কত পৌরুষ আছে কাল দেখা যাবে। শিখণ্ডী বললেন, বিধাতা ভীষ্মকে বধের জন্যই আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে রথ থেকে মাটিতে নিপাতিত করবো। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি দ্রোণকে সসৈন্যে সবান্ধবে বধ করবো, আমি যা করবো তা আর কেউ পারবে না।

উলূক কৌরবশিবিরে ফিরে গিয়ে দুর্যোধনকে সব কথা জানালেন।

 ______________

(ক্রমশ)